নাগরিক তালিকা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ কেন উদ্বিগ্ন

নাগরিক তালিকা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ কেন উদ্বিগ্ন

ছবি সংগৃহিত।

আসামে চূড়ান্ত নাগরিক তালিকা প্রকাশের পর ভারতের কেন্দ্রিয় সরকারের নজর এখন পশ্চিমবঙ্গের দিকে। এই রাজ্যে নাগরিক তালিকা করার প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে ক্ষমতাসীন বিজেপি। এই দলের নেতারা মনে করেন পশ্চিমবঙ্গে চূড়ান্ত নাগরিক তালিকা করা হলে দু”কোটি তথাকথিত অবৈধ লোককে বের করে দেয়া সম্ভব হবে। তবে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে ক্ষমতাসীন তৃনমৃল কংগ্রেস এর তীব্র বিরোধিতা করছে। আসামের নাগরিক তালিকাও প্রত্যাখান করেছে পশ্চিমবঙ্গের অনেক রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিজবীরা। 
ভারতের জাতীয় নাগরিক তালিকা প্রকাশের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে এর বিরোধিতা করছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যয়। ইতোমধ্যে এর  বিরুদ্ধে বড় আকারের বিক্ষোভ মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। অর্থাৎ এনআরসি নিয়ে সরাসরি রাজপথে নেমেছেন মমতা বন্দোপাধ্যয়। অন্য দিকে দেশটির বিজেপি সরকার বলছে, তারা পশ্চিমবঙ্গসহ সব রাজ্যে নাগরিক তালিকা করবে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি কলকাতায় একই কথা বলে গেছেন।
 নাগরিক তালিকার বিরুদ্ধে মিছিলের শেষে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যয় বলেন, তিনি তার রাজ্যে এমন কোনও পদক্ষেপ কেন্দ্রকে করতে দেবেন না। সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, মমতা বলেছেন,  ‘আমরা বাংলায় কখনওই নাগরিক তালিকা করার অনুমতি দেব না। রাজ্যের নাগরিকদের ধর্ম ও জাতের ভিত্তিতে ভাগ করতে দেব না ওদের। আমরা আসামের নাগরিক তালিকাও  গ্রহন করব না। ওরা আসামের মানুষের কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ ও প্রশাসনের সাহায্যে; কিন্তু ওরা বাংলাকে চুপ করাতে পারবে না।
এনডিটিভির খবরে বলা হয়েছে, বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, রাজ্যে এক কোটিরও বেশি বেআইনি অনুপ্রবেশকারীকে আশ্রয় দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। আসামের পরে পশ্চিমবঙ্গে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী তৈরি করা হবে, তা ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব আবারও ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন, দিল্লিতে  রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে এবং দলের সভাপতি অমিত শাহের সঙ্গে এক বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনাও হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃনমুল শুধু নয় এই রাজ্যের বেশির ভাগ মানুষ নাগরিক তালিকা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। এর প্রধান কারন পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত ঘেষা আসামে বাংলাভাষি হিসাবে যাদের বিতাড়নের চেষ্টা করা হচ্ছে এদের অনেকে সাথে আছে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের নিবিড় যোগাযোগ। অনেক পরিবারের এক অংশ আছে আসামে আরেক অংশ আছে পশ্চিমবঙ্গে। এছাড়া নাগরিক তালিকায় নাম না থাকা প্রায় ১২ থেকে ১৩ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে যদি আসাম ছাড়তে হয় তাহলে তাদের গন্তব্য যে পশ্চিমবঙ্গ হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নিজ দেশের নাগরিকদের এভাবে বিভাজনের চেষ্টায় সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে পশ্চিমবঙ্গে। আসাম থেকে বাঙ্গালি বিতাড়নের এমন দাবি উঠতে পারে দার্জিলিংয়ে। ইতোমধ্যে ওখানকার রাজনৈতিক দলগুলো দার্জিলিংকে আলাদা রাজ্য গঠনের দাবি জানিয়েছে। ফলে জনবিন্যাস বদলে ফেলার বিজেপির রাজনীতি আসাম, পশ্চিমবঙ্গ এমনকি উত্তর পূর্ব ভারতের অন্য রাজ্যগুলোতেও অস্থিরতা তৈরি করতে পারে।
এন আরসি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পর বিরোধী অবস্থানের মধ্যে  পশ্চিমবঙ্গের যেসব মানুষ পূর্ববঙ্গ থেকে চলে এসেছিলেন, তাদের অনেকেই বলছেন এনআরসি হলে নাগরিকত্ব প্রমানের  বৈধ নথি যোগাড় করতে তাদেরও বেগ পেতে হবে। এদের মধ্যে যেমন রয়েছেন বহু সাধারণ মানুষ, তেমনই আছে নানা ক্ষেত্রের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি - সাহিত্যিক, নাট্যকার, গায়ক বা চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব। এরকমই একজন, সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখার্জি। তিনি বিবিসিকে বলেন  "কবে সীমানা পেরিয়েছি, সেটা তো আমার স্মৃতিতে আছে। কোন স্কুলে কতবছর পড়েছি, সেটাও আমার মনে আছে। কিন্তু এসবের যদি কাগজপত্র দিতে বলে, তা তো দিতে পারব না! তবে কী আমাকে বার করে দেবে? সেটাই বা আমি মানব কেন? আর আসামে তো দেখছি, অনেকে বৈধ কাগজপত্র জমা দেয়ার পরেও তাদের নাম বাদ দিয়ে দিয়েছে,।
সাহিত্যিক মিহির সেনগুপ্তর জন্ম দেশভাগের দিন পনেরো পরে - বরিশালে। ব্রজমোহন কলেজে পড়াশোনাও করেছেন। তারপরে ১৯৬৩ সালে ভারতে চলে আসেন তিনি। এতদিন পরে সেই সব নথি দেয়া একরকম অসম্ভব বলে তার মনে হচ্ছে। মিহির সেনগুপ্তর কথায়, "এদেশে চলে আসার পরে আমি সিটিজেনশিপ সার্টিফিকেট করিয়েছিলাম মূলত পাসপোর্ট বানাতে হবে বলে। কিন্তু সেই সার্টিফিকেট এখন কোথা থেকে খুঁজে বার করব ৭৩ বছর বয়সে।"
"আসলে দেশভাগের সময় থেকেই এই সমস্যা চলে আসছে। একেকবার একেকরকম  ডেডলাইন দেওয়া হয়েছে যে তার পরে যারা আসবে, তারা আর নাগরিকত্ব পাবে না। কিন্তু উপমহাদেশ ভাগ হওয়ার এই সমস্যার সমাধান কী এভাবে হয় নাকি?" 
এরা দুজন যেমন নিজেরাই দেশভাগের পরে ভিটেমাটি ছেড়ে কলকাতায়  চলে এসেছিলেন, তেমন এমন অনেকে আছেন, যাদের পূর্বপুরুষরা চলে এসেছিলেন ভারতে। দুই বা তিন প্রজন্ম পরে এখন তারাও জানেন না সেই সব নথি কোথায় আছে। 
নাট্যকার ও অভিনেত্রী খেয়ালী দস্তিদার বিবিসিকে বলেন  "আমাদের আগের প্রজন্মের ক্ষেত্রে তো কোনও কিছুই ডিজিটালাইজড ছিল না। তাই তাদের সেই সব ডকুমেন্ট কীভাবে তারা যোগাড় করবেন ভেবেই তো আমার খারাপ লাগছে। আর যদি এনআরসি হয়, তাহলে যেসব নথির কথা শুনছি, আমার নিজেরই তো সেসব কোথায় আছে জানি না। আমার নিজের বার্থ সার্টিফিকেট তো কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না।" পশ্চিমবঙ্গেও যদি এনআরসি হয়, তাহলে যে শুধু পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা মানুষদের নিজেদের নাগরিকত্বের প্রমান দিতে হবে, তা নয়। রাজ্যের সব বাসিন্দাকেই নথি যোগাড় করে প্রমান করতে হবে যে তিনি ভারতীয়। 
নাগরিক তালিকা বা এনআরসির ব্যাপারে বিজেপি সরকার যে অনঢ় তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর বক্তব্য থেকে। আসামে নাগরিক তালিকা প্রকাশের পর এর বিরোধিতা করেছে আসামের বিজেপি নেতা
রা। তারা বলছেন এনআরসি প্রক্রিয়া যথাযথ ছিলো না। কিন্তু নাগরিক তালিকা প্রকাশের পর অমিত শাহ আসাম সফরে গিয়ে বলেছেন আসামের চূড়ান্ত নাগরিক তালিকায় নাম না থাকা ১৯ লাখেরও বেশি মানুষের প্রত্যেককে এক এক করে দেশছাড়া করা হবে।  তার ভাষায়, ‘প্রতিটি অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকে আসাম থেকে বের করে দেয়া হবে।’ অমিত শাহ বলেন,‘জাতীয় নাগরিকপঞ্জি নিয়ে অনেকে অনেক রকম প্রশ্ন তুলেছেন। আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, ভারত সরকার, একজন অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকেও এদেশে থাকতে দেবে না। এটা আমাদের প্রতিশ্রুতি। 
নাগরিক তালিকার মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষ নিজ ভুমিতে পরবাসী হয়ে গেছেন। বিজেপি সরকার আসলে নাগরিক তালিকা প্রকাশের নামে ইসরাইলি নীতি অনুসরন করছে। লাখ লাখ মানুষকে ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এমন ব্যক্তিদের নাগরিকত্বহীন করা হয়েছে, যারা কয়েক প্রজন্ম ধরে ভারতে বাস করছেন, সেনাবাহিনী ও সরকারি দায়িত্ব পালন করেছেন। এমনকি এক রাজ্যের মানুষ আরেক রাজ্যের নাগরিককে বিয়েও করেছেন। এমন ব্যক্তিও নাগরিকত্বহীন হয়ে পড়েছেন। এখন তাদেরকে বন্দিশিবির বা ডিটেনশন ক্যাম্পে আটকে রাখার প্রক্রিয়া চলছে। 
ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, আসামের গোয়ালপাড়া জেলায় তিন হাজার মানুষ থাকার মতো ১০টি ডিটেনশন ক্যাম্প এরইমধ্যে প্রস্তুত করা কাজ শুরু করেছে সরকার। ৪৬ কোটি টাকা খরচ করে তৈরি হচ্ছে এই ক্যাম্প। কেবল আসামেই নয়, মুম্বাইয়েও তৈরি হতে পারে আরো একটি ক্যাম্প। কথিত অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের রাখতে ডিটেনশন সেন্টার তৈরি করার জন্য জমি চেয়ে, মুম্বাই প্ল্যানিং অথরিটিকে এরইমধ্যে চিঠি দিয়েছে মহারাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র দপ্তর। 
রাষ্ট্রহীন মানুষদেরই ঠিকানা হবে ডিটেনশন ক্যাম্প। আসামের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনবসতিপূর্ণ রাজ্য মুম্বাইয়েও এই এনআরসি করার সম্ভাবনা রয়েছে। মহারাষ্ট্রের শিল্পোন্নয়ন দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, নেরুল এলাকায় এই দপ্তরের যে জমি রয়েছে, তা থেকে দুই-তিন একর জমি চাওয়া হয়েছে ‌এরইমধ্যে। এলাকাটি মূল মুম্বাই শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে। এই জমিতেই তৈরি হবে ডিটেনশন ক্যাম্প।
 কেন্দ্রের নির্দেশ অনুযায়ী, দেশের যে সমস্ত এলাকায় বেশি অনুপ্রবেশকারী বাস করছে, সে সব জায়গায় ডিনেটশন সেন্টার তৈরি করা হবে। ধারণা করা হচ্ছে, মহারাষ্ট্রেও তৈরি হতে পারে ডিটেশন সেন্টার। কয়েক মাস পরেই মহারাষ্ট্রে বিধানসভা নির্বাচন। এরইমধ্যে শিবসেনা অভিযোগ তুলেছে, মুম্বাইয়ে অবৈধ বাংলাদেশিরা বসবাস কাজ করছে। 
পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি হলে তাতে বাদ পড়তে পারেন বিজেপির হিসাবে কোটির বেশি লোক। এদের কোথায় কিভাবে রাখা হবে তা এক বড় প্রশ্ন। এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে যদি ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা হয় তাহবে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ডিটেনশন ক্যাম্প। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পরও এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। তবে বিজেপি সরকার সম্ভবত সে ধরনের পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। এ নিয়ে এখন সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন পশ্চিমবঙ্গের মানুষ।