ভারতের বিমান বাহিনী কতটা শক্তিশালী?

ভারতের বিমান বাহিনী কতটা শক্তিশালী?

রাফায়েল বিমানে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং


ভারতের বিমান বাহিনীর আধুনিকায়নের জন্য বড় ধরনের পরিকল্পনা নিয়েছে দেশটির সরকার।  ফ্রান্সের কাছ থেকে ৩৬টি রাফাল জঙ্গিবিমান কেনার জন্য মোদি সরকার ২০১৬ সালে চুক্তি করে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রতিষ্টা বার্ষিকীতে রাফালের প্রথম চালন গ্রহন উপলক্ষে রাফালের নির্মাতা ডসাল্ট এভিয়েশনের বরদিউ কারখানায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে যোগ দেন তার ফরাসী প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফ্লোরেন্স পার্লে।ভারতীয় পতাকায় মোড়া, সাজানো রাফালের পাশে দাঁড়িয়ে সিং দিনটিকে ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীর জন্য ঐতিহাসিক ও মাইলফলক হিসেবে অভিহিত করেন। রাফাল ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীকে শক্তি বাড়াবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।


২০১৬ সালে রাফাল কেনার জন্য চুক্তি হলেও এতে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় সরবরাহ কাজ আটকে যায়। বিরোধী দল কংগ্রেস এই অভিযোগ তোলে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কংগ্রেসকে অভিযুক্ত করেন দেশের নিরাপত্তাকে খাটো করার জন্য। তিনি বলেন, ভারতের হাতে রাফাল থাকলে কাশ্মীরের যুদ্ধে ভারতের মুখ উজ্জ্বল হতো।


কংগ্রেস আগেই রাফাল কেনার জন্য চুক্তি করেছিলো। কিন্তু ২০১৫ সালে ফ্রান্স সফরে গিয়ে সেই চুক্তি বাতিল করেন মোদি। তার বদলে ৩৬টি রাফালের অর্ডার দেন। এর সবগুলোই ফ্রান্সে তৈরি হবে। তখন চুক্তির অংক ছিলো ৯.৪ বিলিয়ন ডলার।নতুন চুক্তিতে এভিয়েশন খাতে স্বল্প অভিজ্ঞতার অধিকারী ভারতের কোটিপতি ব্যবসায়ী অনিল আম্বানির রিলায়েন্স গ্রুপকে ডসাল্টের স্থানীয় অংশীদার করা হয়।আম্বানি’র সঙ্গে ক্ষমতাসীন দল ‘ভারতীয় জনতা পার্টি’  বা বিজেপির  ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। 

২০০৪ সাল থেকে ফরাসী বিমান বাহিনী রাফাল ব্যবহার করলেও বিদেশী ক্রেতা পেতে ডসাল্টকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। ২০১৫ সালে মিসর ও কাতারের সঙ্গে ২৪টি করে রাফাল বিক্রির চুক্তি করে ফ্রান্স। ২০১৭ সালে দোহা আরো ১২টি রাফালের অর্ডার দেয়। ভারত এখন ডসাল্টের বড় ক্রেতা হতে যাচ্ছে। 


ভারতের বিমান বাহিনীর বহরে রাফাল যোগ হওয়ার কারনে নি:সন্দেহে দেশটির বিমান বাহিনী শক্ত অবস্থানে যাবে। ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বি দেশগুলোর তুলনায় কতটা শক্তিশালী অবস্থানে যেতে পারলো দেশটির বিমান বাহিনী? 


ভারতের নিরাপত্তা নীতিতে চীন ও পাকিস্তানকে দুই ফ্রন্টে মোকাবেলার জন্য ৪২ স্কোয়াড্রন জঙ্গিবিমান প্রয়োজন বলে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু সব মিলিয়ে দেশটির হাতে ৩৩ স্কোয়াড্রন জঙ্গিবিমানও নেই।ভারতীয় বিমানবাহিনীর বহরে এই মুহূর্তে জাগুয়ার, মিরেজ ২০০০, সুখুই ৩০ এবং মিগ-২১ ও ২৭ জেট রয়েছে।৩৬টি রাফাল পাকিস্তান সীমান্ত  ও কাশ্মীরের কাছে আমবালা বিমান ঘাঁটি এবং ভুটান সীমান্তের কাছে পশ্চিমবঙ্গের হাসিমারায় মোতায়েন করা হবে।গত ফেব্রুয়ারিতে প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে বিমান যুদ্ধে লিপ্ত হয় ভারত। সেখানে পাকিস্তাানের কাছে একটি মিগ-২১ বিসান জঙ্গিবিমান খোয়াতে হয় তাকে। 


মিগ-২১  সোভিয়েত আমলের সিঙ্গেল ইঞ্জিন মাল্টিরোল এ্যাটাক ফাইটার। ভারতীয় বিমান বাহিনীর মূল শক্তি এগুলো। চীন-ভারত যুদ্ধের পরপরই ১৯৬০-এর দশকে প্রথম এ ধরনের বিমান সংগ্রহ করে দেশটি। ২০০৬ সালে এগুলো আপগ্রেড করে মিগ-২১ বাইসন সংস্করণ তৈরি করা হয়।


ভারতের বিমান বাহিনীর মুল শক্তি হচ্ছে রাশিয়ার তৈরি মিগ-২১ যুদ্ধ বিমান। ভারতীয় গনমাধ্যমে বলা হয় যে, মিগ-২১ জঙ্গিবিমান সবচেয়ে দুর্ঘটনা প্রবন। ২০১০-১৩ সালের মধ্যে ১৪টি মিগ-২১ বিধ্বস্ত হয়। ২০১৫-১৮ সালের মধ্যে মোট ২৪টি বিমান হারায় বিমান বাহিনী।এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয় ৩৯ জন। ফলে এগুলোর  নাম দেয়া হয় ‘বিধবা সৃষ্টিকারী’ বা ‘উড়ন্ত কফিন’। ২০১২ সালে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পার্লামেন্টে জানিয়েছিলেন ৮৭২টি মিগ বিমানের অর্ধেকের বেশি দূর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়েছে। এক দশকে মারা গেছে ৮৫ জনের বেশি পাইলট।  ১৯৮০’র দশকের মাঝামাঝি এসব বিমান বহর থেকে বাদ দেয়ার কথা থাকলেও শক্তিশালী মাল্টেমোড রাডার, উন্নত এভিওনিক্স ও কমিউনিকেশন সিস্টেম সংযোজনের মাধ্যমে এগুলোকে আপগ্রেড করে বাইসান সংস্করণ তৈরি করা হয়।


গত ২৭ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান বিমান বাহিনী ভারতের যে জঙ্গিবিমানটিকে গুলি করে ভূপাতিত এবং এর পাইলট উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানকে আটক করে সেটি ছিলো একটি মিগ-২১ বিসান। এর বয়স অবসর গ্রহণের কাছাকাছি পৌছে গিয়েছিলো। লাইফ এক্সটেনশন ও বারবার আপগ্রেডকরে বিমানগুলো ব্যবহার করছে ভারতের বিমান বাহিনী।


সোভিয়েত আমলে কেনা মিগ-২১ বিমান বহরের দূর্বলতা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছে ভারত। যদিও এক সাথে বিশাল এই বহলে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। ধীরে নতুন বিমান যোগ হচ্ছে বহরে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে একই সময়ে চীন ও পাকিস্তান আকাশ যুদ্ধে ভারতের তুলনায় এগিয়ে যাচ্ছে। যেমন পাকিস্তানের হাতে আছে এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান। আবার চীনের হাতে হাইপারসনিক নানা ধরনের সমরাস্ত্র । ফলে চীনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার দিকটি বাদ দিলেও পাকিস্তানের বিমান বাহিনীকে মোকাবিলার জন্য বিমান বাহিনীর আধুনিকায় জরুরি ছিলো। 
ভারত সুখোই-৩০এমকেআই বিমানের রাডার ও অস্ত্র সক্ষমতা বাড়ানো এবং ইলেক্ট্রনিক যুদ্ধের সক্ষমতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিয়েছে।  ভারতের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেনএই রাডারের মাধ্যমেএফ-৩৫ কে  দূর থেকেই সনাক্ত করা সম্ভব, যেমনটা জে-২০ বিমানকে করা যাবে। পাকিস্তান বিমান বাহিনী লকহিড মার্টিন থেকে এফ-৩৫ কেনার চুক্তি করেছে। এছাড়া জে এফ -১৭ মতো অত্যাধুনিক বিমান আছে দেশটির হাতে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এফ-১৬ বিমান পেয়েছে দেশটি। এগুলো মোকাবিলার জন্য রাডার সিস্টেম আপগ্রেড করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। 


ধারণা করা হচ্ছে সু-৩০এমকেআই বিমানের রাডার আপগ্রেডের জন্য খুব একটা সময় লাগবে না কারণ রাশিয়া তাদের সু-৩০এসএম বিমানের রাডার ও ইঞ্জিনের উল্লেখযোগ্য আপগ্রেড এরই মধ্যে করেছে এবং সেগুলো রাশিয়ান বিমান বাহিনী ব্যবহার করছে।


২০১৮ সালে, ভারতীয় বিমান বাহিনীর সুখোই সু-৩০এমকেআই চীনের আধুনিক চেংদু জে-২০ জঙ্গি বিমান সনাক্ত করতে পেরেছে বলে দাবি করা হয়। চীনের পিপলস লিবারেশান আর্মি এয়ার ফোর্সের ব্যবহার করা শীর্ষ স্টেলথ বিমানগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এছাড়া জে-২০ জঙ্গি বিমান রাডার এড়ানোর ধাতু দিয়ে তৈরি বলে দাবি করেছে চীন, যে কারণে দূর থেকে এই বিমানকে সনাক্ত করা কঠিন হবে।


আধুনিক যুদ্ধ বিমানের পাশাপাশি ভারত বেশ কিছু ভারতের বিমান বাহিনীর বহরে নতুন যুদ্ধ বিমান যোগ করার পাশাপশি বেশ কিছু অ্যাটাক হেলিকপ্টার কেনার চুক্তি করে ভারত। যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কাছ থেকে ২২ টি অ্যাটাক হেলিকপ্টার কেনার চুক্তি করে। এরমধ্যে গত জুলাইয়ে ৪ টি অ্যাটাক হেলিকপ্টার হস্তান্তর করেছে বোয়িং। এগুলো ভারতের বিমান বাহিনীকে বেশ ভালো অবস্থানে নিয়ে যাবে। 


ভারতীয় বিমানবাহিনী হাতে এসেছে অত্যাধুনিক মার্কিন হেলিকপ্টার অ্যাপাচি এএইচ ৬৪ ই। মার্কিন বিমান প্রস্তুত কারক সংস্থা বোয়িং জানেিয়ছে ইতোমধ্যে চারটি হেলিকপ্টার ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এটি বিশ্বের সর্বাধুনিক মাল্টি রোল কমব্যাট হেলিকপ্টার।
এই হেলিকপ্টারগুলো অ্যাপাচি গার্ডিয়ান নামেও পরিচিত। এ হেলিকপ্টারগুলো সর্বাধুনিক আক্রমণাত্মক হেলিকপ্টার। এগুলোর আছে চার ব্লেডের অ্যাটাকিং কপ্টার। যেকোনো আবহাওয়ায় এসব হেলিকপ্টার হামলা চালাতে পারে। গাছের উচ্চতায় নেমে লক্ষ্য বস্তুকে চোখের নিমেষে গুঁড়িয়ে দিয়ে চলে যেতে পারে অ্যাপাচি হেলিকপ্টার। লক্ষ্যে সরাসরি আঘাত হানতে এই হেলিকপ্টারে রয়েছে নাইট ভিশন সিস্টেম। প্রায় ৩০০ কিলোমিটার বেগ পর্যন্ত উড়তে সক্ষম এই হেলিকপ্টারগুলো। অন্ধকারে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানতে এবং দ্রত ওঠানামার ক্ষমতা এ হেলিকপ্টারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এক টানা প্রায় ৪৭৬ কিলোমিটার উড়তে পারে অ্যাপাচি।


একটি একটি অ্যাপাচি হেলিকপ্টারে থাকে থার্টি এম এম মেশিনগান। হেলিকপ্টার থেকে প্রতি মুহূর্তে সর্বোচ্চ ১ হাজার ২০০ বার গুলি ছোড়া যায়। ১৬ এজিএম-১১ এ আর হেলফায়ার-২ অ্যান্টি ট্যাংক গাইডেড মিসাইল বহন করতে পারে এই হেলিকপ্টার। এ মিসাইল দিয়ে ট্যাংক ধ্বংস করা যায়। এ ছাড়া দুটো এআইএম-৯ সাইডউইন্ডার, চারটি এআইএম-৯২ স্টিংগার, মিস্ট্রাল ক্ষেপণাস্ত্রও বহন করতে পারে অ্যাপাচি। শত্রুপক্ষের রাডার ধ্বংস করতে পারে এসব অ্যাপাচি। বিশেষ করে পাহাড়ি এলাকার জন্য খুবই উপযোগী অ্যাপাচি হেলিকপ্টার।এর আগে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের বিমানবাহিনীতে যোগ হয় চিনুক হেলিকপ্টার। 


ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বি পাকিস্তান বিমান বাহিনী রাশিয়ার এম আই -৩৫ অ্যাটাক হেলিকপ্টার কিনেছে। এছাড়া এম-১৭ হেলিকপ্টার ও তুরস্কের তৈরি বেশ কিছু অ্যাটাক হেলিকপ্টার আছে দেশটির হাতে। 


যে কোনো দেশের বিমান বাহিনীর আধুনিকায়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। ভারতীয় বিমান বাহিনী এর ব্যতিক্রম। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমরাস্ত্র  ক্রেতা দেশ ভারত। প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে দেশটি বিমান বাহিনীতে পরিবর্তন আনছে।