মহান বিজয় মাস ও নতুন প্রজন্মের প্রত্যাশা

মহান বিজয় মাস ও নতুন প্রজন্মের প্রত্যাশা

১৯৭১ সালের ১৭ ই এপ্রিল স্বাধীনতা সনদে ঘোষিত ৩ নীতির ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাতি যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, স্বাধীনতা অর্জনের পর সেই ঐক্য কেন ও কিভাবে বিনষ্ট হল? উজ্জীবিত এ ঐক্য কারা ছিন্নভিন্ন করল?

ড. মো: কামরুজ্জামান-

ডিসেম্বর মাস আমাদের বিজয়ের মাস। বাঙালি জাতির আনন্দ, আবেগ, গৌরব আর অহংকারের মাস। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপিত গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ। প্রতিবছর বাংলাদেশের সর্বত্র এদিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে বিজয় দিবস হিসেবে পালন করা হয়।  ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি তারিখে সরকারি এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এ দিনটি জাতীয় দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয় এবং সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। 

দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের ৯১,৬৩৪ জন সৈন্য ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথবাহিনীর কাছে আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী যৌথ বাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সামনে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। আত্মসমর্পণের এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী উপস্থিত ছিলেন না। তবে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের উপ সর্বাধিনায়ক ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন আব্দুল করিম খোন্দকার। 

আত্মসমর্পণ দলিলটি ছিল জেনেভা কনভেনশনের বিধি অনুযায়ী  আত্মসমর্পকারীদের সাথে মানবিক আচরণের দিকটি সুরক্ষিত। পরিপূর্ণ দলিলটি নিম্নে উল্লেখ করা হলো: "পূর্ব রণাঙ্গনে বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাহিনীর প্রধান জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তান পূর্বা লীয় সামরিক কমান্ড বাংলাদেশে অবস্থানরত সকল সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণ করতে সম্মত হলো। পাকিস্তানের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীসহ সব আধা সামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষেত্রে এই আত্মসমর্পণ প্রযোজ্য হবে। এ বাহিনীগুলো যে যেখানে আছে, সেখান থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার কর্তৃত্বাধীন নিয়মিত সবচেয়ে নিকটস্থ সৈন্যদের কাছে অস্ত্রসমর্পণ ও আত্মসমর্পণ করবে। এই দলিলে স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের পূর্বা লীয় সামরিক কমান্ড লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার নির্দেশের অধীন হবে। নির্দেশ না মানলে তা আত্মসমর্পণ শর্তের লংঘন হবে বলে গণ্য হবে এবং তার প্রেক্ষিতে যুদ্ধের স্বীকৃত আইন ও রীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

আত্মসমর্পণের শর্তাবলীর অর্থ অথবা ব্যাখ্যা নিয়ে সংশয় দেখা দিলে লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত। লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আত্মসমর্পণকারী সেনাদের জেনেভা কনভেনশনের বিধি অনুযায়ী প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান দেয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন এবং আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানী সামরিক ও আধা-সামরিক ব্যক্তিদের নিরাপত্তা ও  সুবিধার অঙ্গীকার করেছেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার অধীন বাহিনীগুলোর মাধ্যমে বিদেশি নাগরিক, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও জন্মসূত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যক্তিদের সুরক্ষাও দেয়া হবে।"(উইকিপিডিয়া)।

আত্মসমর্পণের লিখিত এ দলিলে পাকিস্তান বাহিনীর স্বাক্ষরের সাথে সাথেই বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পায়। পাকিস্তানি শোষকদের কালো রাত্রির অমানিশার ঘোর কাটিয়ে নতুন এক সুবহিসাদিকের অভ্যুদয় ঘটে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অর্জিত সোনার বাংলায় পতপত করে উড়তে শুরু করে একটি লাল সবুজ পতাকা। ১৯৫২'র ফেব্রুয়ারীতে গৌরবগাঁথার যে অধ্যায় সূচিত হযয়েছিল তার সফল সমাপ্তি হয় ১৯৭১'র ডিসেম্বর মাসের এদিনে। 

প্রতিবছর তাই পুরো ডিসেম্বর মাস বিশেষত ১৬ তারিখের এ দিনটি বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা আর ভাবগাম্ভীর্যের সাথে পালিত হয়। ভোরে ৩১টি তোপধনীর মধ্য দিয়ে শুরু হওয়াা দিনটিতে জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ বাহিনী ও বেসামরিক বিভিন্ন বাহিনী কর্তৃক আয়োজিত কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সালাম গ্রহণ করে থাকেন। আলোচনা অনুষ্ঠান, দোয়া অনুষ্ঠান, কোরআন খানি, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ইত্যাদি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সারাদিন উদযাপন করে থাকে স্বাধীনতা প্রিয় বিভিন্ন  শ্রেণী-পেশার মানুষ।

আগামী ২০২১ সালের ২৬ শে মার্চ বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে উদযাপন করবে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। ঐ অনুষ্ঠানে বিশ্ব নেতাদের কেউ কেউ উপস্থিত থাকবেন বলে জানা গেছে। বিশ্ব নেতাদের উপস্থিতিতে এই সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন নিঃসন্দেহে সামগ্রিককভাবে জাতির জন্য আনন্দের, গৌরবের, অহংকারের ও আবেগের। কিন্তু এই সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের পূর্বক্ষণে তথা ৪৯ তম বিজয়ের মাসে ১৯৭১ এর পরে জন্ম নেয়া অসংখ্য তরুণের মনে কিছু প্রশ্ন, কিছু ভাবনা ও কিছু প্রত্যাশা রয়ে গেছে। যে তরুণেরা তাদের মায়ের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনেছে, শুনেছে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতা, মানবিকতা, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও দেশেেপ্রমে আত্মোৎসর্গের কথা। শুনেছে তাদের শৌর্য-বীর্যে গাঁথা গৌরবের গল্প। তারা শুনেছে পাকিস্তানিদের অবর্ণনীয় ও অমানবিক নিষ্ঠুরতা, পাশবিকতা আর নির্যাতনের লোমহর্ষক ঘটনাবলি। তরুণেরা ইতিহাসের পাতা থেকেও বিভিন্ন আঙ্গিকে পড়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথার গল্প-কাহিনী। আর এতে তাদের মনে সৃষ্টি হয়েছে কিছু প্রশ্ন, ভাবনা আর প্রত্যাশা। যে প্রশ্ন আর ভাবনাগুলোর জবাব আজও তাদের অজানা। আগামী ১৫-২০ বছরের ব্যবধানে হয়ত দেশে কোনো মুক্তিযোদ্ধা আর বেঁচে থাকবেন না। রণাঙ্গনে সরাসরি নেতৃত্বে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের আর হয়তো দেখা যাবে না দেশে। তখনো এই প্রশ্নগুলো আগামীর প্রজন্মকে আরো বেশি বিদ্ধ করবে।

১৯৭১ সালের ১৭ ই এপ্রিল স্বাধীনতা সনদে ঘোষিত ৩ নীতির ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাতি যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, স্বাধীনতা অর্জনের পর সেই ঐক্য কেন ও কিভাবে বিনষ্ট হল? উজ্জীবিত এ ঐক্য কারা ছিন্নভিন্ন করল? আর সুদীর্ঘ ৫ দশকেও সেই ঐক্য কেন আর ফিরে এল না? তরুণ প্রজন্ম এ প্রশ্নের জবাব চায়। স্বাধীনতার ৪৯ তম বিজয়ের মাসে এ প্রশ্ন আরো প্রকট হয়ে দেখা দিল বিজয় দিবসের প্রত্যুষে দেশের বিভিন্ন স্থানে স্মৃতিসৌধ ও বেদীতে ফুল দিতে আসা নিজদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধার দৃশ্যে। স্মৃতিসৌধে এবং বেদীতে দিতে আসা অঞ্জলী অসম্মানজনকভাবে নিজদলীয় নেতা ও কর্মী কর্তৃক পদদলিত হলো। এখানে জাতীয় ঐক্যতো দূরের কথা দলীয় ঐক্যও একাধিক ধারায় বিভক্ত বলে প্রমাণিত হলো। অথচ এই মানুষগুলোর মুখেই উচ্চারিত হয় মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ও চেতনার জয়গান। এ সমস্ত লোকেরাই সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে ও সমাজ উন্নয়নের লক্ষে কাজ করে। নতুন প্রজন্মের কাছে এটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। তাদের কাছে এটা চেতনার নামে স্বার্থপরতা, বিজয়ের দিনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা আর  প্রহসন ছাড়া অন্য কিছুই নয়। বর্তমান প্রজন্ম কোনভাবেই বিষয়টি মেনে নিতে পারে না। আর এ সমস্ত ব্যক্তিবর্গের দেয়া বক্তব্য, বিবৃতি, ভাষণ ও নেতৃত্ব তাদের কাছে সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধের সূর্য সৈনিকেরা দেশে বেঁচে থাকতে যদি হারিয়ে যাওয়া সেই জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্টিত না হয় এবং ফিরে না আসে তাহলে বাংলাদেশের আগামী দিনগুলোর দশা কী হবে? জাতীয় ঐক্য ব্যতিরেকে দেশের আগামীদিনের উন্নতি, অগ্রগতি ও উন্নত রাষ্ট্রের লক্ষ্যপানে পৌঁছানো কি সুদূর পরাহত ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে না?

দেশে কোনো অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটলেই স্বাধীনতাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তিকে দায়ী করা হয় এবং কোন ধরনের প্রমাণ ও বিচার ছাড়া তাদের উপর বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালানো হয়। অথচ যুদ্ধের সময় তাদের কোন ধরনের শক্তি হিসেবে বিবেচনায় আনা হয়নি। কারণ এ বিরোধী অংশটি ছিল অতিকায় ক্ষুদ্র। অথচ স্বাধীনতার পাঁচ দশকে এসে দেশনায়কদের মুখে, টেলিভিশন ব্যক্তিত্বের মুখে, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের মুখে, রাজনীতিবিদদের মুখে স্বাধীনতার এ ক্ষুদ্র গোষ্ঠীটিকে বক্তৃতার ভাষায় বৃহৎ আকারে প্রকাশ করা হয়। এছাড়া বুদ্ধিজীবী, কলামিস্ট, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের মুখ ও লেখনি থেকে একই আওয়াজ শোনা যায়। এশক্তিটির বিপক্ষে আওয়াজ তুলে জোরেশোরে ফলাও করে মিডিয়ায় প্রচার করা হয়। এখন প্রশ্ন হলো, স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি যদি সত্যিই বর্তমানে রাষ্ট্রবিরোধী ও দেশের  সংবিধান বিরোধী  কর্মকাণ্ড চলমান রাখে তাহলে এতদিনে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হলো না কেন? এ অপশক্তির বিরুদ্ধে আইনগত কোন ব্যবস্থা না নিয়ে বরং নিজেরা ক্ষমতায় যাবার আর ক্ষমতায় গিয়ে তা পাকাপোক্ত করতে তাদেরকে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করা হলো। তরুণ প্রজন্ম এই অসঙ্গতিপূর্ণ কমর্কাণ্ড কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। তারা মনে করে, এগুলো স্ববিরোধীতা, স্বার্থপরতা ও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার ও ক্ষমতায় যাবার কুটকৌশল ছাড়া আর কিছু নয়। সুতরাং রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও উন্নত রাষ্ট্র প্রতিষ্টার স্বার্থে এসমস্ত অসঙ্গতিপূর্ণ কর্মকাণ্ড দ্রুততার সাথে বন্ধ ও সমাধান হওয়া দরকার।

স্বাধীনতার ৪৯ তম বিজয়ের মাসে যদি আমরা পিছনে ফিরে তাকাই তাহলে মনে হবে আমরা অনেক দূর এগিয়ে এসেছি। আর যদি সামনের দিকে তাকাই তাহলে মনে হবে আমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছি। বিবিএস এর তথ্য অনুযায়ীী,  ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৬৭১ টাকা। আর বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এক লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এটা অনেক ভালো খবর। কিন্তু গবেষকগণ বাংলাদেশের আয় বৈষম্যের চিত্র দেখে রীতিমতো হতাশা প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ সবেমাত্র স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের প্রবেশ দ্বারে পা দিয়েছে। কিন্তু ইতোমধ্যেই এদেশে ধনী ব্যক্তির সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি  পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা 'ওয়েলথএক্স' এক গবেষণায় বলেছে যে, গত এক দশকে ধনী ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধির হারে শীর্ষে থাকা ১০ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এক নম্বরে অবস্থান করছে। অর্থাৎ পৃথিবীতে ধনী ব্যক্তির সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে এমন দেশ দশটি। তন্মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। আর ধনী হওয়ার এই সংখ্যাটা খুবই মুষ্টিমেয়। রাজনৈতিক মদদপুষ্ট কতিপয় অসাধু ব্যক্তির কাছে সম্পদ পুঞ্জিভূত ও কুক্ষিগত হচ্ছে। সিংহভাগ মানুষ সামগ্রিক উন্নয়নের সুফল ভোগ করা থেকে বিঞ্চত হচ্ছে। ধনীরা ক্রমান্বয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ছে। এবং সম্পদ গড়ার এই ধারাবাহিকতা অতীতে শুরু হয়ে বর্তমানেও চলমান আছে। অন্যদিকে গরিবেরা দিন দিন আরও বেশি গরিব এবং অসহায় হচ্ছে এবং এই গরীব হওয়ার ধারাবাহিকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি বিষয়ক এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, বর্তমানে বাংলাদেশের ১৬ কোটি ৪৬ লাখ মানুষের মধ্যে ১০ কোটি ৫৫ লাখ মানুষই দরিদ্র। নব্বইয়ের দশকে যে সংখ্যা ছিল ৬ কোটি। তার মানে গত ৩০ বছরে বাংলাদেশের দরিদ্র জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৪ কোটি ৫৫ লাখ। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবমতে, বাংলাদেশে ২০০৮ সালে ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা ছিল ৪৫ লাখ। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ থেকে ৮০ লাখ। আর ২০২১ সালে সেই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ৮৫ লাখে। আর নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে বাংলাদেশে গৃহহীন হয়েছে প্রায় ৬৮ লক্ষ মানুষ। আর প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়ে গৃহহীন হয়ে থাকে অগণিত মানুষ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, শুধুমাত্র ঘূর্ণিঝড় আইলাতেই গৃহহীন হয়েছে প্রায় ১৩ লক্ষ মানুষ। এ মানুষগুলোর নিজস্ব কোন জমি নাই। রাস্তার পাশে, বেড়িবাঁধের উপর খড়, নাড়া, বাঁশ ইত্যাদি দিয়ে ঝুপড়ি বেঁধে কোনরকম জীবন অতিবাহিত করেন। আবার এর মাঝেও সর্বক্ষণ উচ্ছেদ আতঙ্কে দিন কাটাতে হয় তাদের। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করেন এমন গবেষকদের মতে, বাংলাদেশের প্রায়  ৪ কোটি পরিবার আছে। এর মধ্যে প্রায় ৩ কোটি পরিবার বাস করে গ্রামে। আর এক কোটির বেশি পরিবার বসবাস করে শহরে। গ্রামে বসবাসরত মানুষের মধ্যে শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ মানুষ কাঁচা ঘরে বসবাস করে। এদের শতকরা ৬৫ ভাগ মানুষই স্বাস্থ্য, সেনিটেশন ও বৈদ্যুতিক সেবা থেকে বিঞ্চত। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪৫ ভাগই শিশু। তন্মধ্যে ১২ লক্ষ শিশু আছে যাদেরকে টোকাই বা পথশিশু বলা হয়। সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ১৩ লক্ষ শিশুর শীতের কাপড় নেই। প্রায় ৬ লক্ষ শিশু অসুস্থ হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকলেও তাদের দেখার কেউ নেই। ৫ লক্ষাধিক শিশুর ঘর ও বিছানা নাই। প্রায় পাঁচ লক্ষ শিশু গোসলের ব্যবস্থা নেই এবং তারা গোসল করতে পারে না। এ আলোচনার বাইরে থাকা অসংখ্য বনি আদমের খবর কেউ রাখেই না।

এসব হতদরিদ্র মানুষের কাছে ভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, তোপধ্বনি, জাঁকজমকপূর্ণ কুচকাওয়াজ ইত্যাদি কতটা অর্থবহ হতে পারে সেটা ক্ষমতাবান টাকাওয়ালা রাজনীতিবিদ আর চেতনার কারবারিরা কখনো বুঝতে পারবেন না। বিজয় উৎসব শেষে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে আয়োজিত রাজকীয় ভোজসভায় যখন চলে রসনা বিলাসের প্রতিযোগিতা, ঠিক তখন তাদের উচ্ছিষ্ট খাবারগুলো ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে খাচ্ছে এ জাতীয় অসহায় অনাহারী মানুষগুলো। পশুর সাথে ভাগাভাগি করে নিচ্ছে তারা এসব ফেলে দেয়া খাবারগুলো। এসমস্ত অসহায় মানুষগুলোর কাছে এ বিজয় উৎসব, স্বাধীনতা উৎসব ইত্যাদি বিলাসিতা ছাড়া কিছুই না। তরুণ প্রজন্ম এই অসঙ্গতিপূর্ণ কর্মকাণ্ডগুলোকে উন্নত রাষ্ট্র ব্যবস্থার অন্তরায় হিসেবে মনে করছে।
 
বাংলাদেশের বর্তমান লক্ষ্য মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা এবং ধাপে ধাপে সেটাকে উন্নত রাষ্ট্রে উন্নীত করা। আর এটা করতে রাষ্ট্রের প্রয়োাজন দারিদ্র্য দূর করা, আয় ও ব্যয়ের বৈষম্য দূর করে স্বাধীনতার সনদে উল্লেখিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও রাষ্ট্রের সর্বত্র ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু বাস্তব অবস্থা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। দারিদ্র্য পীড়িত, ক্ষুধায় ক্লিষ্ট, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত দেশের কোটি কোটি নাগরিক যখন দিশেহারা ঠিক তখনই উদিত শত দুঃখের এদেশে ধনী মানুষের উত্থানের গল্প রীতিমতো হতবাক করেছে এই তরুণ প্রজন্মকে।  

bn.quora.com এর ভাষ্যমতে, এদেশে এমন মানুষও আছে পশ্চিমাদের কাছে যিনি বাংলাদেশের প্রিন্স ও মিলিয়নিয়ার (ধনকুবের) হিসেবে পরিচিত। যিনি ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারকে ৫০ লাখ পাউন্ড অনুদান দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ঘোষণা দিয়েছিলেন আয়ারল্যান্ডের ঐতিহাসিক কালকিনি দুর্গ ক্রয় করে ব্যবসা-বাণিজ্যের সদরদপ্তর বানানোর। ৫১ হাজার কোটি টাকা যার বাজেয়াপ্ত হযয়েছিল সুইস ব্যাংক থেকে। যিনি দুদকে হাজিরা দিয়েছিলেন চার নারী নিরাপত্তাকর্মীসহ ৪০ জন ব্যক্তিগত দেহরক্ষী নিয়ে। তরুণ প্রজন্মের কাছে জাতির সাথে এটি একটি প্রহসন, বিদ্রুপ আর ঠাট্টা ছাড়া আর কিছু নয়। তার ব্যবহৃত ঘড়িটার দাম ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। ব্যবহৃত কলমটির দাম ১০ লাখ মার্কিন ডলার। ঐ কলমটিতে ৭৫০০ টি হীরকখণ্ড ব্যবহার করা হয়েছে। আর ওটা সংরক্ষণের জন্য সুইস ব্যাংকের একটি ভোল্ট ব্যবহার করা হয় এবং ওই কলম ছাড়া কোনভাবেই তিনি অন্য কোন কলম দ্বারা স্বাক্ষর করেন না। তিনি যেকোনো অনুষ্ঠানে যোগদান করতে ৭০ লাখ ডলার মূল্যের গহনা পরিধান করেন। কখনো তাকে এক স্যুট পরা অবস্থায় দ্বিতীয়বার দেখা যায়নি। তার পরনের স্যুটগুলো স্বর্ণসূতাখচিত এবং এর প্রতিটি সেটের মূল্য পাঁচ থেকে ছয় হাজার পাউন্ড। তার ব্যবহৃত জুতাটি হীরকখচিত এবং প্রতি জোড়া জুতার মূল্য ১ লাখ মার্কিন ডলার। গোলাপের পানি ছাড়া তিনি গোসল করেন না। আর বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পানি পান করেন। হ্যাঁ, গল্পটি আরব্য রজনীর কোনো কাল্পনিক ইতিহাস নয়, এটি বাংলাদেশের একজন বড় ও বিখ্যাত অস্ত্র ব্যবসায়ীর গল্প। উইকিপিডিয়ার ভাষ্যমতে, তিনি একজন আন্তর্জাতিক অস্ত্র ব্যবসায়ী হিসেবে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক পরিচিত। তিনি বর্তমানে ড্যাটকো গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালী এক সাংসদের বিয়াই তিনি। ডাক্তার এম এ হাসান তার লিখিত 'পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী' বইতে লিখেছেন, এই ব্যক্তি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ছিলেন মুক্তিকামী মানুষের আতঙ্ক। তিনিই হচ্ছেন বর্তমান বাংলাদেশের সবচেয়ে সেরা ধনী। তার মোট অর্থের পরিমাণ ১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ৯৬ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া বাংলাদেশে বিশ্বের ধনীদের তালিকায় আরো ১০-১২ জনের নাম সংযুক্ত হয়েছে। যাদের আয়ের উৎস অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনেকটাই অস্পষ্ট। তরুণ প্রজন্ম যখন তাদের শিক্ষাজীবন শেষে অনিশ্চিত কর্মজীবনের শঙ্কায় দিশেহারা তখন এজাতীয় বিলাসিতার গল্প ও দৃশ্য তাদেরকে ভিতর থেকে বিদ্রোহী করে তোলে। বাস্তবতার কাছে নিজেদেরকে দারুন অসহায় আর নিঃস্ব মনে হয়। বিবেকের কষাঘাতে অতিষ্ঠ ও পরাজিত হয়ে তারা তখন বিভিন্ন বাঁকা পথের আশ্রয় নেয়। তারা ভাবতে শুরু করে, লেখাপড়া করে আর কী হবে? অতঃপর তারা রাজনৈতিক বড় ভাইদের ভাড়াটে গুন্ডা, নিষ্ঠুর দলবাজ এবং জাতি ও সমাজের জন্য ভয়ঙ্কর হিংস্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭১ সালে সরাসরি রণাঙ্গনে উপস্থিত থেকে যারা সরাসরি স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন তরুণ প্রজন্ম এসকল ভয়াবহতা আর অসঙ্গতিগুলো সমাধানকল্পে তাদের ভূমিকা কামনা করছে। কারণ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কোন নেতা যখন আর এদেশে বেঁচে থাকবেন না তখন দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্রে রূপ নিতে পারে।

স্বাধীনতাযুদ্ধের এতদিনেও দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের তালিকা ও নারী মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা জাতির সামনে প্রকাশ হলো না। বরং উল্টো অসংখ্য ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ভুয়া সনদ নিয়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলো। অথচ বাংলার আনাচে কানাচে পড়ে আছে অসংখ্য প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাদের মুখে দিনে একবার অন্ন জুটেনা। তারামন ও কাঁকন বিবির মতো অসংখ্য নারী মুক্তিযোদ্ধা জীবন পার করছে এই বিলাসী জীবনযাপনকারী ব্যক্তিদের ডাস্টবিনে নিক্ষিপ্ত উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে, যাদের খবর কেউ রাখে না। পশুর সাথে সে উচ্ছিষ্ট ভাগাভাগি করে খাচ্ছে অনেক অসহায় মানুষ। একটি স্বাধীন দেশে এটা কখনোই কাম্য হতে পারে না বলে তরুণ প্রজন্ম মনে করে।

তরুণ প্রজন্ম  ৪৯ তম বিজয়ের শেষ প্রহরে আরও আশা করে যে, জাতীয় সকল ইস্যুতে পুরা বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হোক। স্বাধীনতার সুফল জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই সমানভাবে ভোগ করুক। কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠী এবং ব্যক্তির মাঝে তা কুক্ষিগত না থাকুক। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয়স্বাধীনতা পরিপূর্ণভাবে সুরক্ষিত থাকুক। ক্ষয়িষ্ণু লক্ষ্য আর নিশ্চল গণতন্ত্রে ফিরে আসুক গতিশীলতা। সুরুচি আর শালীনতা ফিরে আসুক রাজনৈতিক শব্দচয়নে। দূর হোক অশালীন আর কুরুচিপূর্ণ বাক্য বিনিময়। সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর ন্যায়পরায়নতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাঙালি জাতির জীবনে ফিরে আসুক হারানো আত্মবিশ্বাস, আত্মনির্ভরশীলতা ও মর্যাদাবোধ। নতুন করে জাগ্রত হোক জাতীয়তাবোধ, বলিষ্ঠ জীবনবোধ আর মানবতাবোধ।

লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।