ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় : পাওয়া না পাওয়ার ৪২ বছর

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় : পাওয়া না পাওয়ার ৪২ বছর

ছবি : প্রতিনিধি

প্রতিষ্ঠার ৪১ বছর শেষ করে আজ (২২ নভেম্বর) ৪২ এ পা দিচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত প্রথম সরকারি বিদ্যাপীঠ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি)। ১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। দক্ষ গ্র‍্যাজুয়েট তৈরির লক্ষ্য নিয়ে নানাবিধ সংকট সাথে নিয়েও এগিয়ে চলছে সামনের দিকে৷ দীর্ঘ এ পথচলায় প্রাপ্তির খাতায় যেমন যুক্ত হয়েছে নানা অর্জন তেমনি ছোট নয় অপ্রাপ্তির পাতাও।

জানা যায়, ১৯৭৯ সালে কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ শহর থেকে যথাক্রমে ২৪ ও ২২ কিলোমিটার দূরে শান্তিডাঙ্গা-দুলালপুর এলাকায় ১৭৫ একর জায়গাজুড়ে স্থাপিত হয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। দুই অনুষদের অধীনে চারটি বিভাগে ৩০০জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু হয় বিদ্যায়তনটির। প্রতিষ্ঠার চার বছর পর ১৯৮৩ সালের ১৮ জুলাই তৎকালীন সরকার এক আদেশে বিশ্ববিদ্যালয়কে গাজীপুরের বোর্ড বাজারে স্থানান্তর করে। সেখানে সাত বছর কার্যক্রম চলার পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে স্থানান্তরিত হয়ে কুষ্টিয়া শহরের বিভিন্ন ভবনে অতিবাহিত হয় আরোও দুই বছর। পরে ১৯৯২ সালের ১ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর প্রতিষ্ঠাকালীন ঠিকানায় ফিরে আসে। 

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির ৮টি অনুষদের ৩৪টি বিভাগে ১৫ হাজার ৩৮৪ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন। ৩৯৭ জন শিক্ষক ৪৫৯ জন কর্মকর্তা, ১৭৭ জন সহায়ক কর্মচারী এবং ১৭৭ জন সাধারণ কর্মচারী বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে কাজ করে যাচ্ছেন। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন পুলে ৪৩টি গাড়ি রয়েছে। এর মধ্যে বাস-মিনিবাস ১৬টি, এসি কোস্টার গাড়ি ৬টি, এ্যাম্বুলেন্স ২টি। শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল রয়েছে ৮টি। যার মধ্যে ৫টি ছাত্রহল এবং ৩টি ছাত্রীহল।

ক্যাম্পাসের অবকাঠামোগত উন্নয়নে চলছে ৫ শত ৩৭ কোটি ৭ লক্ষ টাকার মেগাপ্রকল্পের কাজ। এর আওতায় ক্যাম্পাসে ৯টি দশতলা ভবন ও ১টি কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান গবেষণাগার নির্মাণ, ১২টি ভবনের উর্দ্ধমুখী সম্প্রসারণ, গভীর নলকূপ স্থাপন, ২টি ৫০০ কেভি বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন, সোলার প্যানেল স্থাপনসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ এগিয়ে চলছে। 

জাতির পিতার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধার প্রতীক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সন্নিকটে স্থাপিত হয়েছে 'মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব' ম্যুরাল। মুজিবীয় চেতনায় স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে মুজিববর্ষ উপলক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলফটকের সামনে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ‘মুক্তির আহ্বান’ ও ‘শাশ্বত মুজিব’ উদ্বোধন করা হয়। 

এ ছাড়া গত ৮ ফেব্রুয়ারি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে মুজিববর্ষ ডিজিটাল লাইব্রেরি একসেস সেন্টারের উদ্বোধন করা হয়েছে। প্রায় ৫০ হাজার বই ডিজিটাল লাইব্রেরির আওতায় আনা হয়েছে। এ অটোমেশনের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা খুব সহজে সার্চ করে কাঙ্খিত বই খুঁজে পাবেন এবং বই বাসায় নিয়ে পড়তে পারবেন।

নানা প্রাপ্তির মাঝেও হিসাবের খাতায় ছোট নয় অপ্রাপ্তির তালিকাও। দীর্ঘ এ পথচলায় নানামুখী সংকট ছিল প্রতিষ্ঠানটির নিত্য সঙ্গী। তাই ৪২ বছরেও দূর্নীতি, অনিয়ম ও নানাবিধ সংকটের কাঠগড়া থেকে বের হতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়টি। 

বিভাগ ও শিক্ষক-শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়লেও কাঙ্ক্ষিত মানের শিক্ষা ও গবেষণা নিশ্চিত করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়টি। নিশ্চিত হয়নি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সিকিভাগ আবাসন ব্যবস্থাও। ফলে প্রতিবছর মোট বাজেটের একটি বড় অংশ ব্যয় করতে হয় পরিবহন খাতে। চার দশকেও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে যুক্ত হয়নি ছাত্র সংসদের বিধান। শিক্ষার্থীরা দাবি করে আসলেও এ বিষয়ে ইতিবাচক কোনো পদক্ষেপও নেয়নি কর্তৃপক্ষ। ক্যাম্পাসে নিশ্চিত হয়নি সব রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের সহাবস্থানও। 

বিশবিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত ১২ জন উপাচার্য গত হয়েছেন। তবে একজন ব্যতিত কোনো উপাচার্যই তাঁর মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। অধিকাংশই অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে আন্দোলনের মুখে অপসারিত হয়েছেন বা পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। এ ছাড়া শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যের কারণে বারবার খবরের পাতায় শিরোনাম হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিভিন্ন সময়ে নিয়োগ নিয়ে প্রার্থীর সাথে শিক্ষকদের দেনদরবারের অডিও ক্লিপ প্রকাশ হলেও অজ্ঞাত কারণে বিচাররের আওতার বাইরেই থাকছেন অভিযুক্তরা। জড়িতদের বেশিরভাগই সমকালীন প্রশাসনের আস্থাভাজন হওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে কার্যকর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে শিক্ষক ছাড়াও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ বাণিজ্যের কালো থাবা থেকে মুক্ত হতে পারছেনা বিশ্ববিদ্যালয়টি। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার অন্যতম অংশ গবেষণা। সেই গবেষণায়ও উল্লেখযোগ্য কোনো অবদান নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। গবেষণায় মন না দিয়ে অভ্যান্তরীন রাজনীতিতে ব্যম্ত সময় পার করেন শিক্ষকরা। চার দশকের অধিক বয়সী বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমান বিভাগ সংখ্যা মাত্র ৩৩ টি। নতুন বিভাগ খোলায়ও রয়েছে নানা সংকট। শেষ তিন বছরে খোলা নয়টি বিভাগের নেই নিজস্ব শ্রেণিকক্ষ, ল্যাব ও সেমিনার লাইব্রেরি। ফলে ক্লাস করতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। 

ভর্তি পরীক্ষা ও পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বরাবরই। শেষ চার বছরে একবারও সুষ্ঠুভাবে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়টি। প্রশ্নপত্রে অনিয়ম, অসঙ্গতি, একই প্রশ্নে একাধিকবার পরীক্ষাসহ ভর্তিচ্ছুদের চরম ভোগান্তির ঘটনা ঘটছে বারবার।

নতুন উপাচার্যের ভাবনা: 

গত ৪ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩তম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিচাগের অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত) ড. শেখ আবদুস সালাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের নানামুখী সংকট সমাধানে তিনি তাঁর ভাবনা জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ও মর্যাদা বৃদ্ধি করতে জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আরও বেশি করে মনোনিবেশ করব ৷ শিক্ষা ও গবেষণা কে আরও মানসম্পন্ন ও বেগবান করা, একুশ শতকের উপযোগী করে শিক্ষার্থীদের দক্ষ মানবসম্পদরূপে গড়ে তোলা, স্বচ্ছতার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী সকলের সম্মিলিত উদ্যোগী ভূমিকা  ও সহযোগিতা কামনা করছি।