গর্ভকালীন সময়ে ফিজিওথেরাপীর গুরুত্ব

গর্ভকালীন সময়ে ফিজিওথেরাপীর গুরুত্ব

মেহেরুন্নেসা

গর্ভধারণ বা প্রেগন্যান্সি কোন অসুখ নয়। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। প্রেগন্যান্সি প্রতিটি নারীর জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সুন্দরতম অধ্যায়। যদি পরিবার, সমাজ, সর্বোপরি দেশ এই সময় নারীদের মধ্যে স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারে এবং পর্যাপ্ত যত্ন নিতে পারে তবে প্রত্যেকটি নারীই তার গর্ভকালীন সময়টা কোন প্রকার শারীরিক জটিলতা ছাড়াই উপভোগ করতে পারবে। 

গর্ভকালীন সময়ে বেশি নড়াচড়া বা ব্যায়াম করা, হাঁটাহাঁটি করা যাবে না। এরকম ধারণা অনেকেরই রয়েছে। কিন্তু এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। বর্তমান সময়ে সারা বিশ্বে প্রেগন্যান্সি অবস্থায় নানা ধরণের ব্যায়ামে উৎসাহিত করা হচ্ছে। আমাদের দেশেও প্রেগন্যান্সি অবস্থায় ব্যায়াম সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। 

গর্ভকালীন সময়ে ফিজিওথেরাপী কেন?

১. গর্ভকালীন সময়ে শরীরে রিলক্সিন নামক হরমোন রিলিজ হয়ে থাকে। এ হরমোনের প্রভাবে মায়ের মাংসপেশি, টেনডন, জয়েন্ট ফ্লেক্সিবল হয়। ফলে শিশু মায়ের গর্ভে বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য বেশি জায়গা পায়। এর ফলে মায়ের জয়েন্টের স্ট্যাবিলিটি কমে যায় এবং বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথা শুরু হয়। বিশেষ করে কোমর, ঘাড়, হাঁটু, পায়ের গোড়ালি ইত্যাদি ব্যথা। দিন যত যেতে থাকে শিশুর ওজনও তত বাড়তে থাকে; যার ফলে মায়ের কোমরে চাপ পড়ে। অন্যদিকে সেন্টার অব গ্র্যাভিটি সরে যাওয়ায় স্পাইনে চাপ পড়ে ব্যথার সৃষ্টি হয়। গর্ভকালীন সমেয় ব্যায়াম এইসকল জটিলতা দূর করে মায়ের কষ্ট লাঘব করে। 

২. গর্ভকালীন সময়ে গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করে। 

৩. স্বাভাবিক বা নরমাল ডেলিভারি ত্বরান্বিত করে। 

গর্ভকালীন সময়ে ফিজিওথেরাপীর উপকারিতা:

১. নিয়মিত ব্যায়ামে মাংসপেশির শক্তি বৃদ্ধি পায়। 

২. হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা বাড়ে।

৩. গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিকসের ঝুঁকি কমে। 

৪. মায়ের অতিরিক্ত ওজন বেড়ে যাওয়া থেকে রেহাই পাওয়া যায়।

৫. পায়ে রগটানা, কোমর ব্যথা, পা ফোলার মত সমস্যা কমে যায়। 

৬. মায়ের মধ্যে বিষন্নতা, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি দূর হয়। 

৭. গর্ভকালীন সময়ে কোষ্ঠকাঠিন্য একটা খুব পরিচিত সমস্যা। নিয়মিত ব্যায়ামে এই সমস্যা দূর করা সম্ভব।

কি কি পজিশন মেনে চলা উচিত?

১. এ সমেয় খুব নিয়ম করে সাবধানে উঠা-বসা, শোয়া বা হাঁটার অভ্যাস করতে হবে। 

২. যখন হাঁটবে সামনে না ঝুঁকে বাঁকা না হয়ে সোজা হয়ে হাঁটবে। 

৩. চেয়ারে সোজা হয়ে বসতে হবে। প্রয়োজনে কোমরের পেছনে একটা টাওয়াল রোল করে বা বালিশ দিয়ে সাপোর্ট দিয়ে বসতে হবে।

৪. নিচ থেকে কোন কিছু ঝুঁকে তোলা উচিত নয়।

৫. বাম কাত হয়ে হাঁটুর মাঝে বালিশ দিয়ে শুতে হবে।

৬. পা ক্রস করে বসলে পায়ের ওপর চাপ পড়ে এবং রক্ত চলাচল ব্যহত হয়। তাই এ ধরণের পজিশনে বসা উচিত নয়। 

কি ধরণের ব্যায়াম করা উচিত?

১. হাঁটা, সাঁতার কাঁটা, স্টেশনারি সাইক্লিং, ইয়োগা, ড্যান্সিং ইত্যাদি গর্ভবতী মহিলাদের জন্য চমৎকার, নিরাপদ ও সহজ ব্যায়াম হিসেবে বিবেচ্য। তবে একজন বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ব্যায়াম করা ভাল এবং জেনে নেয়া উচিত এক্ষেত্রে তার জন্য ব্যায়ামের কোন বিধি নিষেধ আছে কি না। 

কি কি ব্যায়াম করা উচিত?

প্রথম ৩ মাস থেকে শেষ পর্যন্ত অন্যান্য ব্যায়ামের পাশাপাশি ৩টা ব্যায়াম নিয়মিত চর্চা করা ভাল। 

 স্কোয়াটিং:  প্রথমে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তারপর হাঁটু ভাজ করে ধীরে ধীরে বসার ভঙ্গি করুন। পুরোপুরি বসবেন না। আধা বসা অবস্থায় থাকবেন। এই ব্যায়ামটি দিনে ২বার; প্রতি সময়ে ১০বার করবেন।

 পেলভিক ফ্লোর এক্সারসাইজ: পেলভিক মাংসপেশি শক্ত বা টানটান করে ১০ সেকেন্ড ধরে রাখুন যেভাবে আমরা প্রসাব আটকে রাখি সেই ভঙ্গিতে। এই ব্যায়ামটি দিনে ২ বার; প্রতি সময়ে ১০-১৫ বার করুন।

 ব্রিদিং এক্সারসাইজ: বসে বা শুয়ে ধীরে ধীরে নাক দিয়ে শ্বাস নিন। ৩-৫ সেকেন্ড শ্বাস ধরে রেখে মুখ দিয়ে শ্বাস ছাড়ুন। একইভাবে ৫-১০ বার এবং দিনে ৩ বেলা করুন।

ফিজিওথেরাপীর কিছু নিয়ম:

১. হাঁটা: হাঁটা খুব ভালো ব্যায়াম। প্রথম ৩ মাস ১৫ মিনিট ধরে হাঁটা, পরের ৩ মাস ২০-২৫ মিনিট এবং শেষের ৩ মাস ১০ মিনিট করে হাঁটুন। খুব বেশি গতিবেগে নয়। মাঝারি গতি অর্থাৎ প্রতি মিনিটে ৬০-৭০ স্টেপ করে হাঁটুন।

২. ব্যায়ামের শুরুতে ৫ মিনিটের ওয়ার্মআপ বা উষ্ণকরণ। তারপর ৫ মিনিটের স্টেচিং এবং শেষে অবশ্যই কুল ডাউন বা শীতলীকরণ প্রক্রিয়া মানতে হবে।

৩. ব্যায়ামের সময় অবশ্যই ঢিলেঢালা পোশাক ব্যায়ামের উপযোগী। সঠিক মাপের জুতা পরিধান করতে হবে। 

৪. একদম খালি পেটে ব্যায়াম করা যাবে না। 

৫. খাওয়ার ১ ঘন্টার মধ্যে ব্যায়ম করা উচিত নয়। ২ ঘণ্টার পর ব্যায়াম করলে ভালো হয়। 

৬. খুব গরম পবিবেশে ব্যায়াম করা যাবে না। 

৭. যেসব ব্যায়ামে হৃদযন্ত্রের স্পন্দন বা হার্টবিট বেড়ে যায় যেমন: দৌঁড়ানো, জ্যাম্পিং ইত্যাদি ব্যায়াম করা যাবে না। 

৮. শ্বাস বন্ধ করা কোন ইয়োগা করা যাবে না।

৯. সবসময় শরীরের কথা শুনতে হবে। শরীরে ক্লান্ত বা ব্যথা থাকলে ব্যায়াম না করাই ভাল। 

১০. আপনার শারীরিক সামর্থের মধ্যে ব্যায়াম করতে হবে। শুরুতে সহজ ব্যায়াম করতে হবে। ধীরে ধীরে রিপিটেশন বাড়াতে হবে।

নিয়মিত সঠিক নিয়মে ব্যায়াম করুন, ভাল থাকুন এবং প্রেগন্যান্সি উপভোগ করুন।

মেহেরুন্নেসা

ফিজিওথেরাপী ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

আদ্-দ্বীন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক হাসপাতাল