নতুন বছরে নতুনদের চাওয়া

নতুন বছরে নতুনদের  চাওয়া

ড. মো: কামরুজ্জামান

ড. মো: কামরুজ্জামান-

৩১শে ডিসেম্বর ২০২০। ঘড়ির কাটায় তখন রাত বারোটা। অর্থাৎ জিরো আওয়ার। বেজে উঠলো ঘটনাবহুল ২০২০ সালের বিদায় ঘন্টা। বিশ্ববাসীর কাছ থেকে চলে গেল ২০২০ সাল। কালের গহ্বরে হারিয়ে গেলো একটি বছর। প্রত্যেকের জীবন থেকে চলে গেল একটি বারো মাস। আর বাংলাদেশের আকাশ থেকে চলে গেল পঞ্চশতম ডিসেম্বর মাস। বাংলাদেশের বয়স গিয়ে দাঁড়ালো ৫০তম বছরে। আর ঠিক রাত ১২ টা ০১ মিনিটে সূচনা হলো নতুন বছরের। যাত্রা শুরু ২০২১ সালের। বাংলার ফাগুনের আগুন তরুণ-তরুণীরা আর যুবক-যুবতীরা মেতে উঠল নতুন বছরকে বরণ করতে। ঐতিহ্যবাহী বাংলাকে ক্ষণিকের জন্য ভুলে গিয়ে বিশ্ববাসীর ন্যায় বাঙ্গালিরাও ইংরেজি নতুন বর্ষকে বরণ করে নিল উচ্ছ্বাসের সাথে। আর এই বরণ করে নিতে সরকারকে গ্রহণ করতে হলো নানা সতর্কতামূলক পদক্ষেপ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নজরদারিতে পালিত হলো বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। বিদায়২০২০। স্বাগত ২০২১! ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ আর টুইটারে হ্যাপি নিউ ইয়ার-শুভ নববর্ষ মেসেজসহ মন ছুঁয়ে যাওয়া নানারকম বার্তার ছড়াছড়ি। 

"পূরনো কষ্ট, করে ফেলো নষ্ট। নববর্ষের আনন্দ, মনে জাগুক বসন্ত। স্বপ্ন হোক জীবন্ত, ২০২১ এর আনন্দ হোক অফুরন্ত। আমি আছি বহুদূর, তোমার জীবন থাকুক আনন্দে ভরপুর। '২১ এর সকালের আলো, বাঙালির জন্য হোক ভালো। মিটে যাক পঙ্কিলতা, ধুয়ে যাক সব মলিনতা। ফুল ফুটুক বসন্তের, শুভ হোক সকলের! হ্যাপি নিউ ইয়ার ২০২১! May this new bring you much joy and fun. May you find peace, love and success! Happy new year 2021! " ইত্যাদি নতুন বছরের শুভেচ্ছা ভার্চুয়াল মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ল প্রান্ত থেকে প্রান্তরে আর দেশ থেকে দেশান্তরে। 

এতসব আয়োজনের মধ্যেই নতুন ৬ হাজার ৭০ জন আগন্তুকের আগমন ঘটল বাংলায়। আগের দিন জিরো আওয়ার থেকে পরেরদিন জিরো আওয়ার পর্যন্ত অর্থাৎ ৩০ শে ডিসেম্বর রাত ১২ টা থেকে ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২ টা-এ ২৪ ঘন্টায় বাংলাদেশের জনগণের সাথে যুক্ত হল ৬ হাজার ৭০ জন নতুন শিশু। (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০২০)। এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ৬ হাজার ৭০ জন শিশু জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু এ নতুন শিশুদের জন্য রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে কোন বাজেট বরাদ্দ থাকে না। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে যে, প্রতিটি শিশু ৬০ হাজার টাকা ঘাটতি বাজেট নিয়ে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে। প্রতিবছরই নতুন বর্ষবরণে বিদায়ী বছরের গ্লানিকে ধুয়েমুছে সোনালী রবির সকালের প্রত্যাশা কামনা করে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে থার্টি ফার্স্ট নাইট পালিত হয়ে থাকে। বছর যায়, বছর আসে কিন্তু এই শিশুদের জন্য কোন সোনালী সকাল আসে না। সমাজ ও রাষ্ট্রকে তাদের জন্য বাস্তবধর্মী ও কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। তাদের জন্য কোন রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক বরাদ্দ আজও পর্যন্ত লিপিবদ্ধ হয়নি। শিক্ষা, খাদ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান, বস্ত্র ইত্যাদি মৌলিক চাহিদা ও অধিকারগুলো উন্নত রাষ্ট্রে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে শিশুরা পূর্ণমাত্রায় ভোগ করতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে শিশুরা এসব চাহিদা ও অধিকার থেকে সম্পূর্ণভাবে বি ত। উইকিপিডিয়ার ভাষ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪৬ লাখ। তন্মধ্যে তরুণ-তরুণীর সংখ্যা প্রায় ৮ কোটি এবং এদের প্রত্যেকের বয়স ২৪ বছরের নিচে। আর মোট জনসংখ্যার ৪৫ ভাগ তথা প্রায় ৭ কোটি শিশু এবং তাদের সকলের বয়স ১৮ বছরের নিচে। 

লোকাল এডুকেশন এন্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট এর হিসেবমতে, বাংলাদেশে প্রায় ২০ থেকে ২৫ লাখ শিশু আছে যাদেরকে পথশিশু বলা হয়। এসব শিশু অভাবের তাড়নায় এবং ভেঙ্গে যাওয়া পরিবার থেকে বেরিয়ে আসা। এছাড়া নদী ভাঙ্গনের কারণে গৃহহীন হয়ে চলে আসা অনেক শিশুদের ঠিকানা হচ্ছে পথ। ওদের কোন বাড়িঘর নেই। নির্দিষ্ট জায়গা জমি নেই। এরা রাত কাটায় বাস স্টেশন, রেল স্টেশন অথবা পার্ক, রাস্তা কিংবা খোলা জায়গায়। এরা পথশিশু। এরা পথেই থাকে। পথেই জীবিকা নির্বাহ করে। এদের সকলের বয়স ৫ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। এদের মধ্যে অনেকে বিনা চিকিৎসায় রাস্তায় পড়ে মারা যায়। কেউ  মাদকাসক্ত হয়ে মারা যায়। কেউ পাচার চক্রের মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে যায়। কারো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে নেয়া হয় এবং সেটা দুষ্টচক্র  বিক্রি করে টাকা উপার্জন করে। মেয়ে শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। কখনো কখনো যৌনকর্মী হতে বাধ্য করা হয়। এভাবে তাদের নানা নির্যাতনের শিকার হতে হয়। সোশাল এন্ড ইকনোমিক এনহ্যান্সমেন্ট-এর তথ্যমতে, এই পথ শিশুদের শতকরা ৪৫ ভাগ মাদকাসক্ত, ৪১ ভাগ শিশুর ঘুমানোর কোনো বিছানা নেই, ৪০ শতাংশ শিশুর গোসলের ব্যবস্থা নাই। যে কারণে তারা গোসল করতে পারে না। ৪৫ শতাংশ শিশুর টয়লেট ব্যবস্থা নেই। তাই তারা খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে। প্রায় ৫৫ শতাংশ শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলেও তাদের দেখার কেউ নেই। আর ৭৫ শতাংশ শিশু অসুস্থ হলে ডাক্তারের সাথে কোন ধরনের যোগাযোগই করতে পারে না। ৫১ ভাগ শিশু অশ্লীল বাক্যবানের শিকার হয়। ৪৬ ভাগ মেয়ে শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। ১৯ শতাংশ শিশু হিরোইন আসক্ত। ৪০ শতাংশ ধূমপায়ী। ২৮ শতাংশ শিশু ট্যাবলেটে আসক্ত এবং ৮ শতাংশ শিশু ইনজেকশন আসক্ত। 

এই যখন অবস্থা ঠিক তখন এ বছর বাংলাদেশ উদযাপন করবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী; যেখানে উপস্থিত থাকবেন বিশ্ব নেতাদের কেউ কেউ। আর উপস্থিত অতিথিবৃন্দের কাছে ফুল বিক্রি করতে এগিয়ে যাবে এসব টোকাই নামের পথশিশু। প্রথমেই এসব পথশিশুর সাক্ষাৎ মিলবে বিমানবন্দরে। হোটেল শেরাটনে শিশু অধিকার বিষয়ক আলোচনা চলবে। আর এসব শিশু আমন্ত্রিত অতিথিদের কাছে ভিক্ষার হাত বাড়িয়ে দিবে। দেশের এ আয়োজনের সাথে বিষয়টি খুবই অসঙ্গতিপূর্ণ। দেশের সম্মানের সাথে এটা বড়ই অসম্মানের, অপমানের আর লজ্জার। জাঁকজমকপূর্ণ এ অনুষ্ঠানের সাথে এটা খুবই বেমানান। এর মাধ্যমে মলিন হবে মানবতা, লজ্জিত হবে স্বাধীনতা আর হেরে যাবে বাংলাদেশ। এসব শিশুর অভাবের কাছে ম্রিয়মান হয়ে দেখা দেবে দেশের উড়াল সড়ক, মেট্রো রেল, সুবর্ণজয়ন্তী, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, পদ্মা সেতু ইত্যাদি উন্নয়ন। নতুনদের অনুভূতি, ভাবনা, প্রত্যাশা, চাওয়া ও পর্যবেক্ষণ কর্তৃপক্ষের বিবেচনার জন্য  সদয় দৃষ্টিআকর্ষণী রইল!

বাংলাদেশের বর্তমান লক্ষ্য মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং ধাপে ধাপে উন্নত রাষ্ট্রে উন্নীত করা। তবে নতুনদের পর্যবেক্ষণ হল, দেশের প্রাণশক্তি হচ্ছে এই অবহেলিত তরুণ ও নতুন শিশু। এশক্তিই দেশের ভবিষ্যৎ। সুতরাং এ শক্তিকে অবহেলিত আবরিত রেখে কোনভাবেই দেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করা সম্ভব নয়। এ অবস্থা চলমান থাকা অবস্থায় যদি বাংলাদেশ কখনও উন্নত রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পায়ও; তবে সেটা  হবে এ নতুনদের সাথে প্রহসন। তাই নতুন বছরে নতুনদের চাওয়া হলো, রাষ্ট্র তাদের জন্য তাদের মৌলিক চাহিদা ও অধিকারগুলো সাংবিধানিকভাবে লিপিবদ্ধ করুক, তা বাস্তবায়ন করুক এবং ক্রমান্বয়ে তাদের পুনর্বাসন করুক! এ বিশাল জনশক্তিকে যদি জনসম্পদে পরিণত না করা হয় তাহলে এটা উন্নত রাষ্ট্র ব্যবস্থার বড় অন্তরায় হিসেবে দেখা দিবে। কাঙ্খিত লক্ষপানে পৌঁছতে বাংলাদেশ নিশ্চিত হোঁচট খাবে।

১৭ ই মার্চ ২০২০ থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বন্ধের এ দীর্ঘসূত্রীতা প্রলম্বিত হবে নিশ্চিত করে বলা যায়। আর এর মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে এ শিশুগণ। এতে তাদের শিক্ষাজীবন এক অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে ধাবিত হচ্ছে। ২০২০ চলে গেছে। করোনার বিষ চলে যাবার সাথে সাথেই স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠবে তরুণ-তরুণীদের মিলন মেলা। কোলাহলপূর্ণ উচ্ছ্বাসে মেতে উঠবে এসব নতুন, তরুণ-তরুণী আর কিশোর কিশোরীরা। তবে এ উচ্ছ্বাস মোটেই দীর্ঘ হবে না। কারণ করোনার  বিষে জীবন থেকে চলে গেছে অনেক মূল্যবান সময়। সুতরাং উচ্ছ্বাসের সময় কই? তাই শুরু হবে আবার সেই তোতাপাখির মত মুখস্তকরনের সীমাহীন অসুস্থ প্রতিযোগিতা। গলধঃকরণ করতে হবে অসংখ্য উত্তরমালা। নোট আর কোচিং-এর চাপে নতুনেরা হয়ে পড়বে আবার দিশেহারা। পড়তে যেতে হবে ব্যাচে। কারণ শ্রেণীতে হতে হবে প্রথম। পেতে হবে গোল্ডেন এ প্লাস। ডাক্তার হবার চাপ, ইঞ্জিনিয়ার  হবার চাপ কিংবা বিসিএস ক্যাডার হওয়ার চাপ। এছাড়া আরো কত যে অসুস্থ প্রতিযোগিতার চাপ মাথায় নিয়ে নতুন, তরুণ-তরুণী আর কিশোর-কিশোরীরা আবার মত্ত হবে নিরানন্দময় পাঠে! আনন্দের জন্য পড়া, দেশকে ভালোবাসার জন্য পড়া, ভালোলাগার জন্য পড়া, জ্ঞান অর্জনের জন্য পড়া, নৈতিক মানুষ হওয়ার জন্য পড়া ইত্যাদিতো দেশ থেকে অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। অথচ নতুন প্রজন্ম পড়তে চায় আনন্দের জন্য। পড়তে চায় ভালোলাগার জন্য, শেখার জন্য, পড়তে চায় জানার জন্য। কিন্তু দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এসুযোগ এখন একেবারেই নাই। নতুন শিশুরা এখন তোতাপাখিতে পরিণত হয়েছে। সৌখিন মানুষ শখ করে যেমন তোতাপাখিকে খাচায় বন্দি করে কিছু কথা ও বুলি শিখায়, ঠিক তেমনি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নতুন তরুণ-তরুণীদেরকে তোতাপাখি বানিয়ে ফেলেছে। দেশের কিছু নোট ব্যবসায়ী কর্তৃক সরবরাহকৃত নোট মুখস্ত করিয়ে এসব নতুন তরুণ-তরুণীদের সৃজনশীলতা সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস করা হচ্ছে। ফলে দেশ নতুন সোনামনিরুপি এক ঝাঁক তোতাপাখি উপহার পাচ্ছে। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী তারা দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে উঠছে না। যা উন্নত রাষ্ট্রগঠনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যদ্দরুন দেশে বিপুল জনশক্তি থাকার পরও বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে বিদেশ থেকে শ্রমিক আমদানি করতে হচ্ছে। দেশের এই বিপুল এবং ব্যাপক জনশক্তি নৈতিক, গবেষক, আবিষ্কারক, সৃজনশীল, মননশীল ইত্যাদি তেরি না হয়ে, তৈরি হচ্ছে স্বার্থপর, টাকা উপার্জনকারী, লোভী, ব্যক্তিত্বহীন, তোষামোদকারী আর দলবাজ নিষ্ঠুর অমানুষ। দেশে মেধার পরিচর্যা নাই, স্বীকৃতি নাই, কর্মসংস্থান নাই। আর এ কারণে দেশ থেকে মেধা পাচার হয়ে যাচ্ছে। দেশ হয়ে পড়ছে মেধাশূন্য। উন্নত বিশ্বে প্রাথমিকের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকগণ শিশুদের নিবিড় পরিচর্যা আর প্রশিক্ষণ প্রদাানের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত দেন যে, শিশুরা ভবিষ্যতে কে কী হবে-ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, গবেষক, লেখক, সাংবাদিক, প্রশাসক নাকি অন্য কোন কিছু? আর আমাদের দেশে সেই সিদ্ধান্ত দেন আমাদের অনভিজ্ঞ এবং ক্ষেত্রবিশেষে অশিক্ষিত অভিভাবকরাই। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। দেশের উন্নতি অগ্রগতিতে তাদের যে ভূমিকা রাখার কথা ছিল তার সবকিছুই ভেস্তে যাচ্ছে। নতুনদের এই ভাবনাগুলো কর্তৃপক্ষের কর্ণকুহরে হয়তো প্রবেশ করবে না। কারণ তাদের ছেলেমেয়েরা এদেশে পড়ে না। তারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মালিক। কোটি কোটি টাকা খরচ করে তারা পড়াশোনা করছে উন্নত দেশে। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আর অবদান রাখছে তারা সে সমস্ত দেশ গড়তে। সুতরাং তারা এদেশের উন্নতি অগ্রগতি নিয়ে কেনইবা আর ভাববে? তবে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক এ নতুন আর কিশোরগনই এদেশকে প্রকৃত অর্থে ভালোবাসে। তারা এদেশের মাটি, পানি, বাতাস ও মানুষকে আপন জানে ও আপন ভাবে। এখানেই তারা বাস করতে চায় স্থায়ীভাবে। এ দেশটাকে গড়তে চায় তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর ধর্মীয় মূল্যবোধকে সাথে নিয়ে। কিন্তু নতুন এ তরুণ-তরুণীগন উপরে উল্লেখিত অসঙ্গতিগুলোকে উন্নত রাষ্ট্র ব্যবস্থার বড় অন্তরায় হিসেবে মনে করে। তাই দেশটাকে উন্নত রাষ্ট্রে পৌঁছতে নতুনরা নতুন বছরে এসব অসঙ্গতিগুলোর সমাধান চায়।

নতুন প্রজন্ম বর্তমানে পর্নোগ্রাফীর আসক্তির ভয়াল নেশায় মত্ত। শুধু স্কুল-মাদ্রাসা-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেই এ নেশা সীমিত নয়। মধ্যবয়সী নারী-পুরুষও এ ক্ষতিকর আসক্তিতে ভুগছেন। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন-এর এক তথ্যমতে, রাজধানী ঢাকার স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের শতকরা প্রায় ৮০  ভাগ তরুণ-তরুণী কিশোর কিশোরী পর্নোগ্রাফীতে আসক্ত। যা রীতিমতো উৎকণ্ঠা এবং উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে অভিভাবকমহলে। সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, কিশোর-কিশোরীদের পর্নোগ্রাফীর প্রতি এই আসক্তি পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বিপদ ও বিপর্যায় ডেকে আনতে পারে। মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন, পর্নোগ্রাফী মাদকের মতো একটি আসক্তি। মাদক যেমন মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে মানসিক বিকৃতি ঘটিয়ে ফেলে ঠিক তেমনি পর্নোগ্রাফীও মানুষের মস্তিস্কে  অনুরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, পর্নোগ্রাফী মাদকের চেয়েও ভয়ানক আসক্তি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোবিজ্ঞানী জেফরি  সেটিনোভার বলেছেন, পর্নোগ্রাফী আসক্তি হিরোইনের মতোই বিপদজনক। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, মাদকাসক্ত ব্যক্তির মাদক গ্রহণের সময় মস্তিস্কের যে অংশে অনুভূতি কাজ করে, পর্নোগ্রাফী দেখার সময়ও মস্তিস্কের ওই অংশটি ভীষণভাবে উদ্দীপ্ত হয়। ফলে মাদকাসক্তদের ন্যায় পর্নোগ্রাফীতে আসক্তদের জীবনের ছন্দপতন ঘটে। ধীরে ধীরে তারা তাদের জীবনের স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলে। তারা বাস্তব জগৎ ছেড়ে ফ্যান্টাসি দুনিয়াতে চলে যায় এবং যৌবনের বিশেষ সময়টিকে তারা পর্নো সিনেমার জীবন মনে করতে থাকে। মনের মধ্যে তারা সব সময় বৃথা রোমান্স খুঁজে বেড়ায়, কিন্তু বাস্তব জীবনে তা পায়না। ফলে তারা একাকিত্ব হয়ে যায়। পরিবারের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ঘটে। মনের মধ্যে সবসময় কাজ করে অস্থিরতা। মেজাজ হয়ে যায় খিটখিটে স্বভাবের। কাজকর্মে আসে উদাসীনতা ও অলসতা। সমাজে সৃষ্টি হয় বিশৃংখলা। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, পর্নোগ্রাফীতে নারীকে ভোগ্যবস্তু আর দুর্বলভাবে উপস্থাপন করা হয়। ফলশ্রুতিতে উঠতি বয়সের তরুণরা  নারীদেরকে পণ্য ও দুর্বল ভাবতে শুরু করে। ফলে নারীরা তাদের সামাজিক মর্যাদা ও গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। নতুন এসব তরুণ-তরুণীদের মাথার মধ্যে সারাক্ষণ  ঘুরপাক খায় ঐ একই চিন্তা। ফলে সমাজে বেড়ে চলছে বিবাহবহির্ভূত অজাচার, ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানী। 

শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী, পুরুষ সহকর্মী কর্তৃক নারী সহকর্মী, ছেলে সহপাঠি কর্তৃক মেয়ে সহপাঠি, বন্ধু কর্তৃক বান্ধবী ইত্যাদি ধর্ষণের মতো ঘটনা তাই দেশে নিত্যদিনের খবর। বাদ যাচ্ছেনা পড়শী বোন, পরিচিত বা অপরিচিত কোনো নারীই। অর্থাৎ তাদের কাছে নারী হলেই হল-সম্পর্ক কোন ব্যাপারই নয়। তাদের লোলুপ দৃষ্টি থেকে রেহাই পাচ্ছে না ছোট্র দুধের মেয়েশিশুটিও। পর্নোগ্রাফীতে আসক্ত ১০-১২ বছর তরুণ-তরুণীদের কাছ থেকে প্রকাশিত হচ্ছে অশ্রাব্য ভাষা, অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত যার মাধ্যমে সামাজিক শৃংখলার অবনমন ঘটছে প্রতিদিন। লজ্জা, ভয়, ডর, শঙ্কা ইত্যাদি হারিয়ে যাচ্ছে সমাজ থেকে। ক্ষয়িষ্ণুসমাজ থেকে লোপ পাচ্ছে ধর্মীয় মূল্যবোধ। ধ্বংস হচ্ছে সৃজনশীলতা। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে যে, পর্নোগ্রাফীতে আসক্ত ব্যক্তির শারীরিক ক্ষতিও কম নয়। অতিরিক্ত পর্নো আসক্ত ব্যক্তি ঘনঘন অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। এমনকি স্মৃতিশক্তিও লোপ পেতে পারে। উন্নত রাষ্ট্র গড়তে উল্লেখিত সামাজিক অবক্ষয় অনেক বড় বেশি অন্তরায় বলে নতুনরা মনে করে। নতুনদের বাঁচাতে তাই কর্তৃপক্ষের দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া উচিত। এক্ষেত্রে নতুনদের চাওয়া হলো, কর্তৃপক্ষ কর্তৃক মোবাইল ফোনে পর্ণো সাইটগুলি বন্ধ করা। টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থার সিস্টেম এন্ড সার্ভিস বিভাগ থেকে  মোবাইল ফোনে পর্ণো সাইটগুলো বন্ধের উদ্যোগ নেয়া দরকার। মোবাইলে পর্নো সাইটগুলো বন্ধ হলে অনেকাংশে তরুণ-তরুণীরা পর্নোগ্রাফীর এ ভয়াল ছোবল থেকে বাঁচতে পারবে বলে ভুক্তভোগী নতুনেরা মনে করে। নতুনদেরকে বাঁচাতে তাই সমাজ, রাষ্ট্র ও সরকারের এগিয়ে আসা অতীব জরুরী। কারণ এ বিশাল জনশক্তিকে অস্থিরতা আর বিষাক্ত ছোবলের মধ্যে ফেলে রেখে উন্নত রাষ্ট্রের কল্পনা করা বাতুলতার নামান্তর। নতুন বছরের শুরুতে নতুনদের আরো অনেক চাওয়া রয়েছে। কলেবর বৃদ্ধির কারণে তা সংক্ষেপ করা হলো। নতুন সূর্যের কিরণে জ্বলে যাক দেশের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা! জাতি ফিরে পাক সংঘাতমুক্ত বাংলাদেশ! করোনায় নষ্ট হওয়া পারিবারিক সম্পর্ক আবার জেগে উঠুক! রোবটিক জীবনের অবসান ঘটিয়ে শুরু হোক মনুষ্য সাক্ষাতের পরিবেশ! সর্বোপরি করোনার ধাক্কা কাটিয়ে সবাই ফিরে যাক তাদের আগের স্ব স্ব কর্মস্থলে! শিক্ষার্থীরা ফিরে আসুক তাদের শিক্ষালয়ে! চির চেনা সেই বাংলাদেশে ফিরে আসুক স্বস্তি, শান্তি, গতি আর প্রীতি!

লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।