শিশুদের স্কুল ব্যাগের ওজন ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি!!!

শিশুদের স্কুল ব্যাগের ওজন ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি!!!

ফাইল ছবি

আজকাল প্রায় প্রত্যেক স্কুলে বই ও খাতার সংখ্যা বেড়েছে এবং বর্তমানে সিলেবাসের প্রেক্ষিতে এবং অভিভাকদের অতিরিক্ত সচেতনতা এবং দাবির মুখে স্কুল কর্তৃপক্ষ বেশি বেশি বাড়ীর কাজ, শ্রেনীর কাজ, বাংলা, ইংরেজী এবং ধর্ম শিক্ষাসহ সকল বিষয়ে পন্ডিত করার যুদ্ধে নেমেছে।

শিক্ষক আর অভিভাবকদের এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় মূলত বলিদান হচ্ছে আমাদের সন্তানরা। ছোট ছোট শিশুরা ভারী স্কুল ব্যাগ নিয়ে তিনতলা চারতলা সিঁড়ি বেয়ে ক্লাস করছে। অনেকেই স্কুল ব্যাগ সমানভাবে কাঁধের দুপাশে না নিয়ে একপাশে ঝুলিয়ে নিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। আবার কেউ কেউ একপাশে ব্যাগ নেয়াটা স্মার্টনেসও মনে করে।

অতিরিক্ত ওজনযুক্ত ব্যাগ বহনের ফলে শিশুর কি কি ক্ষতি হচ্ছে?


            ১. দীর্ঘদিন কাঁধে ব্যাগ নেবার কারনে মাংশপেশি স্পাজম বা শক্ত হয়ে যায়। ফলে রক্ত চলাচল ব্যহত হয়ে বিভিন্ন ধরনের ব্যথা সৃষ্টি হয়। যেমন:- ঘাড় ব্যথা, কাঁধ ব্যথা, কোমর ব্যথা, হাঁটু ব্যথা, মাথা ব্যথা ইত্যাদি।

            ২. একদিকে ভারী ব্যাগ ব্যবহারের ফলে দুই কাঁধে ভারসাম্য বা ব্যালেন্সের ঘাটতি হয়, যে কারনে মেরুদন্ডের এলাইনমেন্ট সরে যায় এবং শিশু কিছুটা বাঁকা হয়ে হাঁটে।

            ৩. অতিরিক্ত ওজনের ব্যাগ বহনের ফলে শিশু কিছুটা মাথা ও ঘাড় সামনের দিকে ঝুঁকে যায়  এবং তাকে স্বাভাবিকের চেয়ে খাটো দেখা যায়।

            ৪.  অতিরিক্ত ওজনের ব্যাগ বহনের ফলে শিশুর posture খারাপ হয়ে যায় অর্থাৎ তার শরীরের  বডি এলাইনমেন্ট সঠিক থাকে না।

            ৫.  এছাড়াও ঘাড়ও কাঁধের মাংসপেশিতে আঘাত বা ইনজুরি এমনকি ছিড়েও যেতে পারে অতিরিক্ত ওজনের ব্যাগ বহনের ফলে।

            ৬.  তাছাড়া মানসিক বিষন্নতা, এমনকি অনেক সময় শরীরের ভেতর Internal organ এরও ক্ষতি হতে পারে।

 কতটুকু ওজন এবং কিভাবে বহন করা উচিতঃ


            ১.  আমেরিকান শিশু একাডেমি ব্যাগপ্যাক নেবার ক্ষেত্রে শিশুদের শরীরের ওজনের ১০-১৫% নেবার কথা বলেছেন। উদাহরণস্বরূপ, আপনার শিশুর ওজন যদি ৪০ কেজি হয় তাহলে সে ৪-৫ কেজির মতো ওজনযুক্ত ব্যাগ বহন করতে পারবে।

            ২.   আমাদের দেশের সুপ্রীমকোর্ট কিছুদিন আগে বাচ্চাদের স্কুল ব্যাগের ওজন কতটুকু হবে তার উপর একটি আইন পাশ করেছেন। সেখানে স্পষ্ট লেখা আছে, বাচ্চার স্কুল ব্যাগের ওজন যাতে কোনভাবেই তার শরীরের ওজনের ১০% এর বেশি না হয়।

            ৩.   শিশুর ব্যাগের ওজন দুই কাঁধে সমানভাবে ভাগ করে নিতে হবে।

            ৪.  খেয়াল রাখতে হবে যেন ব্যাগের ভারে বাচ্চা সামনের দিকে ঝুঁকে না যায়।

ব্যথা হলে কি করবেন ?


            ১.  ঘাড়ের মাংসপেশিতে বরফের ছেক দিতে পারেন। থেরাপিউটিক ব্যায়ামের মাধ্যমে ব্যথা কমানো যায়। তাই এক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের শরনাপন্ন হতে পারবেন। চিকিৎসকের পরামর্শ মতো বিভিন্ন ধরনের ষ্ট্রেচিং এক্সারসাইজ,ম্যাসেজ বাসায় করাতে পারবেন।

            ২.   শিশুদের ফিটনেসের জন্য ফুটবল, ভলিবল, টেনিস ইত্যাদি খেলার সুযোগও করে দিতে হবে।

            ৩.  ফ্রোজেন ফুডের পরিবর্তে পুষ্টিকর, বিভিন্ন রঙের এবং বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি, ফলমূল ইত্যাদি খাদ্য গ্রহন অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

স্কুল কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব:-


শিশুদের এই শিক্ষা গ্রহণের যুদ্ধ থেকে রক্ষা করতে স্কুল কর্তৃপক্ষের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। বাড়ীতে অতিরিক্ত কাজ না দিয়ে ক্লাসের কাজ ক্লাসেই করানো যেতে পারে। রুটিন অনুযায়ী শুধুমাত্র টেক্সবুক বা পাঠ্যপুস্তক নেয়াকে উৎসাহিত করতে হবে। ক্লাস ওয়ার্কের কিছু বই, নোট বুক, স্কুলের লাইব্রেরীতে রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অতিরিক্ত বই বা রুটিনের বাইরে বই বহন করা থেকে বাচ্চাদের বিরত রাখতে হবে। বেশি বেশি গ্রুপ ওয়ার্ক বা দলীয়ভাবে স্কুলে পাঠদানের ব্যবস্থা করলে বইয়ের চাপ অনেকটাই কমানো সম্ভব। তাছাড়া স্কুলে সবার জন্য নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করলে শিশুকে পানির বোতল বহন করতে হবে না। এছাড়াও স্কুল থেকে নির্ধারিত হালকা ওজনের ব্যাগ সরবরাহ করা যেতে পারে।

অভিভাবকের দায়িত্বঃ


অভিভাবকদেরকেও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। অনেক সময় অভিভাবকগণ একই ব্যাগে স্কুল বই, কোচিং এর বই, প্রাইভেট এর বই, খাতা ইত্যাদি দিয়ে ব্যাগের ওজন অনেক বেশি করে রাখেন। এক্ষেত্রে আলাদা আলাদা ব্যাগের ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমেও অভিভাবকগন শিশুদের অতিরিক্ত ওজন বহন থেকে বিরত রাখতে পারেন। এ বিষয়ে অভিাভবকদের যথেষ্ট সচেতন ও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন।সবকিছুর আগে দরকার, সচেতন হওয়া। অতিরিক্ত বইয়ের ভার আমাদের সন্তানদের কাঁধে না তুলে দেয়াই মঙ্গল।  সচেতন হোন, শিশুর স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে এমন কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকুন।

মেহেরুন নেসা

ফিজিওথেরাপী ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।

আদ্-দ্বীন ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক হাসপাতাল, ঢাকা