সবাই কেন রাশিয়ার এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র কিনতে চায়

সবাই কেন রাশিয়ার এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র কিনতে চায়

ছবি সংগৃহিত।

রাশিয়ার সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় তেল রফতানি থেকে, এর পরেই আছে সামরিক সরঞ্জাম। সম্প্রতি রাশিয়ার এস-৪০০ নামের মিসাইল সিস্টেমটি সবার নজর কেড়েছে। এটি ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য। গত বছর সাইবেরিয়ার পূর্বাঞ্চলে রাশিয়া আয়োজন করে এক সামরিক মহড়ার। ভস্তক -২০১৮ নামে পরিচিত এ মহড়াটি গত ৩০ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে রাশিয়ার সবচাইতে বড় যুদ্ধমহড়া। এতে রাশিয়া, চীন ও মঙ্গোলিয়ার প্রায় তিন লাখ সেনা অংশ নেয়। এটি কেবলই একটি সামরিক মহড়া ছিলো না। একইসাথে রাশিয়ার সামরিক সরঞ্জামের একটি প্রদর্শনীও ছিলো। সেখানে এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেমটি হাজির করা হয়। রাশিয়ার এই সামরিক মহড়ার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়নি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়ার সবচাইতে উন্নত সামরিক সরঞ্জামটি অনেকের দৃষ্টি কাড়ে। চীন, সউদি আরব, তুরস্ক, ভারত, কাতার এবং আরো কিছু দেশ তখনই জানিয়ে দেয় তারা এটি কিনতে চায়।
অবশ্য চাইলেই যে চাওয়াটা পূর্ণ হবে, তা কিন্তু নয়। কেননা তাদের ইচ্ছেটি জানার সাথে সাথে নড়েচড়ে বসেছে আমেরিকা, ন্যাটো এবং ইউরোপের শক্তিধর দেশগুলো। এসব দেশের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া হয় যেসব দেশ এই মিসাইল সিস্টেমটি কিনবে, তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক আর আগের মতো থাকবে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ হুমকির কারণ শুধু এটা নয় যে, এস-৪০০ প্রযুক্তিগতভাবে অনেক বেশি উন্নত। আরেক কারন এই সিস্টেমটি কেনার সিদ্ধান্ত দীর্ঘ দিনের পুরনো জোটগুলোতে ভাঙ্গন ধরাবে। পশ্চিমা দেশগুলোতেও এত উন্নত মিসাইল সিস্টেম নেই এবং তাই পশ্চিমাদের রাগ-বিরাগের তোয়াক্কা না করেই পশ্চিমা জোটভুক্ত দেশগুলোও এটি কিনতে চাইছে।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পীস রিসার্চ ইন্সটিটিউটের আর্মস ট্রান্সফার অ্যান্ড মিলিটারি এক্সপেন্ডিচার প্রোগ্রামের সিনিয়র গবেষক সাইমন ওয়েজম্যন বলেন, এস-৪০০ এর রেডার ও অন্যান্য সেন্সর বিশাল এলাকা কভার করে। যেমন এর রেডারের আওতা কমপক্ষে ৬০০ কিলোমিটার, ক্ষেপণাস্ত্রের আওতা ৪০০ কিলোমিটার। এটি সেট আপ, ফায়ার ও মুভ করা খুবই সহজ। সময় লাগে মাত্র কয়েক মিনিট। কেভিন ব্র্যান্ড নামে অপর এক বিশেষজ্ঞ জানান, এটিকে লং রেঞ্জ, সেমি লং রেঞ্জ, মিডিয়াম রেঞ্জ , এমনকি শর্ট রেঞ্জ হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। সোজা কথায় ব্যবহারকারী যেভাবে চান, সেভাবে। 
ন্যাটো জোটের সদস্য হয়েও এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেমের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ক্রেতা হচ্ছে তুরস্ক। দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান গত বছরই ঘোষণা দেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই মিসাইল সিস্টেমটি হাতে পাওয়ার চেষ্টা করবে তুরস্ক। ইতোমধ্যে তুরস্ক এই মিসাইল সিস্টেমটি হাতে পেয়েছে। আগামি নভেম্বরের মধ্যে এটি অপারেশনে যাবে বলে তুরস্কের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। 
রাশিয়ান মিসাইল সিস্টেমের জন্য তুরস্কের এই ব্যাকুল আগ্রহ ভাবিয়ে তোলে ন্যাটো জোটভুক্ত পশ্চিমা দেশগুলোকে। তাদের একজন বিশেষজ্ঞ কেভিন ব্র্যান্ড বলেন, রাশিয়ান মিসাইল সিস্টেমটির কারনে তুরস্ক হয়তো কিছুটা এগিয়ে যাবে, এটা ঠিক। তবে ন্যাটোর জন্য এটা খুব দরকারি কিছু নয়। বরং উদ্বেগের বিষয় হলো, সিস্টেমটি বিপজ্জনক দিকে মোড় নিতে পারে।
কেমন বিপদ? তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন ব্র্যান্ড। তার মতে, এখন ন্যাটোর যে ব্যাপক ডিফেন্স সিস্টেম আছে, এটি তার সাথে খাপ খাবে না। এটা হবে সবচাইতে বড় বিপদ। তাছাড়া রাশিয়ার অসদুদ্দেশ্যও থাকতে পারে। যেমন সিস্টেমটি রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত রুশ টেকনিশিয়ানরা কি ন্যাটোর ডেটা জেনে ফেলবে না?
তুরস্কের সাথে এই মিসাইল সিস্টেম নিয়ে ন্যাটো সদস্যভুক্ত দেশগুলোর সাথে এক ধরনের টানাপড়েন চলছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তার দেশ তুরস্কের কাছে অত্যাধুনিক এফ-৩৫ জঙ্গি বিমান সরবরাহ করবে না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প বলেছেন, তুরস্কের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সুসম্পর্ক রয়েছে। তবে দেশটি রাশিয়া থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনতে বাধ্য হওয়ায় বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ১২ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা উপেক্ষা করে রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০-এর প্রথম চালান গ্রহণ করে তুরস্ক। রাজধানী আঙ্কারার একটি বিমান ঘাঁটিতে এ চালানটি পৌঁছায়। তুরস্কের সঙ্গে এ নিয়ে জটিলতা আরো বেড়েই চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান এবং রাশিয়ার এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র কেনায় আঙ্কারার ওপর ক্ষুব্ধ যুক্তরাষ্ট্র। তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকেও ১০০টি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি করেছে। এফ-৩৫ কর্মসূচিতেও ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে দেশটি। এই যুদ্ধ বিমানের ৯৩৭টি যন্ত্রাংশ উৎপাদন করছে তুর্কি কোম্পানিগুলো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ন্যাটো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ এবং এটি নিরাপত্তা হুমকি। যুক্তরাষ্ট্র চায় রুশ ক্ষেপণাস্ত্রের বদলে তুরস্ক মার্কিন প্যাট্রিয়ট বিমান বিধ্বংসী ব্যবস্থা কিনুক। তবে তুরস্ক বলে আসছে, এফ-৩৫ ও এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আলাদা অবস্থানে থাকবে। আর বিকল্প ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহ করতে যুক্তরাষ্ট্র ধীরগতি দেখিয়েছে। ন্যাটো সদস্যভুক্ত ২৯টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম সেনাবাহিনী তুরস্কের। যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র তুরস্কের অবস্থান কৌশলগত কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সিরিয়া, ইরাক ও ইরানের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে দেশটির।
যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্ত একপেশে ও এর ফলে তাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সর্ম্পকের ওপর অপূরনীয় ক্ষতি হবে বলে জানিয়েছে তুরস্ক। তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সিদ্ধান্ত ন্যাটো জোটের চেতনার সঙ্গে যেমন সঙ্গতিপূর্ণ নয় তেমনি বৈধ যুক্তির ওপর প্রতিষ্টিত নয়। ফলে এফ-৩৫ কর্মসূচি থেকে তুরস্ককে সরিয়ে দেয়া খুবই অন্যায়। যুক্তরাষ্ট্রকে এ ভুল সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য আহ্বান জানায় আঙ্কারা।
এটা তো গেল ন্যাটোর সদস্য দেশ তুরস্কের বেলায়। ন্যাটোর সদস্য নয় এমন কয়েকটি দেশ - ভারত, সউদি আরব ও কাতারও তো এ সিস্টেমটি কিনতে চাইছে। তাদের বেলায়? বলা হচ্ছে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের প্রতিও কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কহানির ঝুঁকি রয়েছে। আমেরিকা এ ক্ষেত্রে কাজে লাগাবে তাদের ২০১৭ সালের একটি আইনকে। ওই আইনে বলা আছে, কোনো ব্যক্তি, কম্পানি কিংবা দেশ যদি আর্ন্তজাতিক নিরাপত্তাকে বিঘিœত' করে, তার বিরুদ্ধে আমেরিকা ব্যবস্থা নিতে পারবে। সেই 'ব্যবস্থা' হতে পারে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। তা যদি না-ও হয়, ওসব দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক খানিকটা নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে। তা যা-ই হোক, চীন, ভারত, সউদি আরবের মতো কয়েকটি দেশ ইতিমধ্যেই রাশিয়ার ওই মিসাইল সিস্টেমটি কেনার ঘোষণা দিয়ে ফেলেছে। কিন্তু এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের সাথে সর্ম্পকের অবনতি হতে পারে। 
এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ট মিত্র ভারত বলেছে তারা আগে থেকেই রুশ অস্ত্রশস্ত্রের সাথে পরিচিত। তাই নতুন অস্ত্রটিও তাদের পাওয়া চাই। পেন্টাগন বলেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব আরও জোরালো করার ব্যাপারে আগ্রহী। তবে তারা এটাও স্পষ্ট করেছে যে, এস-৪০০ মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমসহ রাশিয়ার কাছ থেকে যে কোন সামরিক সরঞ্জাম কেনার তারা বিরোধী। আমেরিকার অত্যাধুনিক পঞ্চম প্রজন্মের বিমানের মোকাবেলার জন্য রাশিয়া এই মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম তৈরি করেছে। ভারত গত বছরের অক্টোবরে রাশিয়ার সাথে এক ব্যাচ এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম কেনার জন্য ৪০,০০০ কোটি রুপির একটি চুক্তি করে।
ভারত যেখানে এস-৪০০ কেনার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র কি ভারতের সাথে বড় ধরনের প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্বের সম্পর্কে যেতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে পেন্টাগনের মুখপাত্র বলেন, “ আমরা যে বার্তাটা দেয়ার চেষ্টা করছি, সেটা হলো অন্যান্য দেশগুলো যাতে এমন কোন সরঞ্জাম না কেনে, যেটা আমাদের অত্যাধুনিক পঞ্চম প্রজন্মের বিমানের মোকাবেলার জন্য তৈরি করা হয়েছে”। আরেকটি বার্তা আমরা দেয়ার চেষ্টা করছি তা হলো এ ব্যাপারে আমাদের নীতির ক্ষেত্রে আমরা অনমনীয়”। ফলে আগামি দিনে এস -৪০০ কেনা নিয়ে ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সর্ম্পকে টানাপড়েন সৃষ্টি হতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাথে রাশিয়া নিবিড় ভাবে সম্পৃক্ত। 
তুরস্ক, ভারতসহ অন্যান্য দেশগুলো এস -৪০০ কেনার ক্ষেত্রে অতি আগ্রহী হওয়ার আরেকটি বড় কারন হলো , আমেরিকা অস্ত্র বিক্রি করলেও প্রযুক্তি ভাগাভাগি করে না, যা করে রাশিয়া। তাই সবার আগ্রহ রাশিয়ার দিকেই।