চলনবিল পাড়ের তিন জেলার রফতানি মানের শুঁটকি মাছের মাধ্যমে বিপুল পরিমান অর্থ উপার্জন

চলনবিল পাড়ের তিন জেলার রফতানি মানের শুঁটকি মাছের মাধ্যমে বিপুল পরিমান অর্থ উপার্জন

ছবি : প্রতিনিধি

চলনবিল এলাকার ভাল সংখ্যক ব্যবসায়ী চলতি মওসুমে রফতানি মানের শুঁটকি মাছ উৎপাদনের মাধ্যমে বিপুল অর্থ উপার্জন করছেন। এদিকে, তারা অর্থনৈতিক খাতকে সমৃদ্ধ করতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা চাইছেন।

চলনবিল পাড়ের পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জের শুঁটকি তৈরির চাতালগুলো এখন মাছে পরিপূর্ণ। উত্তর জনপদের মৎস্য ভান্ডার হিসেবে খ্যাত স্থান সমূহের মধ্যে বৃহত্তর চলনবিল একটি। প্রতিদিন প্রচুর মাছ চলনবিল থেকে সড়ক, রেল ও নৌ পথে দেশের বিভিন্ন জেলায় বাজারজাত করা হচ্ছে। শুঁটকি মাছ মুখরোচক খাবারগুলোর মধ্যে একটি। সে অনুযায়ী শুঁটকি উৎপাদনেও এ অঞ্চল যথেষ্ট প্রসিদ্ধি রয়েছে। আর তাই এবারের শুঁটকি মওসুমকে ঘিরে শুঁটকি  তৈরিতে এখন চরম ব্যস্ত সময় কাটছে ব্যবসায়ীদের। চলনবিল সংলগ্ন এলাকা জুড়ে এখন শুধু শুঁটকি তৈরির যেন ধুম পড়েছে। এবার পরপর দু’বার বন্যায় চলনবিলসহ বিভিন্ন পুকুর পুষ্কনি পানিতে ডুবে যাওয়ায় মাছের বিচরণ অনেক বেশি। তাই জলাশয়গুলোতে ধরা পড়ছে দেশীয় প্রজাতির রকমারি মাছ।

জানা যায়, রাজধানী ঢাকাসহ উত্তনঞ্চলের কুড়িগ্রাম, দিনাজুপর, রংপুর, নিলফামারী, সৈয়দপুর; দক্ষিণা লের কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরসহ দেশের প্রায় ২০-২৫টি জেলাতে বাজারজাত করা হয় ঐতিহ্যবাহী খ্যাতি সম্পন্ন চলনবিলের শুঁটকি মাছ।

এ প্রতিনিধি চাটমোহর উপজেলার ডিবিগ্রাম ইউনিয়নের বামনগ্রাম, হরিপুর ইউনিয়নের ধুলাউড়ি গ্রাম ও বোয়ালমারী গ্রামে গিয়ে দেখা গেল নারী-পুরুষ শ্রমিকরা  কৈ, মাগুর, বৌম, রুই, কাতলা, মৃগেল, বাউশ, আইর, বাঘাইর, চিতল, ফলি, বোয়াল, পাবদা, টেংড়া, শৈল, গজার, টাকি, নাদাই, শিং, খালিশা, পুটি, চিংড়ি এবং চ্যাং মাছ শুকাচ্ছেন। মহিলা ও পুরুষ শ্রমিক সকাল থেকে রাত অবধি মাছ কেনা, ধুয়ে শুকনো এবং বাছায়ের কাজ করছেন। একই পদ্ধতিতে সিরাজগঞ্জের মহিষলুটি এলাকাসহ পাবনা, নাটোর সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন শেডে বাণিজ্যিকভাবে শুঁটকি মাছ তৈরি করা হচ্ছে পুরোদমে। পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, সুজানগর; সিরাজগঞ্জের উল্লপাড়া, তাড়াশ, রায়গঞ্জ, নাটোরের সিংড়া, গুরুদাসপুর উপজেলায় প্রতিদিন শত শত মন মাছ শোকানো হচ্ছে। দূরদূরান্ত থেকে আগত ব্যবসায়ীরা তাদের মত করে মাছ শোকানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। শুঁটকি মাছ ব্যবসায়ী আবদুস সালাম বলেন, এ ব্যবসায় অনেক সুবিধা রয়েছে। প্রতিটি শুঁটকি শেডে ১০ থেকে ১৫ জন পুরুষ-মহিলা কাজ করছেন। ব্যবসায়ীরা বলেন, এসব কাজে মহিলা শ্রমিকরা বেশি দক্ষ। তাই মহিলা শ্রমিকের বেশি চাহিদা বলেই তাদের সংখ্যা বেশি।

শুঁটকি মাছ কাজে লিপ্ত হারুনুর রশিদ, আপন দু’ভাই আব্বাস আলী ও নিয়ামত আলি, হালিমা খাতুন, আকলিমা বেগম, সামসুন্নহারসহ অনেক শ্রমিক বললেন,“ সকাল থেকে এক নাগাড়ে বিকেল পর্যন্ত কাজ করি। টাকাও ঠিক মত পাচ্ছি। শুধু বর্ষা মওসুমে শুঁটকি তৈরি করে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করে তারা পরিবারের সারা বছরের ভরণপোষণ নিশ্চিত করেন। এখানকার শুঁটকি মাছ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। সেখানে কথা হয় দু’জন মাছ ব্যবসায়ীর সাথে। মাছ কিনতে আসা নিলফামারি থেকে আসা শুঁটকি মাছ ব্যবসায়ী মোঃ ইফতেখার আলী ও ইকবাল হোসেন এই প্রতিনিধিকে জানান, তারা প্রতিবছর এই চলনবিল এলাকায় শুঁটকি মাছ কিনতে আসেন। তবে অন্যান্য বারের চেয়ে এবার বেশি মাছ পাওয়ায় তাদের লাভের অংশ বেশি হচ্ছে। এবারে পরপর দু’বার বন্যার কারনে নদী ও খাল বিলে কাঁচা মাছের আমদানি অনেক বেশি। চলনবিল এলাকার শুকনো মওসুমের শ্রমিকরা সুস্বাদু লাভের জন্য নিবিড় বাসনা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন; কারণ তাদের উৎপাদিত শুঁটকি  মাছের চাহিদা দেশ-বিদেশের বাজারে সমাদৃত।

গুরুদাসপুরের শাপগাড়ি গ্রামের শুঁটকি মাছ ব্যবসায়ী নান্নু হোসেন প্রায় ২৫ বছর ধরে শুঁটকি মাছের ব্যবসা করছেন। তিনি জানান, চলনবিল অঞ্চল থেকে উৎপাদিত পুটি মাছের ভারতে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। সিরাজগঞ্জের সলঙ্গার উপজেলার সেকেন্দাসপুর গ্রামের শুঁটকি মাছ ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন জানান, গত বছর তার প্রায় এক লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।  তিনি উৎপাদিত শুঁটকি মাছের দাম সন্তোষজনক হওয়ায় তিনি এ বছর ভাল লাভের প্রত্যাশা করছেন। কিছু ব্যবসায়ী জানান,“শুঁটকি  মাছের ব্যবসা ভাগ্যের উপর নির্ভর করে। চলনবিল অ লে প্রক্রিয়াজাত শুঁটকি মাছের সংরক্ষণের কোনও ব্যবস্থা নেই এবং আশেপাশে শুকানোর সামগ্রীর ব্যবস্থা নেই বলে আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি।”

চাটমোহরে কর্মরত সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান জানান, প্রতি বছর অক্টোবরের শেষ থেকে পুরো নভেম্বর পর্যন্ত চলনবিল এলাকায় প্রচুর মাছ ধরা পড়ে। বাজারে কাঁচা মাছের দাম ভালো হওয়ায় বেশিরভাগ মাছই এখন বাইরে যাচ্ছে। চলনবিল ভিত্তিক শুঁটকি বিক্রয় কেন্দ্র এবং স্টোরেজ সেন্টার নির্মাণ করা হলে এলাকার শুঁটকি মাছ ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন।সিরাজগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শাহেদ আলী জানান, গত বছর এই অঞ্চলে ৯৫ মেট্রিক টন শুঁটকি মাছ উৎপাদিত হয়েছিল।

পাবনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ আবদুর রউফ বলেন, শুঁটকি মাছে রয়েছে প্রচুর পরিমান আমিষ। তাই দেহের আমিষের চাহিদা মেটায় শুঁটকি মাছে। এছাড়া অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন এর সাথে জড়িত বিপুল সংখ্যক মানুষ। আগের চেয়ে এখন মানুষ শঁটকি মাছ খাচ্ছে বেশি। এ অঞ্চলে শুঁটকি প্রিজার্ভের ব্যবস্থা থাকলে দীর্ঘমেয়াদী শুঁটকি পাওয়া যাবে সর্বত্রে বলে তিনি উল্লেখ করেণ।

পাবনার জেলা প্রশাসক কবির মাহমুদ বলেন, সারাদেশে চলনবিলের শুঁটকি মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। পানি হ্রাসের সাথে সাথে প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন ধরণের মাছ ধরা পড়ছে, ডিসি যোগ করেছেন।মাছের ব্যাপক আমদানি এবং শুঁটকির বাজার মূল্য বেশি থাকায় যেন তাদের চোখে-মুখে হাসির ঝলক ফুটে উঠছে।