সৌদি-ইরান বিরোধ নিস্পত্তিতে ইমরান খান কতটা সফল হবেন?

সৌদি-ইরান বিরোধ নিস্পত্তিতে ইমরান খান কতটা সফল হবেন?

ফাইল ছবি


আসিফ মাহমুদ 
আর্ন্তজাতিক রাজনীতিতে হঠাৎ করে এক আলোচিত ব্যক্তিতে পরিনত হয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। অবশ্য ক্রিকেট তারকা হিসাবে এবং  ব্যক্তিগত জীবনের নানা ঘটনার কারনে অতীতে বিভিন্ন সময় তিনি আর্ন্তজাতিক গনমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন। সম্প্রতি তার নাম আলোচিত হচ্ছে একজন মধ্যস্থতাকারী হিসাবে। নিউইয়র্ক টাইমসের এক খবরে বলা হয়েছে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে বিরোধ নিস্পত্তির জন্য ইমরান খানকে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিয়েছেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। আর এতে সায় দিয়েছে ইরান। 
পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় পরোক্ষ আলোচনার পথে হাঁটছে মধ্যপ্রাচ্যের দুই আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বি সৌদি আরব ও ইরান। দুই দেশের পক্ষ থেকেই এ ব্যাপারে ইতিবাচক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সৌদি আরব সফর করেন। এ সময় রিয়াদ ও তেহরানের মধ্যে মধ্যস্থতার উদ্যোগ নিতে তাকে অনুরোধ করেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান । যুবরাজ ইমরান খানকে বলেন, ‘আমি যুদ্ধ এড়াতে চাই।’ নিউ ইয়র্কে সাম্প্রতিক জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের সাইডলাইনে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেছেন পাকিস্তানি নেতা। রিয়াদের পক্ষ থেকে ইরাককেও অনুরোধ করা হয়েছে; তারাও যেন এ ব্যাপারে ইরানি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে। ইরাকি নেতাদের সাথে ইরানের ঘনিষ্ট যোগাযোগ রয়েছে। এর আগে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী বৈঠক করেন মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে। 
২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবের দুই তেল স্থাপনায় হামলার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে রিয়াদ। ওই হামলার পর সৌদি আরবের তেল উৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসে। এরপরই ইরানের সঙ্গে আলোচনার ব্যাপারে মধ্যস্থতা করতে পাকিস্তান ও ইরাকের শরণাপন্ন হন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।

এই  হামলার ঘটনায় ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা দায় স্বীকার করলেও শুরু থেকেই এ ঘটনায় ইরানকে দায়ী করে আসছে সৌদি আরব। এমন অবস্থায় ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নিতে যুক্তরাষ্ট্রের  সাথে আলোচনা করে রিয়াদ। কিন্তু  রিয়াদের এমন প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি  মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যদিও সৌদি আরবে নতুন করে কয়েকশ সৈন্য পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তা যে, কোনো কার্যকরী উদ্যেগ নয় সৌদি নেতৃত্ব সহজেই অনুধাবন করতে পারে। এরপরই কূটনৈতিক পথে সঙ্কট নিরসনের উদ্যেগ নেন সৌদি যুবরাজ। 
ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে আনুষ্টানিক আলোচনা শুরু না হলেও এমন উদ্যেগকে স্বাগত জানিয়েছে তেহরান। অপরদিকে সৌদি যুবরাজ বলেছেন তিনি যে কোনো পরিস্থিতিতে যুদ্ধ এড়াতে চান। হুথি বিদ্রোহিরাও নতুন করে হামলা হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এ থেকে বোঝা যায় উভয় পক্ষ আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাইছেন। 
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করায় সৌদি আরবের নিরাপত্তা নিয়ে আমেরিকার অঙ্গীকারের বিষয়ে সৌদিদের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। নিজেদের নিরাপত্তার জন্য ওয়াশিংটনের প্রতি রিয়াদের আত্মবিশ্বাস ছিল উপসাগরীয় অঞ্চলে বিগত কয়েক দশকের কৌশলগত বিন্যাসের ভিত্তিস্বরূপ। কিন্তু বড় ধরনের হামলার শিকার হয়েও ইরানের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিতে না পেরে দৃশ্যত হতাশ সৌদি আরব। নিজের ঘনিষ্ঠ মিত্র ওয়াশিংটনই তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে।
ট্রাম্পের বিষয়ে মুসলিম বিশ্বের উদ্বেগ সত্ত্বেও বরাবরই তার প্রতি আগ্রহ ছিল রিয়াদের। ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্পের মুসলিমবিরোধী নিষেধাজ্ঞার ঘটনায় দুনিয়াজুড়ে সমালোচনার মধ্যেই ট্রাম্পকে ‘মুসলমানদের সত্যিকারের বন্ধু’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন সৌদি আরবের বর্তমান যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। 
২০১৭ সালের ১৪ মার্চ হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি বলেন, ‘মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে কাজ করার বিষয়ে ট্রাম্পের অভূতপূর্ব আগ্রহ রয়েছে। তিনি মুসলমানদের সত্যিকারের বন্ধু। তার অভিবাসন নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্যবস্তু  ইসলাম এমনটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। বরং একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে সন্ত্রাসীদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে বাধা দিতেই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’ ট্রাম্পের কথিত শান্তি পরিকল্পনা মেনে নিতে সৌদি যুবরাজ ফিলিস্তিনের প্রতি ও তীব্র  চাপ তৈরি করেছিলেন বলে খবর এসেছিল। কিন্তু এখন আক্রান্ত হওয়ার পরও ইরানের বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসনকে কাছে না পেয়ে রিয়াদকে সংকটের নিজস্ব সমাধান খুঁজতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই আচরন সৌদি আরবের জন্য হতাশাজনক। 
সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে সঙ্কট নিরসনে মধ্যস্থতার এই উদ্যেগ অস্থির মধপ্রাচ্য পরিস্থিতিতে এক ধরনের আশার সঞ্চার করেছে। কারন অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে যুদ্ধপরিস্থিতি অনিবার্য হয়ে উঠছিলো। এমন অবস্থা সৃষ্টি হলে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয় গোটা বিশ্বে এর প্রভাব পড়বে। 
রিয়াদের পক্ষ থেকে নিউ ইয়র্ক টাইমসের কাছে ইরানের সঙ্গে মধ্যস্থতার ব্যাপারে সৌদি আরবের পক্ষ থেকে পাকিস্তান ও ইসলামাবাদের শরণাপন্ন হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে সরাসরি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এ অনুরোধ করেছেন বলে যে খবর বেরিয়েছে, তা অস্বীকার করেছে রিয়াদ।
ইরানের পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হচ্ছে, তাদের দিক থেকে আলোচনার ব্যাপারে কোনও আপত্তি নেই। এ ব্যাপারে তেহরানের অবস্থান উন্মুক্ত। সম্প্রতি এ ব্যাপারে আল জাজিরার সঙ্গে কথা বলেন ইরানের স্পিকার আলী লারিজানি। তিনি বলেন, সৌদি আরব এবং এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সংলাপের ব্যাপারে ইরান উন্মুক্ত। ইরান-সৌদি সম্পর্ক এ অঞ্চলের নিরাপত্তাগত ও রাজনৈতিক বহু সমস্যা সমাধানে সক্ষম। ইরাকের প্রধানমন্ত্রী আদিল আবদুল মাহদী আল জাজিরাকে জানান, তার বিশ্বাস তেহরানের সঙ্গে উত্তেজনার পারদ কমিয়ে আনতে চাইছে রিয়াদ।
আদিল আবদুল মাহদী বলেন, প্রত্যেকেই আলোচনার ব্যাপারে উন্মুক্ত। ইরান বলছে, নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলে তারা আলোচনায় আগ্রহী। যুক্তরাষ্ট্রও আলোচনার কথা বলছে। সৌদি আরবও আলোচনার দ্বার বন্ধ করে দেয়নি।  ইরানের সাথে মধ্যস্থতার ব্যাপারে ইমরান খানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সবুজ সংকেত রয়েছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। কারন ইরানের সাথে আলোচনার ব্যাপারে একাধিকবার যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আগ্রহ দেখানো হয়েছিলো। যদিও ইরানের নেতারা তা প্রত্যাখান করেছেন। এখন পাকিস্তান ও ইরাকের মধ্যস্থতার যদি সৌদি আরবের সাথে ইরানের আলোচনা শুরু করা যায় তাকে একধাপ অগ্রগতি হিসাবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। 
ইরানের সাথে মধ্যস্থতায় ইরাকের উদ্যেগের পাশাপাশি সৌদি যুবরাজ কেন ইমরান খানকে বেছে নিলেন। আর এতে কতটা সফল হবেন তিনি। ইরানের কাছেই বা ইমরান খানের গ্রহনযোগ্যতা কতটুকু।
আর্ন্তজাতিক পরিসরে ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থ নিয়ে ইমরান খান বেশি কিছুদিন থেকে বেশ সোচ্চার। তার সাথে যোগ দিয়েছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েপ এরদোগান। যদিও সৌদি আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে তুরস্কের সর্ম্পক ভালো নয়। মধ্যপ্রাচ্যে মালয়েশিয়ার খুব একটা প্রভাব নেই। কিন্তু পাকিস্তানের সাথে এসব দেশের রয়েছে সুসসর্ম্পক। উপসাগরীয় অনেক দেশের প্রতিরক্ষার সাথে পাকিস্তানের রয়েছে নিবিড় সর্ম্পক। আবার ইরানের সাথে সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের সর্ম্পক বেশ অগ্রগতি হয়েছে। সৌদি যুবরাজের সাথে ইমরান খান বিশেষ সর্ম্পক গড়ে তুলতে পেরেছেন। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সঙ্কটে সৌদি যুবরাজ ইমরানের পাশে দাড়িয়েছেন। ফলে সৌদি যুবরাজের ইমরান খানকে এমন প্রস্তাব দেয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু গুরুত্বপূর্ন প্রশ্ন হচ্ছে মধ্যস্থততা কতটা সফল হবে?
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন ইরান-সৌদি বিরোধে মধ্যস্থতায় সফল হওয়া অনেক কঠিন। দুদেশের মধ্যে বিরোধ ঐতিহাসিক। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারে দুদেশের রয়েছে মরিয়া প্রচেষ্টা। লেবানন, সিরিয়া ও ইরাকের আভ্যন্তরিন রাজনীতির নানা দিক দুদেশের সর্ম্পককে প্রভাবিত করে। এছাড়া ইসরাইলের ভুমিকা তো আছেই। এরপরও দুদেশ যে মধ্যস্থততায় রাজি হয়েছে এটি একটি অর্জন। তবে সকল পক্ষ যেহেতু যুদ্ধ এড়ানোর ব্যাপারে একমত হয়েছে ফলে কিছুটা হলেও সফলতা আসবে বলে আশা করা যায়।