কাশ্মীরে যুদ্ধ সম্ভাবনা

কাশ্মীরে যুদ্ধ সম্ভাবনা

ফাইল ছবি।

যতদূর মনে পড়ছে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময়, শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর কোন একটি নির্বাচনী বক্তৃতায় বলেছিলেন, তিনি কাশ্মীর সমস্যার সমাধান চান, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে, গণ অভিমত গ্রহণের মাধ্যমে। অতীতে আওয়ামী লীগ কখনই বলেনি কাশ্মীর ভারতের অংশ। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জহরলাল নেহেরু কাশ্মীর সমস্যাকে নিরাপত্তা পরিষদে (security council) নিয়ে যান। ফলে কাশ্মীরে যুদ্ধ বিরতি ঘটে। নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের ফলে ভারত-পারিস্তানের মধ্যে স্থির হয় একটি যুদ্ধ বিরোধী রেখা। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৭ সালের মধ্যে নিরাপত্তা পরিষদ পাঁচবার প্রস্তাব করে কাশ্মীরে গণ-অভিমত (plebiscite) গ্রহণের। কিন্তু ভারত সরকার তা করতে চায় না। ১৯৫৭ সালের ২৬ জানুয়ারী ভারত সরকার নিরাপত্তা পরিষদের বিরোধীতা সত্ত্বেও কাশ্মীরকে ভারতের অংশ বলে ঘোষণা করে। এটা ছিল খুবই একতরফা সিদ্ধান্ত। সাবেক কাশ্মীর রাজ্যের একটি প্রদেশের নাম ছিল লাদাখ। এই লাদাখ অঞ্চল একসময় ছিল তিব্বতের অংশ। এখানকার মানুষ তিব্বতীদের মত দেখতে। এরা তিব্বতী ভাষায় কথা বলে। ধর্মে এরা হিন্দু নন। তিব্বতীদের মতই লামা-বৌদ্ধ। জম্মুর রাজা গুলাব সিং ডোগরা লাদাখ অঞ্চল জয় করেন ১৮৩৪ থেকে ১৮৪০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে। চীন ১৯৬২ সালের ডিসেম্বর মাসে এই লাদাখ অঞ্চলের ১২০০০ বর্গমাইল জায়গায় যুদ্ধ করে দখল করে নিয়েছে। এখন সাবেক কাশ্মীর রাজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে তিনটি রাষ্ট্রের স্বার্থ : ভারত, পাকিস্তান ও চীন। কাশ্মীর সমস্যা আর হয়ে নাই কেবলই ভারত-পাকিস্তান সমস্যা।

ভারত পাকিস্তানকে ভয় দেখাচ্ছে পারমাণবিক অস্ত্রের। কিন্তু এখন পারমাণবিক অস্ত্র পাকিস্তানের হাতেও আছে। আর পাকিস্তান নির্মাণ করতে পারছে তা বহন করবার উপযোগী রকেট। যার সাহায্যে সে আঘাত করতে পারে ভারতের যেকোন অংশে। এছাড়া চীনের হাতে আছে পরমাণু, হাইড্রোজেন ও নিউট্রন বোমা। ভারত কেন পাকিস্তানকে পারমানবিক যুদ্ধের ভীতি প্রদর্শন করছে, সেটা বোঝা দুষ্কর। কেননা, যুদ্ধে পারমানবিক অস্ত্রের প্রয়োগ ঘটলে তাতে ভারতই বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। অন্যদিকে ভারতের রাজনীতি ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। ১৯৪৭ সালে শিখরা ছিলেন হিন্দুদের পক্ষে। কিন্তু এখন শিখরা চাচ্ছেন স্বাধীন হতে। ভারত-পারিস্তান যুদ্ধ বাধলে শিখরা মনেহয় পাকিস্তানের পক্ষই গ্রহণ করবেন। শিখ অধ্যুষিত পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলার মধ্যে দিয়ে ভারত সরকার এখন কাশ্মীরে সৈন্য, অস্ত্র ও রসদ সহজেই বহন করতে পারছে। কিন্তু ভবিষ্যতে তা আর পারবে বলে মনে হয় না। কাশ্মীরে যুদ্ধ করা তাই ভারতের পক্ষে আগের তুলনায় অনেক কঠিন হয়েই পড়বে। পাক-ভারত যুদ্ধ আশু বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে না কাশ্মীর নিয়ে একটা যুদ্ধ বাধুক। কিন্তু তথাপী ভারত যদি আজাদ কাশ্মীরে সামরিক অভিযান বন্ধ না করে তবে একটা ভয়াবহ যুদ্ধ আরম্ভ হতেও পারে।

রাশিয়ার সবচেয়ে বড় অস্ত্রের বাজার হলো ভারত। কিন্তু রাশিয়া কাশ্মীর সমস্যার ক্ষেত্রে এখন আর জড়াতে চাচ্ছে না। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল ১৫টা রিপাবলিক নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে রাশিয়া ছিল সবচেয়ে উন্নত ও সামরিক দিক থেকে অগ্রসর। কিন্তু ১৯৯১ খৃষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গিয়েছে। এখন ১৫টা রিপাবলিক পরিণত হয়েছে পৃথক পৃথক প্রজাতন্ত্রে। কেবল তাই নয়, ইউক্রেন এর সঙ্গে রাশিয়ার হচ্ছে যুদ্ধ। সোভিয়েত ইউনিয়ন এর ১৫ টা রিপাবলিকের মধ্যে ছয়টি ছিল মুসলিম অধ্যুষিত। এরা হলো: আজারবাইজান, উজবেকিস্তান, কাজাকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান এবং কিরিঘিজিয়া। এই ছয়টি রাষ্ট্রই এখন পাকিস্তানের প্রতি হয়ে উঠেছে বিশেষ মৈত্রী ভাবাপন্ন। সারা মুসলিম বিশ্বে, কেবল বাংলাদেশ সরকার ছাড়া, আর রাষ্ট্র বলছে কাশ্মীর হলো আন্তর্জাতিক সমস্যা।

কাশ্মীরের ইতিহাস অনুশীলন করলে আমরা দেখি একসময় কাশ্মীর বলতে বোঝাত কেবল ঝিলম নদীর উত্তর পাশে অবস্থিত উপত্যকাকে। যা হলো দৈর্ঘ্যে ৮৫ মাইল ও প্রস্থে ২০ থেকে ২৫ মাইল। এখানে হিন্দু রাজারা রাজত্ব করতেন। খৃষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে সোয়াত থেকে শাহ্ মির্জা অথবা মীর নামক জনৈক ব্যক্তি কাশ্মীরে যান হিন্দু রাজার কাছে চাকুরী করতে। তিনি তার যোগ্যতার বলে হন কাশ্মীরের রাজার প্রধান মন্ত্রী। রাজার মৃত্যু হলে তিনি হন কাশ্মীরের প্রথম সুলতান। তিনি মৃত রাজার বিধবা রাণীকে বিবাহ করেন। কাশ্মীরের এই পৃথক সালতানাত চলেছিল ১৫৮৬ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ও সম্রাট আকবর ওই সালে কাশ্মীর দখল করেন। মুঘল সম্রাজ্যের পতনের যুগে পাঞ্জাবের শিখ রাজা রণজিৎ সিং কাশ্মীর দখল করেন ১৮২০ খৃষ্টাব্দে। আর তার ডোগরা সেনাপতি গুলাব সিং জয় করেন এখন যা পরিচিল জম্মু হিসাবে। পাঞ্জাবী ভাষার তিনটি উপভাষা আছে। লহন্দা, পাঞ্জাবী ও ডোগরা। ডোগরারা একসময় ডোগরা ভাষায় কথা বলতেন। কিন্তু বর্তমানে কথা বলেন হিন্দী ভাষায়। এরা ধর্মে হলেন হিন্দু। ১৮৪৭ খৃষ্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কাশ্মীর দখল করে। গুলাব সিং এই যুদ্ধে থাকেন নিরপেক্ষ। পরে তিনি প্রায় ১০ লক্ষ পাউন্ড প্রদান করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে থেকে কাশ্মীর কিনে নেন এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে পরিণত হন একজন করদ-মিত্র রাজায়। গুলাব সিং বংশের রাজা রণবীর সিং ১৯৪৭ সালে ভারতে যোগ দেন। সৃষ্টি হয় পাক-ভারত কাশ্মীর সমস্যার। পরে ১৯৬২ সালের ডিসেম্বর মাসে চীন লাদাখ অঞ্চলের ভূখন্ড দখল করলে, চীন জড়িয়ে পড়ে কাশ্মীর সমস্যার সঙ্গে। আমাদের দেশের নীতি নির্ধারকরা কি করি কাশ্মীর সমস্যাকে কেবল ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসাবে গণ্য করছেন, সেটা বোঝা তাই দুষ্কর হয়ে পড়েছে।

খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান এর মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরা বলতেন, কাশ্মীরের উচিত হবে ভারতের সঙ্গে থাকা। কারণ, ভারত হলো একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্র। কিন্তু ভারতের রাষ্ট্রিক ক্ষমতা বর্তমানে যেয়ে পড়েছে হিন্দুত্ববাদী বিজেপির হাতে। যাঁরা এখন গ্রহণ করতে চাচ্ছেন কতকটা হের হিটলার এর আর্যবাদের তত্ত্বকে। ভাবা গিয়েছিল, নরেন্দ্র মোদি হিন্দুত্ববাদের কথা বললেও অনুসরণ করবেন অটল বিহারী বাজপেয়ীকে। যিনি ছিলেন একজন মধ্যপন্থী নেতা। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী এখন যেন অনুসরণ করতে যাচ্ছেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (RSS) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মহাদেব সদাশিব গোলওয়ারকারকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গোলওয়ারকার হের হিটলারকে আন্তরিকভাবে সমর্থন জানিয়েছিলেন বৃটেনের বিপক্ষে। দিল্লীতে বিজেপি ৭০০ কোটি টাকা ব্যয় করে অফিস বানাল। ভারতের রাজনীতিতে বিজেপি কতদিন থাকবে, সেটা কেউ বলতে পারছেনা। একসময় ভাবা হতো, আর্যরা উত্তর ভারতে এসেছিলেন বাইরে থেকে। কিন্তু এখন বিজেপির পন্ডিতরা প্রমাণ করতে চাচ্ছেন, আর্যরা এই উপমহাদেশের বাইরে থেকে এসেছিলেন না। তাঁরা ভারত থেকেই ছড়িয়ে পড়েছিলেন বাইরের বিশ্বে। বিজেপির পন্ডিতরা ইতিহাসকে লিখতে চাচ্ছেন সম্পূর্ণ নতুন করে।

১৯৬০ সালে বিশ্ব ব্যাংকের মধ্যস্থতায় হতে পেরেছিল ভারত-পাকিস্তান সিন্ধু নদের পানি বন্টন চুক্তি (Indus Waters Treaty) । পাকিস্তান এই চুক্তির উপর নির্ভর করে আজাদ কাশ্মীরের মিরপুর জেলায় ১৯৬৭ সালে ঝিলাম নদীর উপরে গড়েছে মঙ্গলা ড্যাম। কিন্তু ভারতের বিজেপি সরকার মানতে চাচ্ছে না সিন্ধু নদের পানি বন্টন চুক্তি। সিন্ধু নদের পানি বন্টন চুক্তি না মানলে পাক-ভারত যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠবে।