স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি: ময়লা যায়না ধুলে

স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি: ময়লা যায়না ধুলে

বেড়ার শস্য খাবার ফলে মানুষকে চিকিৎসা সেবার জন্য যেতে হচ্ছে বেসরকারি ব্যবস্থ্যার কাছে।

ডা: মুহাম্মদ আব্দুস সবুর-

করোনাকালে আমাদের স্বাস্থ্য খাতের দূর্নীতি খুবই নগ্নভাবে উন্মোচিত হয়েছে। নকল এন ৯৫ মাস্ক, রেইন কোর্টকে পিপিই বলে চালানোর প্রচেষ্টা, ভূয়া রিপোর্ট প্রদানের জন্য কুখ্যাত জেকেজি, রিজেন্ট, অনুমোদনবিহীন ভাবে হাসপাতাল পরিচালনা, কোন কোন বেসরকারি হাসপাতালের গলাকাটা বিল সবই ছিল আলোচনার বিষয়। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের জন্য প্রচলিত দামের চাইতে কয়েকগুণ বেশী দাম দিয়ে যন্ত্রপাতি ক্রয়ের দুঃসংবাদের সাথে আমরা আবগত হয়েছি জনৈক ড্রাইভারের অবিশ্বাস্য প্রভাব আর সম্পদ অর্জনের কাহিনীও। স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন দুর্নীতি নিয়ে করোনাকালে বেশী আলাপ আলোচনা হলেও, এ চিত্র কিন্তু বেশ পুরানো। সময়ের সাথে সাথে অবস্থার উন্নতি হয়নি, হয়েছে অবনতি।

১৯৮০ এর দশকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বেশ প্রতাপশালী ছিলেন একজন কেরানি। তার প্রভাবে অতিষ্ঠ হয়ে তখনকার মতিঝিলস্থ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ডাক্তাররা শ্লোগান দিয়েছিলেন-হতে চাইনা ডাক্তার হতে চাই আকতার (কেরানির নাম)। এরশাদের সামরিক শাসনের সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ছিলেন একজন বিগ্রেডিয়ার আর একজন কর্নেল ছিলেন প্রভাবশালী পরিচলক। তখন প্রশিক্ষণের এখনকার মত রমরমা অবস্থা ছিল না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অর্থায়নে কিছু প্রশিক্ষণ হতো। দেখা গেল, বাংলাদেশের যেখানেই প্রশিক্ষণ হোক, এ দু’জনার জন্য রিসোর্স পারসনের ভাতা অবধারিত। ফলে একই ব্যক্তি একই দিনে পঞ্চগড়, কক্সবাজার ও ময়মনসিংহে প্রশিক্ষণ প্রদান করে ভাতা গ্রহণ করেছিলেন। ব্যাপারটি যখন কয়েক বছর পর জানাজানি হলো তখন তাদের সামরিক বাহিনীতে প্রত্যাহার করতে হয়েছিল।

কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন আওয়ামী লীগ সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত। এর নির্মাণ শুরু হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের আগে ১০ হাজারের বেশী নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছিল। ২০০১ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত অধিকাংশ কমিউনিটি ক্লিনিক পরিত্যাক্ত অবস্থায় ছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় এসে এগুলোর কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু আগের নির্মাণ করা সমস্ত কমিউনিটি ক্লিনিকের পুন:সংস্কার প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। ফলে সহজেই অনুমেয় যে কিভাবে প্রথমে এদের নির্মাণ কাজ করা হয়েছিল যা ৮-১০ বছরের মধ্যে পরিত্যাক্ত পর্যায়ে চলে গিয়েছিল।

স্বাস্থ্য খাতে কেনা-কাটায় সিন্ডিকেটের প্রভাব খুবই আলোচিত। কেন্দ্রীয় ঔষুধাগারের একজন পরিচলক লিখিতভাবে এ ব্যাপারে সরকারের উর্ধ্বতন মহলকে জানিয়েছিলেন। বিভিন্ন টেলিভিশনের টক শো তে এটি খুবই আলোচিত। অথচ এই সিন্ডিকেটের অস্তিত্বের কথা কেউ বলবেনা ২০০৯ এর আগে। ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল নাগাদ এই সিন্ডিকেট সমূহ রাজত্ব করেছে। ২০১৯ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন তালিকাসহ এদের ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে মাননীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রীকে জ্ঞাত করলেও কোন ব্যবস্থ্যা গ্রহণ করা হয় নি। যাদের হাত ধরে সিন্ডিকেটের জন্ম ও বেড়ে ওঠা তাদেরই এখন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে উচ্চ কণ্ঠে বক্তব্য দিতে দেখা যায় টক শো গুলোতে।

স্বাস্থ্য বিভাগে নিয়োগ, বদলী, পদোন্নতিতে বাণিজ্য সকলেরই জানা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এ ব্যাপারে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। কিন্তু অবস্থার কোন পরিবর্তনই হয়নি। যারা ঘুষ দিয়ে নিয়োগ নেন অথবা বদলী গ্রহণ করেন কিংবা পদোন্নতি পান, তারা যখন সেই টাকা বা তার বেশী উদ্ধারের চেষ্টায় লিপ্ত হন তখনই বিপত্তি ঘটে-সেবা বিঘ্নিত হয়, চিকিৎসা শিক্ষা বাধাগ্রস্থ হয়।

বিশ্ব ব্যাংক কর্তৃক আপত্তি জানানোর ফলে মহাপরিচালকসহ পরিচালক পর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা গৃহীত টাকা ফেরত দিয়েছেন। কিন্তু তাদের কেউই শাস্তির সম্মুখীন হন নি।

স্বাস্থ্য খাতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির প্রসার বাড়ছে। ফলে সরকারের এত বিপুল খরচের সেবা থেকে সাধারণ মানুষ খুবই কম উপকৃত হচ্ছেন। বেড়ার শস্য খাবার ফলে মানুষকে চিকিৎসা সেবার জন্য যেতে হচ্ছে বেসরকারি ব্যবস্থ্যার কাছে। নিজেদের খরচের পরিমাণ প্রায় ৭০ শতাংশ ছুয়েছে। চিকিৎসার খরচ যোগাতে যেয়ে সর্বশান্ত হচ্ছেন অনেকে, অনেকেই পাচ্ছেন না কাংখিত সেবা টাকার সংস্থান করতে না পারার কারণে। অথচ সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ২০৩০ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে।

লেখক: স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ 
                          ও
সম্পাদক: নিউজজোনবিডি ডট কম।