বৃদ্ধাশ্রম : পিতা-মাতার হক

বৃদ্ধাশ্রম : পিতা-মাতার হক

ফাইল ছবি

হযরত আদম ও হাওয়া আ. আমাদের আদি পিতা-মাতা। সেই পিতা-মাতার মাধ্যমেই মানবসৃষ্টির ধারা শুরু হয়েছে। ক্রমে দুনিয়া আবাদ হয়েছে। বসতি গড়ে ওঠেছে। বিভিন্ন সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়েছে। এখন সবদিক থেকেই ক্রমশ উন্নতির দিকে ধাবমান পৃথিবী।

পিতা-মাতা না হলে মানবসৃষ্টির ধারা সূচিত হত না। দুনিয়া কোনো উন্নতি অগ্রগতি দেখত না। মানবসভ্যতা বিকাশ লাভ করত না। দুনিয়াটা আশরাফুল মাখলুকাত মানুষের দুনিয়া হিসেবে পরিচিতি লাভ করত না। 

আমাদের সৃষ্টির মূলে আছেন পিতা-মাতা। তাদের বদৌলতেই আজ আমরা পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখছি। বেড়ে উঠেছি। বিশ্বের নিয়ামতরাজি ভোগ করে উপকৃত হচ্ছি। আমাদের জীবনে পিতা-মাতার অবদান অতুলনীয়, অনস্বীকার্য। এজন্যই মহান স্রষ্টা পিতা-মাতার সর্বাধিক গুরুত্বের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। পবিত্র কুরআনের স্থানে স্থানে এর প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাদের কৃতজ্ঞতা আদায় করতে বলেছেন। সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে বলেছেন। পরম যত্ন সহকারে সেবা ও খেদমত করতে বলেছেন। যেখানেই মহান স্রষ্টা তার কৃতজ্ঞতা আদায় করতে বলেছেন, সেখানেই পিতা-মাতারও কৃতজ্ঞতা আদায়ের তাকিদ করেছেন। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- "আমি মানুষকে তাদের পিতা-মাতার ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছি- যেন তারা তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করে। কেননা তার মা কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে তাকে গর্ভে ধারণ করেছে এবং দুই বছর পরেই সে বুকের দুধ খাওয়া ছেড়েছে। তুমি তোমার নিজের সৃষ্টির জন্য আমার শোকর আদায় করো এবং তোমার লালন পালনের জন্য পিতা-মাতারও কৃতজ্ঞতা আদায় করো। অবশ্য তোমাদের সবাইকে আমার কাছেই ফিরে আসতে হবে।" (সূরা লোকমান, আয়াত- ১৪) যেখানে মহান স্রষ্টা তার আনুগত্য ও বন্দেগী করতে বলেছেন, সেখানেই পিতা-মাতার সঙ্গে সদাচার করতে বলেছেন। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- "তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দান করেছেন, তোমরা একমাত্র তারই বন্দেগী করবে এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। যদি পিতা-মাতা উভয়ই বা কোনো একজন তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হন, তাহলে কোনো কারণে বিরক্ত হয়ে তাদের উফ বলো না এবং তাদের ধমক দিয়ো না বরং তাদের সাথে সম্মানজনক ভদ্রজনোচিত কথা বলো।" (সূরা বানি ইসরাঈল, আয়াত- ২৩)

পিতা-মাতার মত এত অকৃত্রিম বন্ধু ও পরম দয়াবান আর কেউ নেই পৃথিবীতে। অন্যদের বন্ধুত্ব ও দয়ায় কোনো স্বার্থ থাকতেও পারে; কিন্তু পিতা-মাতার স্নেহ-মায়া ও দান-দয়ায় কোনো স্বার্থ নেই। কোনো কৃত্রিমতা ও লৌকিকতা নেই। সন্তানের প্রতি তাদের দরদ স্নেহ ও দয়া-দাক্ষিণ্য হয় নিখাঁদ, নির্মল, নিষ্কলুষ ও খাঁটি। সৃষ্টির মধ্যে তাদের মত দরদি আর কেউ থাকার প্রশ্নই আসতে পারে না। তারা নিজেদের খাওয়া-পরা, আরাম-আয়েশের চিন্তা না করে সন্তানের খাওয়া-পরা, আরাম-আয়েশের ফিকির করেন। এজন্য পরিশ্রম করেন। জীবনবাজি রাখেন। আমাদের প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসে ও জীবনের পরতে পরতে তাদের এত বিপুল অনুগ্রহ ও অবদান বিদ্যমান, যা কখনো শোধ করা সম্ভব নয়। এর দাবি এটাই যে- আমরা তাদের ভালোবাসব, সম্মান করব, খেদমত করব। আন্তরিকতা সঙ্গে তাদের সেবা করব। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহও তা-ই বলেছে। সেবা-যত্ন করে তাদের মন জয় করতে বলেছে। রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন- "যার ওপর তার পিতা-মাতা সন্তুষ্ট, আল্লাহও তার ওপর সন্তুষ্ট। যার ওপর তার পিতা-মাতা অসন্তুষ্ট, আল্লাহও তার ওপর অসন্তুষ্ট।" (তিরমিযি শরীফ ২য় খণ্ড)

সন্তান তার পিতা-মাতার খেদমত করবে, তাদের ভরণ-পোষণ ও দেখভাল করবে, সম্মান ও শ্রদ্ধা করবে- এটাই স্বভাব ও প্রকৃতির চাহিদা। মানবতার দাবি। ইসলামের বিধান ও স্রষ্টার নির্দেশ। সন্তান যত বড় শিক্ষিত, জ্ঞানীগুণী আধুনিক আর প্রগতিশীলই হোক- সে যদি তার পিতা-মাতাকে মর্যাদা দেয় না, খেদমত করে না, খবরগিরি করে না- সে তো মানুষই না। অন্যান্য বহুবিধ গুণ তার থাকলেও মনুষ্যত্ব বা মানবতা-গুণ থেকে সে বঞ্চিত। সন্তানের কাছে এমন অসদগুণ থাকা অকাম্য, অবাঞ্ছিত ও অপ্রত্যাশিত। 

সন্তান কর্তৃক জনক-জননীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধামিশ্রিত খেদমত বড় কথা, মূল বিষয়। যে সেবার মধ্যে স্নেহ-মমতা আছে, সম্মান-শ্রদ্ধা আছে, সংবেদনশীল দরদ আছে- সেটিই খেদমত। সেটিই প্রত্যাশিত। যে সেবা এসব থেকে মুক্ত, সেটা উঠকো আপতিত ঝামেলা, সেটা খেদমত নয়। খেদমত নাম দিলেও, খেদমতের সুরতে করা হলেও- সেটা খেদমত নয়। এমন খেদমতে পিতা-মাতা শান্তি পান না। সন্তুষ্ট হন না। নিজেদের বরং পরনির্ভরশীল, অন্যের ঘাড়ে বোঝা মনে করে কষ্ট পান। মর্মযাতনায় ভোগেন। সন্তানের কাছ থেকে বর্ণিত অর্থে খেদমত পাওয়া- এ তো সন্তানের ওপর মা-বাবার অধিকার। হক্কুল ইবাদ। এটা সন্তানের কোনো অনুগ্রহ নয়, দয়া-দাক্ষিণ্য নয়। এটা আদায় না করলে আল্লাহর আদালতে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জবাবদেহি করতে হবে।

উন্নত পশ্চিমাবিশ্বে বৃদ্ধাশ্রম আছে। সেগুলোতে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের লালন পালন করা হয়। সার্বিক সেবা প্রদান করা হয়। কারণ পাশ্চাত্য দেশসমূহে ছেলে-মেয়ের বয়স ১৮ পেরিয়ে যাবার পর পিতা-মাতার সঙ্গে থাকার বা সম্পর্ক রাখার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। রুজিরোজগার করে সে অর্থ পিতা-মাতাকে দেয়ার কোনো বাধকতা নেই। কেউ তার মা-বাবার সঙ্গে থাকলে কিংবা টাকা-পয়সা দিলে দিতে পারে। এটা তার একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু এ রকম রেওয়াজ নেই। সংস্কৃতি নেই। প্রত্যেকেই যার যার। ফলে সেখানকার প্রবীণরা জীবনের এক পর্যায়ে এসে চরম হতাশা ও অসহায়ত্বের শিকার হন। এ কারণেই বৃদ্ধাশ্রমের উদ্ভব ও ব্যবস্থাপনা। এ বৃদ্ধাশ্রমগুলো দু'ধরনের। কিছু এমন আছে, যেগুলো সেবা দেয় টাকার বিনিময়ে। যেন এটা একটা ব্যবসা। আর কিছু এমন আছে, যেগুলো সরকারে চালায় বা কোনো দাতব্যসংস্থায় চালায়। তারা কেবল সেসব প্রবীণদের বিনে পয়সায় সেবা দেয়, যাদের কেউ নেই, কোনো স্বজন নেই। দ্বিতীয় প্রকারের বৃদ্ধাশ্রমগুলো মানবিক কার্যে ব্যাপৃত। এগুলো কাম্য ও প্রত্যাশিত। আমাদের কথা হলো ১ম প্রকারের বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে।

ব্যবসায়িক বৃদ্ধাশ্রমগুলো পাশ্চাত্যে আছে, থাকবে। থাকুক। কারণ তাদের রীতি-রেওয়াজ ও সংস্কৃতি এমনই। হয়ত কোনো সন্তান তার মা-বাবাকে চেনে না। বা কেউ মাতাকে চিনলেও পিতা কে- তা জানে না। পাশ্চাত্যে বৃদ্ধাশ্রম হতে পারে।

কিন্তু এগুলো মুলিমবিশ্বে সংক্রমিত হবে কেন? বিভিন্ন মুসলিম দেশে অল্প হলেও এর অস্তিত্ব আছে বলে শোনা যায়। বাংলাদেশে আছে কি না- জানি না। কেউ কেউ বলেছেন আছে। মুসলিম দেশগুলোত হবে কেন? মুসলিম রীতি-রেওয়াজ তো এমন নয়। ইসলামি সংস্কৃতি তো এমন নয়। মুসলিমরা এটা গ্রহণ করবে কেন? এ ব্যবস্থাপনায় বাবা-মার হক কি আদায় হবে? এতে তারা কি শান্তি পাবেন? তুষ্ট হবেন? আমি স্ত্রী-সন্তানসহ নিজ বাসায় স্বজনদের মনোরম পরিবেশে অবস্থান করলাম। মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে এলাম। যদিও তাদের ভরণ-পোষণ এবং চিকিৎসাসহ যাতীয় খরচ বহন করছি। কিন্তু ওখানে তারা যে সেবা পাবেন, সেই সেবা হলো প্রাণহীন, নীরস। সেই সেবা হবে কাম্য ভালোবাসাহীন, নিষ্ঠা ও শ্রদ্ধাহীন। আশ্রমওয়ালারাও হয়ত স্নেহ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করে। কিন্তু তাদের প্রদর্শিতগুলো প্রবীণদের কাছে পরম কাম্য নয়। কারণ, ওরা আপন নয়, ওরা পর। এটা তাদের টেকনিক। এরা যা  প্রদর্শন করে তা কৃত্রিম ও লৌকিকতা। নিষ্ঠ খাঁটি ও প্রাণোৎসারিত নয়। মা-বাবাকে আশ্রমে তোলে দিলাম। কিন্তু তারা প্রত্যেহ তো দূরে, কখনো সপ্তাহ পক্ষ বা মাস চলে যায়, সন্তানদের দেখেন না, ছেলেবৌ দেখেন না, নাতি-নাতনিদের দেখেন না। তাদের স্পর্শ পান না। কল-কোলাহল শোনেন না। নাতি-নাতনিদের আদর-সোহাগ করতে পারেন না। আশ্রমে বাহ্যিক যতই তারা ভালো থাকুন, প্রকৃতপক্ষে এটা ভালো থাকা নয়। একটা অপ্রাপ্তি, অপূর্ণতা এবং অভাববোধ সর্বদা তাদের তাড়িত করবে। সন্তানের মুখে আব্বা-আম্মা ডাক যখন মা-বাবা শোনেন- নাতি-নাতনির মুখে যখন দাদু ডাক তারা শোনেন, তখন তাদের মনে যে তৃপ্তি শান্তি ও মিষ্টতা অনুভব করেন, সেটা তারা আশ্রমে কোথায় পাবেন? 

ঠিক আছে ছেলের সংসারের কেউ দিনে বাসায় থাকে না। অফিস, ব্যবসা বা বিদ্যালয়ে ব্যাপৃত থাকে। কিন্তু বিকেলে বা রাতে তো বাসায় আসে। বিশ্রাম করে। রাত্রিযাপন করে। ততক্ষণ তো মা-বাবার সান্নিধ্যে থাকতে পারবে। ততক্ষণ তো মা-বাবা তাদের সন্তানদের স্পর্শসুখ লাভ করতে পারবে। দেখাশোনা করবার জন্য বাসায় লোক রাখো। আশ্রমের বিল তো দিতে পারো। বিকালে এসে তদারকি করবে। 

নিজের প্রতিপালন ও তত্ত্বাবধানে মা-বাবাকে না রেখে কোনো ছেলে যদি ভাবে তারা বৃদ্ধাশ্রমে সুখে থাকবেন, তাহলে নিঃসন্দেহে সেই ছেলে বোকা। নয়ত নির্দয় স্বার্থপর। মা-বাবার কাছে এখন তার আর স্বার্থ নেই। আছে কেবল দায়িত্ব। তাই অন্যের ঘাড়ে দায়িত্ব দিয়ে তাদেরে আশ্রমে সরিয়ে দিয়েছে। তাদের অসহায়ত্বে তার মনে করুণা হয় না। কিন্তু সেই স্বার্থপর পাষাণ ছেলে একবারও কি ভাবে না- শিশুকালে যখন সে দুর্বল পরনির্ভরশীল এবং অসহায় ছিল,  তখন মা-বাবা তাকে অন্য কোথাও সরিয়ে দেননি। এখন মা-বাবার এ বার্ধক্যে অসহায়ত্বে এবং পরনির্ভরশীল অবস্থায় দূর আশ্রমে সরিয়ে দেয়া যে কত নিষ্ঠুর অমানবিক, তা ভাবলেই অন্তর কেঁপে ওঠে।
আসলে প্রবীণদের আশ্রমের খাঁচায় তোলে দেয়া ইসলামি রীতি-রেওয়াজ ও সংস্কৃতির সাথে যায় না। কাজেই এ থেকে মুসলিমদের মুখ ফিরিয়ে নেয়া কর্তব্য। গ্রহণ করা আদৌ সমীচীন নয়।

সাজিদুর রহমান সাজিদ   

লেখক : মুহাদ্দিস জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর, বিয়ানীবাজার, সিলেট।