কুরআন-হাদীসের আলোকে তওবার বিধান

কুরআন-হাদীসের আলোকে তওবার বিধান

ফাইল ছবি

ড. মো: হাবিবুর রহমান

আল্লাহ তাআলা এই পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদতের জন্য, তারই গোলামী করার জন্য। আল্লাহ বলেন, وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ “আমি মানুষ ও জ্বীনকে সৃষ্টি করেছি শুধুমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য।” (সূরা জারিয়াত-৫৬) পৃথিবীতে চলার পথে বাকে বাকে শয়তানের কুমন্ত্রনায় পড়ে মানুষ আল্লাহর এই বিধানের কথা ভুলে গিয়ে মাঝে-মধ্যে অন্যায়-অপকর্মে পতিত হয়ে যায়। এটাই ছিলো শয়তানের চ্যালেঞ্জ যে, শয়তান বিভিন্নভাবে মানুষকে পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা করবে। আল-কুরআনে বলা হয়েছে, 

ثُمَّ لَآتِيَنَّهُمْ مِنْ بَيْنِ أَيْدِيهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَانِهِمْ وَعَنْ شَمَائِلِهِمْ وَلَا تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شَاكِرِينَ

“তারপর অবশ্যই তাদের নিকট উপস্থিত হব, তাদের সামনে থেকে ও তাদের পেছন থেকে এবং তাদের ডান দিক থেকে ও তাদের বাম দিক থেকে। আর আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না’। (সূরা আরাফ-১৭) 

আল-কুরআন থেকে জানা যায়, আমাদের পিতা হযরত আদম (আ.) শয়তানের কুমন্ত্রনায় পড়ে ভুল করেছিলেন, যার কারনে তাকে জান্নাত থেকে দুনিয়ার ধরাধামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। অতঃপর তিনি নিজ ভুলের জন্য অনুশোচনা করে আল্লাহর কাছে তওবা করেছিলেন, আল্লাহ সে তওবা কবুল করেছিলেন। আল্লাহ তাআলা হযরত আদম (আ.) কে একথাও বলে দিলেন, আমার পক্ষ থেকে জীবন পরিচালনার জন্য হেদায়াতের বিধান পাঠানো হবে, যারা আল্লাহর এ বিধান মেনে চলবে তাদের কোন ভয় নেই, তারা চিন্তিতও হবে না। আল্লাহ বলেন, فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنِّي هُدًى فَمَنْ تَبِعَ هُدَايَ فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ  “অতঃপর যখন আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে কোন হিদায়াত আসবে, তখন যারা আমার হিদায়াত অনুসরণ করবে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।” (সূরা আল-বাকারা-৩৮) 

এর দ্বারা বুঝা যায়, বনি আদম দুনিয়ার জীবনে চলার পথে ভুল করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে ভুল করে সে ভুলের উপরে প্রতিষ্ঠিত থাকলে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। বরং বান্দাহ যদি ভুল করে, সে ভুলের জন্য অনুশোচনা করে আল্লাহর কাছে তওবা করে, আল্লাহ তাআলা বান্দার সে তওবা কবুল করেন এবং তাকে উত্তম প্রতিদান প্রদান করেন। নিম্নে কুরআন-হাদীসের আলোকে তওবার বিধান সম্পর্কে  আলোকপাত করা হলোঃ

অন্যায় কাজ করার সাথে সাথে অনুশোচনা করে তওবা করা: 

ইসলামে তওবার নীতিই হচ্ছে মানুষ যদি ভুলক্রমে অন্যায় কাজ করে ফেলে তাহলে সাথে সাথে আল্লাহকে স্বরণ করতে হবে এবং নিজের গুনাহের জন্য আল্লাহর কাছে তওবা করতে হবে। এমন তওবাকারীকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, 

وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللَّهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ وَمَنْ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا اللَّهُ وَلَمْ يُصِرُّوا عَلَى مَا فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ 

“আর যারা কোন অশ্লীল কাজ করলে অথবা নিজদের প্রতি যুলম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে, অতঃপর তাদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর আল্লাহ ছাড়া কে গুনাহ ক্ষমা করবে? আর তারা যা করেছে, জেনে শুনে তা তারা বার বার করে না। (সূরা আলে-ইমরান- ১৩৫) 

যারা অন্যায় কাজ করার পরে তওবা করে, নিজের ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থণা করে, আল্লাহ তাদেরকে ভালো বাসেন। এ সকল তওবাকারীর জন্য আল্লাহর কাছে রয়েছে মাগফিরাত এবং ঐ জান্নাত যার তলদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,

أُولَئِكَ جَزَاؤُهُمْ مَغْفِرَةٌ مِنْ رَبِّهِمْ وَجَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَنِعْمَ أَجْرُ الْعَامِلِينَ

“এরাই তারা, যাদের প্রতিদান তাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও জান্নাতসমূহ যার তলদেশে প্রবাহিত রয়েছে নহরসমূহ। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আর আমলকারীদের প্রতিদান কতই না উত্তম!” (সূরা আলে-ইমরান- ১৩৬) 

মুমিনের বৈশিষ্ট সে তওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসবে:

মুমিনের অভিভাবক হচ্ছেন আল্লাহ তাআলা। তাই একজন খাঁটি মুমিনের বৈশিষ্ট হচ্ছে সে একনিষ্ঠভাবে তওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসবে। তাহলে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের জীবনে ঘটে যাওয়া পাপগুলো ক্ষমা করে দিবেন এবং তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আল-কুরআনের বাণী- 

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَصُوحًا عَسَى رَبُّكُمْ أَنْ يُكَفِّرَ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ

“হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা কর, খাঁটি তওবা; আশা করা যায় তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত।” (সূরা তাহরীম-৮) 

একজন মুমিন যদি ভুল করে ফেলে তাহলে সাথে সাথে তওবা-ইসতেগফার করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসবে। এটাই হচ্ছে মুমিনের পরিচয়। আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,  

عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَثَلُ الْمُؤْمِنِ وَمَثَلُ الْإِيمَانِ كَمَثَلِ الْفَرَسِ فِي آخِيَّتِهِ يَجُولُ ثُمَّ يَرْجِعُ إِلَى آخِيَّتِهِ وَإِنَّ الْمُؤْمِنَ يَسْهُو ثُمَّ يَرْجِعُ إِلَى الْإِيمَانِ   

“হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) নবী (সা.) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, নবী (সা.) বলেছেন, মু’মিন ও ঈমানের দৃষ্টান্ত হচ্ছে খুঁটিতে বাঁধা ঘোড়ার ন্যায়। সে সীমানা অতিক্রম করে চলে যায় আবার খুঁটির নিকট ফিরে আসে। অতঃপর মুমিন ভুল করে, আবার ঈমানের দিকে ফিরে আসে। (মুসনাদে আহমদ) 

আদম সন্তান হিসেবে মুমিনও ভুল করতে পারে। আর যদি কোন মুমিন ভুলবশত অন্যায়-অপকর্ম করে বসে, তার সংশোধনের পন্থা কি হবে রাসূল (সা.) এ হাদীসের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহকে জানিয়ে দিয়েছেন। একজন সত্যিকার মুমিন ভুল করলে সাথে সাথে সে অনুশোচনা করে আল্লাহকে স্বরণ করবে এবং তওবা-ইস্তেগফার করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসবে। এ সকল মুমিনকে আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করে দিবেন এবং প্রতিদান হিসেবে জান্নাত দান করবেন।  

তওবার নীতি হচ্ছে জেনে-বুঝে বার বার ভুল না করা:

জেনে-বুঝে বার বার ভুল করলে এবং বার বার তওবা করলে সেটা আল্লাহর নাফরমানির পর্যায় পড়ে এজন্য এমন তওবাকারীকে আল্লাহ কখনো মাফ করবেন না বরং পরকালীন জীবনে তাদের শাস্তি হচ্ছে জাহান্নাম। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বলা হয়েছে, 

وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ حَتَّى إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ إِنِّي تُبْتُ الْآنَ وَلَا الَّذِينَ يَمُوتُونَ وَهُمْ كُفَّارٌ أُولَئِكَ أَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا

“আর তওবা নাই তাদের, যারা অন্যায় কাজ করতে থাকে, অবশেষে যখন তাদের কারো মৃত্যু এসে যায়, তখন বলে, আমি এখন তওবা করলাম, আর তওবা তাদের জন্য নয়, যারা কাফির অবস্থায় মারা যায়; আমি এদের  জন্যই  তৈরী করেছি যন্ত্রণাদায়ক আযাব।” (সূরা আন-নিসা-১৮)  

যারা ঈমান এনেছে, আবার কুফুরী করেছে, আবার ঈমান এনেছে, আবার কুফুরী করেছে তাদের জন্য তওবার তওবার দরজা খোলা নেই। আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন না এবং তাদের সঠিক পথের সন্ধানও দেবেন না। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, 

إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا ثُمَّ كَفَرُوا ثُمَّ آمَنُوا ثُمَّ كَفَرُوا ثُمَّ ازْدَادُوا كُفْرًا لَمْ يَكُنِ اللَّهُ لِيَغْفِرَ لَهُمْ وَلَا لِيَهْدِيَهُمْ سَبِيلًا

“নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে তারপর কুফরী করেছে, আবার ঈমান এনেছে তারপর কুফরী করেছে, এরপর কুফরীকে বাড়িয়ে দিয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করার নন এবং তাদেরকে পথ প্রদর্শন করার নন।” (সূরা আন-নিসা-১৩৭) 

মরনের সময় তওবা করলে আল্লাহ তওবা কবুল করবেন না:

আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক ব্যক্তি, জাতি-গোষ্ঠীর জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এ সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে সে আর দুনিয়ায় থাকতে পারবেনা। এটা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত চুড়ান্ত বিধান। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, 

وَلَنْ يُؤَخِّرَ اللَّهُ نَفْسًا إِذَا جَاءَ أَجَلُهَا وَاللَّهُ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ 

“আর আল্লাহ কখনো কোন প্রাণকেই অবকাশ দেবেন না, যখন তার নির্ধারিত সময় এসে যাবে। আর তোমরা যা কর সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত।” (সূরা মুনাফিকুন ১১) 

وَلِكُلِّ أُمَّةٍ أَجَلٌ فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ

“আর প্রত্যেক জাতির রয়েছে একটি নির্দিষ্ট সময়। অতঃপর যখন তাদের সময় আসবে, তখন তারা এক মুহূর্ত বিলম্ব করতে পারবে না এবং এগিয়েও আনতে পারবে না।” (সূরা আরাফ-৩৪) 

আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত মুহুর্ত আসার আগ পর্যন্ত অর্থাৎ মালাকুল মাউত (মৃত্যুর ফেরেশতা) শিওরে আসার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত তওবার দরজা খোলা থাকে। মালাকুল মাউত এসে যাওয়ার সাথে সাথে তওবার দরজা বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় যদি কেউ তওবা করে আল্লাহ সে তওবা কবুল করবেন না। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, 

وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ حَتَّى إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ إِنِّي تُبْتُ الْآنَ وَلَا الَّذِينَ يَمُوتُونَ وَهُمْ كُفَّارٌ أُولَئِكَ أَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا 

“আর তওবা নাই তাদের, যারা অন্যায় কাজ করতে থাকে, অবশেষে যখন তাদের কারো মৃত্যু এসে যায়, তখন বলে, আমি এখন তওবা করলাম, আর তওবা তাদের জন্য নয়, যারা কাফির অবস্থায় মারা যায়;  আমি  এদের  জন্যই  তৈরী করেছি যন্ত্রণাদায়ক আযাব।” (সূরা আন-নিসা-১৮)  

আল্লাহর দ্বীনের চরম বিরোধিতাকারী ফিরাউন ও তার পারিষদবর্গকে আল্লাহ যখন মিসরের নীলনদ ও লোহিত সাগরের মোহনায় সলিল সমাধি করলেন। ফেরাউন ও তার দলবল সাগরের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে, মুত্যু ছাড়া এখন আর কোন পথ নেই তখন ফিরাউন আল্লাহর উপরে ঈমান আনার ঘোষণা দেয়। আল্লাহ তার সে ঈমান কবুল করেননি। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, 

وَجَاوَزْنَا بِبَنِي إِسْرَائِيلَ الْبَحْرَ فَأَتْبَعَهُمْ فِرْعَوْنُ وَجُنُودُهُ بَغْيًا وَعَدْوًا حَتَّى إِذَا أَدْرَكَهُ الْغَرَقُ قَالَ آمَنْتُ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا الَّذِي آمَنَتْ بِهِ بَنُو إِسْرَائِيلَ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ

“আর আমি বনী ইসরাঈলকে সমুদ্র পার করিয়ে নিলাম। আর ফিরাউন ও তার সৈন্যবাহিনী ঔদ্ধত্য প্রকাশ ও সীমালঙ্ঘনকারী হয়ে তাদের পিছু নিল। অবশেষে যখন সে ডুবে যেতে লাগল, তখন বলল, ‘আমি ঈমান এনেছি যে, সে সত্তা ছাড়া কোন ইলাহ নেই, যার প্রতি বনী ইসরাঈল ঈমান এনেছে। আর আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত’।” (সূরা ইউনূচ- ৯০) 

আল্লাহ তাআলা তার ঈমানকে কবুল করেননি বরং আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীবাসীর জন্য নিদর্শন ও শিক্ষণীয় হিসেবে ফিরাউনের লাশকে সংরক্ষণ করে রেখে দেওয়ার ঘোষণা দিলেন। আল্লাহ বলেন,

آلْآنَ وَقَدْ عَصَيْتَ قَبْلُ وَكُنْتَ مِنَ الْمُفْسِدِينَ  فَالْيَوْمَ نُنَجِّيكَ بِبَدَنِكَ لِتَكُونَ لِمَنْ خَلْفَكَ آيَةً وَإِنَّ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ عَنْ آيَاتِنَا لَغَافِلُونَ

“এখন অথচ ইতঃপূর্বে তুমি নাফরমানী করেছ, আর তুমি ছিলে ফাসাদকারীদের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং আজ আমি তোমার দেহটি রক্ষা করব, যাতে তুমি তোমার পরবর্তীদের জন্য নিদর্শন হয়ে থাক। আর নিশ্চয় অনেক মানুষ আমার নিদর্শনসমূহের ব্যাপারে গাফেল।” (সূরা ইউনূচ- ৯১-৯২) 

পৃথিবীর বুকে এ রকম অনেক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, যারা সারা জীবন ইসলামের বিরোধিতা করেছে আর যেই জীবনের শেষ মুহুর্তে উপনীত হয়েছে তখন তওবা করে আল্লাহর উপরে ঈমান আনার ঘোষণা দিয়েছে। আল্লাহ এসকল লোকদের ঈমান কবুল করেননি বরং তাদের জন্য জাহান্নামের কঠিন শাস্তির ঘোষণা দিয়েছেন। তাই মৃত্যু আসার আগেই আমাদের খালেস নিয়তে তওবা করতে হবে এবং ভালো কাজ করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, 

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ ، قَالَ : خَطَبَنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى الله عَليْهِ وسَلَّمَ فَقَالَ : يَا أَيُّهَا النَّاسُ , تُوبُوا إِلَى اللهِ قَبْلَ أَنْ تَمُوتُوا، وَبَادِرُوا بِالأَعْمَالِ الصَّالِحَةِ قَبْلَ أَنْ تُشْغَلُوا

“হযরত যাবির ইবনে আবদুল্লাহ হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা.) খুতবার মধ্যে বললেন, হে মানব সকল! মৃত্যু আসার পূর্বেই তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা করো এবং ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার আগেই সৎ কাজ করার উদ্যোগ গ্রহণ করো।” (সূনান ইবনে মাযা) 

তওবা তাদের জন্য যারা ভুলবশত গুনাহ করেছে এবং তওবা করেছে: 

যারা ভুলবশত গুনাহ করেছে এবং খালেস নিয়তে তওবা করেছে আল্লাহ তাদের জন্য রেখেছেন ক্ষমার দরজা। আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করবেন এবং তাদের সকল গুনাহ মাফ করে দিবেন। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, 

إِنَّمَا التَّوْبَةُ عَلَى اللَّهِ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السُّوءَ بِجَهَالَةٍ ثُمَّ يَتُوبُونَ مِنْ قَرِيبٍ فَأُولَئِكَ يَتُوبُ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَكَانَ اللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا

“নিশ্চয় তওবা কবূল করা আল্লাহর জিম্মায় তাদের জন্য, যারা অজ্ঞতাবশত মন্দ কাজ করে। তারপর শীঘ্রই তওবা করে। অতঃপর আল্লাহ এদের তওবা কবুল করবেন আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।” (সূরা আন-নিসা-১৭) 

 

আল্লাহর কাছে খালেস নিয়তে তওবাকারীকে আল্লাহ শুধু ক্ষমাই করেন না বরং তার পূর্বের অন্যায় কাজগুলোকে ভালো কাজ দ্বারা পরিবর্তন করে দিয়ে আমলনামা পূণ্যকর্ম দ্বারা ভারী করে দেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, 

إِلَّا مَنْ تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ عَمَلًا صَالِحًا فَأُوْلَئِكَ يُبَدِّلُ اللّهُ سَيِّئَاتِهِمْ حَسَنَاتٍ وَكَانَ الَّهُ غَفُوْرًا رَحِيْمًا

“তবে তারা ছাড়া যারা তওবা করেছে এবং ঈমান এনে সৎকাজ করেছে, এ ধরনের লোকদের অসৎকাজ গুলোকে আল্লাহ সৎকাজ দ্বারা পরিবর্তন করে দিবেন এবং আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও মেহেরবান।” (সূরা ফুরকান-৭০)                     

এই সুসংবাদ সম্বলিত ঘোষণা তাদের জন্য যারা নানা প্রকার অপরাধের কলংকে কলংকিত হয়েছে। এখন তারা নিজেদের সংশোধন করতে ইচ্ছুক ও আগ্রহী। এটা সাধারণ ক্ষমার একটি সুমহান ঘোষণা।

এ সাধারণ ক্ষমার ফলাফল :

 এই ধ্বংসম্মুখ সমাজের লক্ষ লক্ষ মানুষের মুক্তির পথ দেখিয়ে চুড়ান্ত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা।

 গাফুর্রুরাহীম আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ক্ষমার ঘোষণা না থাকলে মানুষ নিরাশ হয়ে যেত এবং নৈরাশ্য তাদেরকে ইবলিস বানিয়ে ফেলত।

এজন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেখানেই জাহান্নামের কথা বর্ণনা করেছেন তার পরেই জান্নাতের বর্ণনা দিয়েছেন। বান্দাহ জাহান্নামের আযাবের কথা শুনতে শুনতে ভয়ে হতাশা-নিরাশায় যাতে হয়রান না হয়ে যায় সেজন্য সাথে সাথে আবার আশার সঞ্চার করেছেন, জান্নাতের মহাসুখ ও তওবার কথা বলেছেন। আল্লাহ তাআলা জাহান্নামের বর্ণনা দেওয়ার পরে বলেছেন, قُلْ أَذَلِكَ خَيْرٌ أَمْ جَنَّةُ الْخُلْدِ الَّتِي وُعِدَ الْمُتَّقُونَ كَانَتْ لَهُمْ جَزَاءً وَمَصِيرًا “বল, ‘সেটা উত্তম না স্থায়ী জান্নাত, মুত্তাকীদেরকে যার ওয়াদা দেয়া হয়েছে, তা হবে তাদের পুরস্কার ও প্রত্যাবর্তনস্থল।” (সূরা ফুরকান- ১৫) 

ইবনে জারির আত-তাবারির বর্ণনা :

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি একদিন এশার নামাজ আদায় করে মসজিদ হতে বড়িতে ফিরছিলাম। এমন সময় দেখতে পেলাম আমার দুয়ারে একজন স্ত্রীলোক দাড়ানো আমি তাকে সালাম জানিয়ে ভিতরে গেলাম এবং দুয়ার বন্ধ করে নফল নামাযে দাড়িয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর স্ত্রী লোকটি দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলো। আমি উঠলাম, দুয়ার খুললাম এবং স্ত্রী লোকটি কি চায় জিজ্ঞাসা করলাম। স্ত্রী লোকটি বললো, আমার দ্বারা জ্বিনা সংঘঠিত হয়েছে। আমার পেটে তাতে অবৈধ সন্তান এসেছিল সে সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর আমি তাকে মেরেফেলেছি। এখন আমি জানতে চাই আমার এ গুনাহ হতে মাফ পাওয়ার কোন উপায়, পথ আছে কি না? আমি বললাম কখনো নয়, কোন ক্রমেই তোমার গুনাহ মাফ হবে না। সে বড় দুঃখ ভরাক্রান্ত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাঁদতে কাঁদতে চলতে থাকলো এবং বলতে লাগলো, হায়! এই রূপ সৌন্দর্য্য জাহান্নামের আগুনে জ্বলার জন্য তৈরী হয়েছিল। পর দিন ফজরের নামাজ শেষ হলে, রাসূল (সা.) কে গত রাতের ঘটনা শুনালাম। তিনি বললেন, আবু হুরায়রা তুমি বড়ই ভুল জবাব দিয়েছ, তুমি কি কুরআনের এ আয়াত পড়নি-

 وَالَّذِينَ لَا يَدْعُوْنَ مَعَ اللّهِ إِلَهًا آخَرَ وَلَا يَقْتُلُوْنَ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَلَا يَزْنُوْنَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ يَلْقَ أَثَامًا(৬৮)يُضَاعَفْ لَهُ الْعَذَابُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَيَخْلُدْ فِيْهِ مُهَانًا(৬৯)إِلَّا مَنْ تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ عَمَلًا صَالِحًا فَأُوْلَئِكَ يُبَدِّلُ اللّهُ سَيِّئَاتِهِمْ حَسَنَاتٍ وَكَانَ اللَّهُ غَفُوْرًا رَحِيمًا(৭০)

“তারা আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপস্যকে ডাকে না, আল্লাহ যে প্রাণকে হারাম করেছেন কোন সংগত কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করেনা এবং ব্যাভিচার করে না। এ সব যেই করে সে তার গুনাহের শাস্তি ভোগ করবে। কিয়ামতের দিন, তাকে উপর্যুপুরি শস্তি দেওয়া হবে এবং সেখানেই সে লাঞ্চিত অবস্থায় চিরকাল পড়ে থাকবে। তবে তারা ছাড়া যারা তওবা করেছে এবং ঈমান এনে সৎকাজ করেছে, এ ধরনের লোকদের অসৎকাজ গুলোকে আল্লাহ সৎকাজ দ্বারা পরিবর্তণ করে দিবেন এবং আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও মেহেরবান”  (সূরা ফুরকান-৬৮-৭০)

রাসূল (সা.) এর কথা শুনে তাৎখনাত বের হয়ে গেলাম এবং মহিলাকে খুজতে লাগলাম। এশার সময় তাকে পেলাম। আমি তাকে সুসংবাদ শুনিয়ে দিলাম এবং বল্লাম নবীজী (সা.) তোমার প্রশ্নের এ জওয়াব দিয়েছেন। মহিলাটি এ সংবাদ শুনার সাথে সাথে সিজদায় পড়ে গেল এবং বলতে থাকলো, সেই আল্লাহর শোকর যিনি আমার জন্য ক্ষমার দরজা খুলে দিয়েছেন। তারপর সে গুনাহ হতে তওবা করল এবং নিজ দাসীকে তার পুত্রসহ আযাদ করে দিলো।

এ আয়াতের আলোকে তওবা করার পর নিজের ভুলত্রুটি স্মরণ করে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হওয়া এবং ক্ষমা প্রার্থণা করাই একটি বড় নেক আমল। 

তওবার নীতি :

১. কৃত অপরাধের জন্য অনুশোচনা ও ক্ষমা প্রার্থণা করা,

২. বর্তমানে ঐ অপরাধগুলো থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা,

৩. ভবিষ্যতে ঐ অপরাধ না করার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প হওয়া,

৪. হক্কুল ইবাদ (বান্দাহর অধিকার) সংশ্লিষ্ট অপরাধ হলে ব্যক্তির হক্ক আদায় অথবা জীবদ্দশায় ক্ষমা চেয়ে নেওয়া। 

যদি হক্কুল ইবাদ সংশ্লিষ্ট কোন অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট বান্দাহর কাছ থেকে বিষয়টা মিটিয়ে নিতে হবে। যদি সে ক্ষমা করে দেয় তাহলে আল্লাহই ক্ষমাকারী। আর যদি এ অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে তাহলে পরকালে তার পাওনা পরিশোধ করতে হবে। আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-

عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ اَنَّ رَسُوْلَ اللّهِ صلعم قَالَ أ تَدْرُوْنَ مَا الْمُفْلِسْ قَالُوْا اَلْمُفْلِسُ فِيْنَا مَنْ لَا دِرْهَمَ لَهُ وَلاَ مَتَاعَ قَالَ اِنَّ الْمُفْلِسَ‌ مِنْ اُمَّتِىْ مَنَ يَّوْمَ الْقِيَامَتِ بِصَلَوَاةٍ وَّ صِيَامٍ وَّ ذَكَوَةٍ وَ يَاْتِىْ قَدْ شَتَمَ هَذَا وَ قَذَفَ هذَا وَ اَكَلَ مَالَ هَذَا وَ سَفَكَ دَامَ هَذَا وَ ضَرَبَ هَذَا فَيُعْطى هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ فَاِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتِه قَبْلَ اَنْ يَقْضَ مَا عَلَيْهِ أُخِذِ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَتْ عَلَيِ ثُمَّ طُرِحَ فِىْ النَّارِ  (رَوَاهُ مُسْلٍيْم)

“হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমরা কি জান দরিদ্র কে? লোকেরা বললেন আমাদের মধ্যে সেই দরিদ্র যার টাকা পয়সা ও ধনসম্পদ নেই। রাসূল (সা.) বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে সেই প্রকৃত দরিদ্র যে কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণ নামাজ, পরিপূর্ণ রোজা ও পরিপূর্ণ জাকাত সহকারে আল্লাহর দরবারে হাজির হবে এবং তারই সাথে দুনিয়াতে কাউকে গালি দিয়ে থাকবে, কাউকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে থাকবে, কারো মাল সম্পদ অন্যায় ভাবে ভক্ষণ করে থাকবে। কাউকে হত্যা করে থাকবে অথবা কাউকে অন্যায়ভাবে প্রহার করে থাকবে। তাদের পাওনা পরিশোধ করতে এসব মজলুমদের মধ্যে তার সব নেক আমল বন্টন করে দেওয়া হবে, এভাবে মজলুমদের পাওনা পরিশোধ করার পূর্বেই তার সকল নেক আমল শেষ হয়ে যাবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।”  (সহীহ মুসলিম)

উপরের আলোচনা থেকে একথা বলা যায়, মানুষের জীবন পরিচালনার বাকে বাকে শয়তানের প্রবঞ্চনায় পড়ে অন্যায় কাজ সংঘটিত হয়ে যেতে পারে, সে অন্যায় থেকে পরিত্রান পাওয়ার জন্য মহান আল্লাহ তাআলা তওবার দরজা খুলে রেখেছেন। তাই আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, সব সময় অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করতে হবে, এর পরেও যদি অন্যায় হয়ে যায়, সাথে সাথে তওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, وَسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ “আর তোমরা দ্রুত অগ্রসর হও তোমাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও জান্নাতের দিকে, যার পরিধি আসমানসমূহ ও যমীনের সমান, যা মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।” (সূরা আলে-ইমরান-১৩৩) আল্লাহ আমাদেরকে জান্নাতের পথে শামিল থাকার তৌফিক দান করুন। আমীন।