বিভিন্ন ধর্মে মূর্তিপূজা ও ভাস্কর্য নির্মাণ

বিভিন্ন ধর্মে মূর্তিপূজা ও ভাস্কর্য নির্মাণ

ড. মো: কামরুজ্জামান

ড. মো: কামরুজ্জামান

আক্ষরিক অর্থে মূর্তি শব্দটি দেহ, রূপ, আকৃতি, কাঠামো, ঠাট, অবকাঠামো,  প্রতিচ্ছবি, প্রতিমূর্তি, আইডল, ওয়াসান, অবয়ব, প্রতিকৃতি, প্রতিমা, ভাস্কর্য, দেবমূর্তি ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত সর্বপ্রকার মূর্তমান পদার্থকেই বাংলায় মূর্তি বলা হয়। ইংরেজিতে fetish ও statue বলা হয়ে থাকে। বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক অভিধান ও সংসদ অভিধানে মূর্তি শব্দটি দেহ, আকৃতি, রূপ ও প্রতিমা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আর প্রায়োগিক অর্থে, কোন বিশেষ গোষ্ঠীর পূজা, আরাধনা, যজ্ঞ, প্রার্থনা, মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান প্রভৃৃতি উদ্দেশ্যে যে ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয় তাকে মূর্তি বলা হয়। যেমন বুদ্ধের প্রতিমূর্তি বা ভাস্কর্য পাথর খোদাই করে নির্মাণ করা হয়েছে আর সেটাকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা পূজা করে বিধায় তাকে মূর্তি বলা হয়ে থাকে। আর এ লক্ষ্যে নির্মিত প্রতিমূর্তিতে ব্যক্তির আসন বসন ও বাহ্যিক রূপকে সম্পূর্ণপে অভিন্ন রাখার প্রচেষ্টা চালানো হয়। Google.com এর ভাষ্য মতে, যেসব আকৃতি এমনভাবে নির্মাণ করা হয় যা রোদ বা আলোর বিপরীতে তার প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত হয় তাকে মূর্তি বলা হয়। অপরদিকে dramind.bd.com এর সূত্র মতে, আভিধানিক অর্থে মূর্তি ও ভাস্কর্যের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। তবে প্রায়োগিক, আদর্শিক, সাংস্কৃতিক, নান্দনিক, ঐতিহ্য, বিশ্বাসগত ও উৎপত্তিগত বিবেচনায় কিছুটা  পার্থক্য রয়েছে। 

যেমন-মূছ্র্+তি=মূর্তি। ভাস+কৃ+অ=ভাস্কর>ভাস্কর্য। ভাস্কর্য নির্মাণের ক্ষেত্রে শিল্পকর্মের প্রাধান্য দেখা যায়, আর মূর্তির ক্ষেত্রে দেখা যায় পূজার  প্রাধান্য। শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ sculpture যার বাংলা অর্থ হচ্ছে প্রস্তারাদি খোদাইপূর্বক মূর্তিনির্মাণ ও শিল্পকর্ম। অর্থাৎ পাথর খোদাই করে যে মূর্তি নির্মাণ করা হয় সেটাই ভাস্কর্য। ইংরেজিতে যেমন statue ও sculpture শব্দ দুটি সমার্থবোধক শব্দ। বাংলাতেও মূর্তি ও ভাস্কর্য শব্দ দুটি একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ মূর্তি ও ভাস্কর্য শব্দ দুটি পরস্পর সমার্থবোধক শব্দ। পরিভাষায়, যে সকল মূর্তি পূজা, আরাধনা, যজ্ঞ, প্রার্থনা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে নির্মিত না হয়ে ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, নান্দনিকতা ও ঐতিহাসিক মূল্যবোধজনিত অনুভব পরিস্ফুটনের নিমিত্তে নির্মাণ করা হয়ে থাকে সেগুলোকে মূর্তি না বলে ভাস্কর্য বলা হয়। আর উইকিপিডিয়া এটাকে ত্রিমাত্রিক শিল্পকর্ম বলে উল্লেখ করেছে। অর্থাৎ ভাস্কর্য হলো এমন এক ত্রিমাত্রিক শিল্পকর্ম যা জ্যামিতি শাস্ত্রের ঘনকের ন্যায় দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর গভীরতা বিশিষ্ট আয়তকার। Google.com এর সংজ্ঞা অনুযায়ী যেসব আকৃতির ছায়া প্রতিফলিত হয় না এবং এমনভাবে নির্মাণ করা হয় যা আলোর বিপরীতে তার কোন ছায়া প্রদর্শিত হয় না সেটাই ভাস্কর্য। উক্ত আলোচনার  মাধ্যমে এটা স্পষ্ট হলো যে আভিধানিক দৃষ্টিকোণে মূর্তি ও ভাস্কর্যের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই, উভয়টি একই জিনিস। তবে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে উভয়ের মাঝে কিছুটা পার্থক্য আছে আর সেটা হল ব্যবহারকেন্দ্রিক ও উদ্দেশ্য কেন্দ্রিক; নির্মাণ কেন্দ্রিক নয়। 

ইশিখন ডটকম এর ফ্যান পেজে ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন জনের মতামত চাওয়া হলে বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে মূর্তি এবং ভাস্কর্যের পার্থক্য সম্পর্কে নিজেদের মতামত তুলে ধরেছে। একজন বলেছে, মূর্তি হল সেটা যেটা মন্দিরের পূজার জন্য থাকে এবং স্থাপিত হয়। আর ভাস্কর্য হল, সেই প্রতিকৃতি যা ইতিহাস ও সংস্কৃতি লালন করে। আরেকজন বলেছে, মূর্তি এবং ভাস্কর্যের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এর পার্থক্য হচ্ছে সেরকম যেরকম আব্বা এবং বাবা বলা। অন্য একজন বলেছে, মূর্তি পূজা করে সাধারণত হিন্দুরা আর ভাস্কর্যের পূজা করে নাস্তিকরা। আবার কেউ কেউ বলেছে মূর্তি বানানো হয় উপাসনা করার জন্য আর ভাস্কর্য বানানো হয় শোভাবর্ধনের জন্য কিংবা স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য। আর একজন বলেছে, যেগুলোকে অর্ঘ্য অর্পণ করা হয় সেগুলো হচ্ছে মূর্তি। আর যেগুলো সৌন্দর্যবর্ধন কল্পে, স্থাপত্য শিল্পে, অট্টালিকা, রাস্তার পাশে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজে ব্যবহৃত হয় এবং কোনভাবেই পূজার কাজে ব্যবহৃত হয় না সেগুলোকে স্থাপত্য শিল্প কিংবা ভাস্কর্য বলা যেতে পারে।
 
বাংলাদেশে বর্তমানে এ ভাস্কর্য নির্মাণ নিয়ে সরকার এবং আলেম-ওলামাদের মাঝে একটি উত্তপ্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। চলছে ব্যাপক বিতর্ক। বিনিময় হচ্ছে উত্তপ্ত বাক্য। তারই ধারাবাহিকতায় গত ৫ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখ দিবাগত রাতে কুষ্টিয়ায় কতিপয় দুর্বৃত্তকর্তৃক নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাংচুর করা হল। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক, লজ্জাজনক এবং নিন্দনীয়। কারণ বাংলাদেশের ভাস্কর্য নির্মাণের ইতিহাস এটিই প্রথম নয়। 

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এবং প্রেরণায় সর্বপ্রথম নির্মিত ভাস্কর্য হলো জাগ্রত চৌরঙ্গী। যেটা ১৯৭৩ সালে নির্মিত হয় এবং বর্তমানে গাজীপুর জয়দেবপুর চৌরাস্তার সড়ককদ্বীপে স্থাপিত আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অপরাজেয় বাংলা নামের একটি ভাস্কর্য। এটা নির্মিত হয় ১৯৭৯ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর। বন্দুক কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এ ভাস্কর্যটি দেশের সর্বস্তরের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়ার বিষয়টি জানান দেয়। এটি সামগ্রিক মুক্তিযুদ্ধের একটি বড় নিদর্শন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির পশ্চিম পাশে অবস্থিত আরেকটি ভাস্কর্য দেখা যায়, নাম স্বোপার্জিত স্বাধীনতা। এটা নির্মিত হয় ১৯৮৮ সালের ২৫ শে মার্চ। যুদ্ধে নিশ্চিত পরাজয় জেনেও বীরদর্পে লড়ে যান যিনি তিনি হচ্ছেন সংশপ্তক। ১৯৯০ সালের ২৬ শে মার্চ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল সংশপ্তক ভাস্কর্য। অন্যদিকে ১৯৯১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মিত হয় শাবাস নামের আরেকটি ভাস্কর্য। ২০০০ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মিত হয় বিজয় ৭১ ভাস্কর্য। 

ময়মনসিংহের মহিলা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সামনে রয়েছে রোমান দেবী ভেনাসের মূর্তি। এটি একটি নারী ভাস্কর্য। মূর্তিটি সম্পূর্ণভাবে নগ্ন শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি মহিলা কলেজের সামনে। এছাড়া মেহেরপুরের মুজিবনগর ও দেশের বিভিন্ন স্থানে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যসহ জাতীয় অন্যান্য নেতৃবৃন্দের ভাস্কর্য নির্মাণ লক্ষ্য করা যায়। এসকল ভাস্কর্য স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা, ঐতিহ্য এবং ইতিহাস নির্দেশক। এখানে ধর্মীয় কোন পূজা, যজ্ঞ, আরাধনা ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয় না। আর এসব ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আলেম সমাজকে তেমন কোনো বক্তব্য দিতে শোনা যায়নি। 

তবে গত ১১ এপ্রিল ২০২০ আলেমদের সাথে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে নির্মিত গ্রিক দেবি থেমিসের মূর্তি সরানোর পক্ষে মত দিলে সেটা পরবর্তীতে সরিয়ে ফেলা হয়। তার আগে ২০০৮ সালের ১৫ ই অক্টোবর তৎকালীন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে (বর্তমানে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) নির্মাণাধীন লালন ভাস্কর্য কর্তৃপক্ষ আলেমদের দাবির মুখে অপসারণ করেন। কারণ সেটি ছিল হাজীদের হজ্বে গমন এবং আগমনের কেন্দ্রবিন্দু। তাই কর্তৃপক্ষ বিষয়টি মেনে নিয়ে ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলতে সম্মতি  প্রদান করেন। আর বর্তমানে ওলামায়ে কেরামের প্রতিবাদ চলছে মুজিব বর্ষ উপলক্ষে ঢাকার ধোলাইরপাড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণের বিপক্ষে।

বাংলাদেশের আলেম সমাজ কেন ভাস্কর্য নির্মাণের বিরুদ্ধে সোচ্চার সে বিষয়ে আলোচনা করা এখন সময়ের দাবি। প্রথমত বিশ্বের বিভিন্ন ধর্ম এ বিষয়ে কি মতামত পেশ করেছে সেটা আলোচনা দরকার।

পৃথিবীতে ৪৩০০ ধর্মের মধ্যে বড় ধর্ম পাঁচটি। বিশ্ব নেতৃত্ব এবং ধর্মের অনুসারীর দিক থেকে প্রথম বড় ধর্ম হচ্ছে  খ্রীষ্টান ধর্ম। তারপর ইসলাম ধর্ম, তারপর হিন্দুধর্ম, তারপর বৌদ্ধ ধর্ম এবং সর্বশেষ ইহুদি ধর্ম। এই পাঁচটি ধর্মের মধ্যে খ্রিস্টান ধর্ম, ইসলাম ধর্ম এবং ইহুদি ধর্ম হচ্ছে আসমানীধর্ম বা আল্লাহ প্রদত্ত ধর্ম। বাকি দুটি মানবসৃষ্ট বা মানবরচিত ধর্ম। তবে সকল ধর্মের মূল বক্তব্য তাওহীদ বা একত্ববাদ এবং একেশ্বরবাদ। প্রত্যেক ধর্মই একত্ববাদের কথা বলে এবং মূর্তি বানানো এবং পূজা করা নিষেধ করে। যেমন হিন্দু ধর্মে বলা হয়েছে, " না তাস্তে প্রাতিমা আস্থি "অর্থাৎ ঈশ্বরের কোনও মূর্তি নেই (রীগ বেদ, অধ্যায় ৩২, অনুচ্ছেদ ৩)। "অন্ধতম প্রভিশান্তি  ইয়ে অশম্ভুতি মুপাস্তে" অর্থাৎ "যারা অশম্ভুতির পূজা করে তারা অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। তারা শাম মূর্তির পূজা করে অধিকতর অন্ধকারে পতিত হয়।" এখানে অশম্ভুতি দ্বারা প্রাকৃতিক বস্তু যেমন আগুন,পানি, বাতাস ইত্যাদি বোঝানো হয়েছে। আর শাম মূর্তি দ্বারা মানুষের তৈরি বিভিন্ন বস্তু যেমন চেয়ার-টেবিল, প্রতিকৃতি,  প্রতিমা, মূর্তি ইত্যাদি বোঝানো হয়েছে। (যজুর্বেদ, অধ্যায় ৪০, অনুচ্ছেদ ৯)। এছাড়া ভগবত গীতার ৭ নম্বর অধ্যায়ের ২০ নম্বর স্তবে বলা হয়েছে "যাদের বোধশক্তি পার্থিব আকাঙ্খার মাধ্যমে বিলুপ্ত হয়ে গেছে তারাই শুধু কেবল উপদেবতার প্রার্থনা করে থাকে। "তারাই হচ্ছে বস্তবাদী ও ভোগবাদী লোক যারা উপদেবতার প্রার্থনা করে, তারা প্রকৃত স্রষ্টার উপাসনা করে না।" ভগবত গীতা, অধ্যায় নম্বর: ১০, স্তব ৩। "যারা নিজেদের বিবেক বুদ্ধি হারিয়েছে তারাই কেবল মূর্তি বানায় এবং তার পূজা করে।"(ভগবত গীতা, অধ্যায় ৭, অনুচ্ছেদ ২০)। হিন্দুদের পবিত্র এ সকল ধর্মীয় গ্রন্থের নির্দেশ দ্বারা একত্ববাদের কথা বোঝানো হয়েছে এবং মূর্তি ও ভাস্কর্য বানানো এবং পূজা করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। 

প্রথম যুগের হিন্দু পণ্ডিতগণ তাদের ধর্মগ্রন্থের নির্দেশের আলোকে কোন ধরণের মূর্তি বা ভাস্কর্য বানানো ও তা পূজা করা থেকে বিরত ছিলেন। যদিও বর্তমান হিন্দুগণ তাদের ধমগ্রন্থের নির্দেশ অমান্য করে মূর্তি ও ভাস্কর্য বানায় এবং তার পূজাও করে থাকে। তারা শুধু কল্পিত ঈশ্বরের মূর্তি তৈরী ও পূজাতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং তারা বড় যে কোনো গাছ, মাছ, পাথর পাহাড় ইত্যাদি জীব ও জড় বস্তুকে পূজা শুরু করে। তার মানে হল, হিন্দু ধর্মালম্বীগণ তাদের ধর্মগ্রন্থকে অবজ্ঞা ও অমান্য করে। তাদের ঈশ্বরের নির্দেশ অমান্য করে এবং এভাবে ধর্মীয় অন্যান্য বিভিন্ন নির্দেশ অমান্য করে তারা একটি ধর্মবিহীন জাতিতে পরিণত হয়েছে। 

ঠিক অনুরূপভাবে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীগণও তাদের ধর্মগ্রন্থের নির্দেশ অমান্য করে মূর্তি নির্মাণ ও পূজা করে থাকে। কারণ বৌদ্ধধর্ম অধ্যয়ন করলে জানা যায় যে, প্রথমদিকে বৌদ্ধধর্মে কোন ধরণের মূর্তি বানানো ও পূজার বিধান ও প্রচলন ছিল না। পরবর্তীতে মহাযান তথা বোধিসত্ত্বের বিকাশের ফলে বুদ্ধমূর্তির  প্রচলন শুরু হয় বলে তাদের অন্যতম বিখ্যাত ভিক্ষু সাধনা জ্যোতি তার লিখিত প্রবন্ধ "বুদ্ধ পূজা" স্তবে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ বৌদ্ধধর্মে মূর্তি বানানো এবং পূজা করা নিষেধ। কিন্তু তারাও বর্তমানে বুদ্ধসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রাণীর মূর্তি নির্মাণ এবং তার পূজা করে থাকে। পাশাপাশি তারা ভাস্কর্যও নির্মাণ করে থাকে। এর মাধ্যমে তারাও তাদের ধর্মের বিধান অনুসরণ করা থেকে দূরে অবস্থান করছে এবং একটি ধর্মবিহীন জাতিতে পরিণত হয়েছে। 

আসমানী ধর্ম গুলোতেও মূর্তি নির্মাণ ও পূজা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। যেমন ইহুদি ধর্ম দর্শন সম্পর্কে তাদের তাওরাত দ্বিতীয় বিবরণীতে বলা হয়েছে: "ভ্রষ্ট হয়ে তোমরা নিজেদের জন্য কোন আকারের মূর্তিতে ক্ষোদিত কোন প্রতিমা নির্মাণ করো না। পুরুষ ও স্ত্রীর প্রতিকৃতি, পৃথিবীর কোন পশুর প্রতিতকৃতি,  আকাশে উড্ডীয়মান কোন পক্ষীর  প্রতিকৃতি, ভূচর কোন সরীসৃপের প্রতিকৃতি অথবা ভূমির নিচস্থ জলচর কোন জন্তুর প্রতিকৃতি নির্মাণ করিও না।"(দ্বিতীয় বিবরণ: ৪: ১৬-১৮)। ওল্ড টেস্টামেন্টের আলোকে তানাখ ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে," বিশ্ব জগতের স্রষ্টা এক, একক সত্তা, স্রষ্টা কোন বিমূর্ত ধারণার নাম নয়,  স্রষ্টা হল চিরঞ্জিব এক সত্তার নাম, তার কোন আকার নেই" ইত্যাদি। বিগত দুই হাজার বছরের মধ্যে মূলত ইহুদি ধর্মই সর্বপ্রথম একেশ্বরবাদের  প্রচার শুরু করেছিল এবং কোন  প্রকার মূর্তি নির্মাণ ও পূজা করা থেকে বিরত ছিল। তাদের ধর্মগ্রন্থ মূর্তি বানানো এবং তার পূজা করা নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও তারা বর্তমানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মত মূর্তি নির্মাণ ও পূজা না করলেও ভাস্কর্য নির্মাণ করে থাকে। তারা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে ধর্মকে আলাদা করে স্পষ্ট শিরক এবং ধর্মবিহীন একটি জাতিতে পরিণত হয়েছে। 

খ্রিস্টানগণও  প্রথমদিকে একেশ্বরবাদের অনুসারী থেকে তার  প্রচার শুরু করে। কেননা তাদের ধর্মগ্রন্থে মূর্তি ও ভাস্কর্য বানানো এবং পূজা করা পরিষ্কারভাবে নিষিদ্ধ। যেমন: "প্রচার উদ্দেশ্যে তোমরা কোন মূর্তি তৈরি করবে না, তা আকাশের কোনো কিছুর মত হোক বা মাটির উপরকার কোন কিছুর মত কিংবা জলের মধ্যকার কোন কিছুর মত হোক। তোমরা তা নির্মাণ করবে না আর সেগুলোর পূজাও করবে না, কারণ কেবলমাত্র আমি সদাপ্রভুই তোমাদের একমাত্র ঈশ্বর।" (যাত্রাপুস্তক, ২০: ৪-৫)। এ বক্তব্য দ্বারা মূর্তি এবং ভাস্কর্য দুটোকেই বোঝানো হয়েছে। "মোয়াবের স্ত্রীলোকেরা লোকদের সেখানে আসার জন্য এবং তাদের মূর্তিদের কাছে উৎসর্গে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানালো। সেই কারণে ইসরায়েলিয়গণ মূর্তিদের পূজায় যোগদান করলো। তারা উৎসর্গীকৃত দ্রব্যসামগ্রী খেয়ে সেই মূর্তিদের পূজা করল। এইভাবে ইসরাইলের লোকরা বাল-পিওরের মূর্তি পূজা শুরু করলো। তাই প্রভু তাদের ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হলেন। প্রভু মোশীকে বললেন, "এসব লোকদের সমস্ত নেতাদের নিয়ে এসো এবং তাদের প্রভুর সামনে হত্যা করো যাতে সমস্ত লোকেরা দেখতে পায়। তাহলে প্রভু ইসরাইলের সমস্ত লোকদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করবেন না।"(গণনা পুস্তক, ২৫- ১:৪)। গণনা পুস্তকের এই বক্তব্য দ্বারা মূর্তি পূজারীদের হত্যার নির্দেশের মত কঠিন হুঁশিয়ারি দেয়াা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে খ্রীষ্টানগণও তাদের ধর্মগ্রন্থের নির্দেশ অমান্য করে তাদের নবীর ও বিভিন্ন প্রাণীর মূর্তি ও দেবী নির্মাণ করে এবং তার পূজা করে থাকে।

আসমানী ধর্ম হিসেবে ইসলামও যেকোনা প্রাণীর মূর্তি বানানো ও ভাস্কর্য নির্মাণ এবং এর পূজা করা সম্পূর্ণরুপে হারাম ঘোষণা করেছে। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেন: "তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদেরকে পূজা করছো তারাতো নিছক মূর্তি। আর তোমরা একটা মিথ্যা তৈরি করছো। আসলে আল্লাহকে বাদ দিয়ে তোমরা যাদের পূজা করছো তারা তোমাদের কোন রিজিক দেয়ার ক্ষমতা রাখে না, তাই তোমরা আল্লাহর কাছে রিজিক চাও, তারই ইবাদত করো, তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো আর তোমাদের তাঁরই কাছে ফিরে যেতে হবে।" (সূরা আল আনকাবুত: ১৭)। "সে বলল, তোমরা নিজেরা খোদাই করে যেগুলো  তৈরি করো তোমরা কি সেগুলোর উপাসনা করো? অথচ আল্লাহ তোমাদেরকে এবং তোমরা যা করো তা সৃষ্টি করেছেন।" (সূরা আস সাফফাত: ৯৫-৯৬)। আল কুরআনে বর্ণিত এ আয়াতদ্বয় সুস্পষ্টভাবে মূর্তি এবং ভাস্কর্য নির্মাণ এবং তার পূজা করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। তবে পূজা না করার শর্তে প্রাণহীন কোনো বস্তুর ভাস্কর্য বানানোর ব্যাপারে কোরআন এবং হাদীসে অনুমতি পাওয়াা যায়। সূরা সাবার ১৩ নম্বর আয়াতে বড় বড় ডেগচি, থালা, ফুল, পাতা, ইত্যাদি নির্মাণের বৈধতা লক্ষ্যণীয় যা সোলাইমান (আ:) তাঁর সময়ে বানাতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এছাড়া সহীহ বুখারীর ২২২৫ নম্বর হাদিস দ্বারা প্রাণহীন গাছকে ভাস্কর্য হিসেবে বানানোর অনুমতি বলে গবেষণায় প্রমাণিত। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)  হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

মূলত: বিশ্বের প্রথম মানুষ, প্রথম নবী, প্রথম মুসলিম এবং সভ্যতা গড়ার প্রথম  কারিগর ছিলেন আদম (আ:)। তাঁর সময়ে কোন মূর্তি ও ভাস্কর্য নির্মাণ এবং তা পূজার ধারণা ছিল না। ছিল না কোন নির্মাণশৈলীও। এবং তাঁর পরবর্তী ১০০০ বছর তথা দশটি  প্রজন্মের মধ্যে মূর্তি তৈরি, পূজা কিংবা ভাস্কর্য নির্মাণের কোন সংস্কৃতি ছিল না। পরবর্তীতে তাদের মধ্য থেকে পাঁচজন জনপ্রিয় মানুষ মৃত্যুবরণ করলে  মানব শয়তান এবং জিন শয়তানের প্ররোচনায় কিছু মানুষ তাদের মূর্তি নির্মাণ করে সম্মান করতে থাকে। সেই ৫ জন মানুষের নাম হলো, ওয়াদ্দ, সুওয়াা, ইয়াগুস, ইয়াউক ও নাসর। (সূরা নূহ: ২৩)। এ সময় থেকেই মানব ও জীন শয়তানের আবেগমাখা ধোকায় পড়ে সহজ সরল মানুষগুলো প্রথমে সমাজনেতাদের ছবি আঁকে, তারপর তাতে সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এবং ক্রমান্বয়ে ছবিগুলোকে তারা পূজ্যতুল্য করে তোলে। এটা ছিল মূলত: আল্লাহর সাথে শয়তানের মহা এক চ্যালেঞ্জের বাস্তবায়ন। যেমন আল্লাহ বলেছেন: ‘আমি তোমার সরল-সত্য পথে এ লোকদের জন্যে ওঁত পেতে বসে থাকব। আমি তাদের সামনে, পিছনে, ডানে, বামে- সবদিক থেকে ঘিরে ধরব (পথভ্রষ্ট করব) এবং এদের অধিকাংশকে তুমি শোকর গুজার পাবে না।’(সুরা আল আরাফ: ১৭)। 

পথভ্রষ্ঠতার মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট হল কাউকে আল্লাহর অস্তিত্বের অংশিদার সাব্যস্ত করা। আর সেই অংশিদারিত্ব যতটুকুই হোক না কেন-সেটা দ্বারা অংশীদারিত্ব সাব্যস্ত হবে। আর আল্লাহর সাথে অংশিদারিত্ব যেহেতু সর্বনিকৃষ্ট ভ্রষ্টতা তাই ঐ অপরাধ আল্লাহ ক্ষমা করেন না। যেমন আল্লাহ বলেন: ‘যে আল্লাহর সাথে অংশিদারিত্ব স্থাপন করে তিনি তাকে ক্ষমা করেন না। এ অপরাধ ব্যতীত তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশদিারিত্ব স্থাপন করল, সে ব্যক্তি নিকৃষ্টতম ভ্রষ্টতায় নিপতিত হলো।’(সুরা নিসা: ১৬)।

উপরোল্লিখিত আলোচনার মাধ্যমে বোঝা গেল যে, পৃথিবীতে সকল ধর্মই একত্ববাদের কথা বলে। আর সকল ধর্মেই প্রাণীর মূর্তি বা ভাস্কর্য বানানো এবং তার পূজা করা হারাম এবং শিরক। ধর্ম বিষয়ক গবেষণা করলে দেখা যাবে যে পৃথিবীর সকল ধর্মই মানুষকে ধর্মের বিধান মতে চলতে বলে। কিন্তু যুগে যুগে মানুষ শয়তানের প্ররোচনায় ধর্মের বিধান মতে না চলে বরং ধর্মকে তার নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। আর ঠিক এমন অবস্থায় পৃথিবীতে গড়ে উঠেছে তিন ধরণের মানুষ। এক. ধর্মের বিধান যথাযথভাবে পালনকারি আস্তিক,  দুই. ধর্মবিহীন আস্তিক এবং তিন. ধর্ম অস্বীকারকারী নাস্তিক। ধর্মবিহীন আস্তিক এবং ধর্ম অস্বীকারকারী নাস্তিকদের জীবনাচরণ, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং বিশেষত সাংস্কৃতিক জীবন খুব কাছাকাছি এবং একে অপরের সহায়ক। এজন্য অনেকে মনে করে থাকেন মূর্তিপূজা সাধারণত হিন্দুরা করে আর ভাস্কর্যের পূজা করে সাধারণত ধর্মবিহীন আস্তিক ও ধর্ম অস্বীকারকারী নাস্তিকগণ।

এমনি করে বর্তমানে আধুনিক যুগে সকল ধর্মের মানুষই অন্যান্য বিভিন্ন ধর্মীয় বিধানকে পাশ কাটিয়ে এবং উপেক্ষা করে নান্দনিকতার নামে অনেক ধর্মহীন কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মদপান, সুদি বাণিজ্য, লিভ টুগেদার ইত্যাদি। সকল ধর্মে এ তিনটি বিষয় হারাম হলেও ইহুদি, খ্রিস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ এমনকি মুসলিমরাও এগুলোকে এখন নান্দনিকতা ও শিল্পসকর্ম হিসেবে গ্রহণ করেছে। খ্রিস্টান বিশ্বে লিভ টুগেদারের মাধ্যমে পারিবারিক প্রথা প্রায় ভেঙে গিয়েছে। পিতৃ পরিচয়হীন মানব সন্তান খ্রিস্টান বিশ্বে এখন ভরপুর। যেটা মানব জাতির জন্য মহাবিপর্যয় ছাড়া আর কিছুই নয়। এটাকে তারা কোন পাপই মনে করে না। শুধুমাত্র প্রবৃত্তি তাড়িত হয়েই এ জাতীয় একটি ধর্মীয় বিধান অমান্য করে নান্দনিকতার আস্ফালন এবং স্লোগান দিয়ে গোটা দুনিয়ার অনেক দেশে মদ পান এবং লিভ টুগেদারের মত জঘন্য দুটি কাজ বৈধতার রুপ পেয়েছে। আর প্রত্যেক ধর্মে সুদি কারবার নিষিদ্ধ হলেও তা এখন বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদার মত অবস্থা। আর এর কোনোটির  ফলাফলই যে সামাজিক, পারিবারিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে মোটেই  সুখকর নয় তা  প্রতীয়মান হচ্ছে। 

সুতরাং নান্দনিকতার নামে, প্রবৃত্তি তাড়িত হয়ে, শয়তান কর্তৃক প্ররোচিত হয়ে, রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা খরচ করে এজাতীয় কর্মকাণ্ড থেকে সংশ্লিষ্ট সকলের বিরত থাকা উচিত বলে সচেতন দেশপ্রেমিক ও ধর্মপ্রাণ মুসলিমগন মনে করেন। পৃথিবীর সকল ধর্মে বিষয়টি স্পষ্টভাবে বর্ণিত হওয়ার পরেও আমাদের দুর্ভাগ্য হল, বিশ্ববাসী দেখছে যে, শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের  বাংলাদেশ রাষ্ট্রে সরকার ও ওলামা সমাজ পরস্পর মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। এর মাধ্যমে গোটা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। কারণ একদিকে মুসলিম বিশ্বের চোখে সরকারের ধর্মহীননীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটছে আর অন্যদিকে অমুসলিম বিশ্বের চোখে বাংলাদেশে উগ্র ইসলামী শক্তির উত্থান ঘটছে বলে ধারণা জন্ম নিচ্ছে । যার কোনোটিই দেশের জন্য কল্যানজনক নয়। 

সরকারের কেউ কেউ আলিমদের ঘাড় মটকাবার হুংকার দিচ্ছে আর অন্যদিকে আলিমরা ভাস্কর্য ভাঙার প্রত্যয় ঘোষণা করছে। এ দুটির কোনটাই ইসলাম সমর্থন করে না। দুটি বক্তব্যই অগণতান্ত্রিক, দুঃখজনক ও লজ্জাজনক এবং অভদ্র্রচিত সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ যা কোনভাবেই কারো জন্য কাম্য হতে পারে না। দেশ, জাতি,  উন্নতি ও অগ্রগতির স্বার্থে উভয় পক্ষকেই সমঝোতা ও ধৈর্যধারণের মাধ্যমে সঠিক পদক্ষেপ নেয়া উচিত। কারণ একদিকে ধর্মহীনতা অন্যদিকে ধর্ম নিয়ে অতিমাত্রায় বাড়াাবাড়ির পরিণতি কোন দেশের জন্য ভালো হবে না যেটা আফগানিস্তান দুই দশক ধরে বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে আসছে।

 লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।