চলন্ত বোমার শহর ঢাকা!

চলন্ত বোমার শহর ঢাকা!

ছবি:সংগৃহীত

ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিল কাভার্ড ভ্যান। নারায়নগঞ্জ লিংক রোডে কাভার্ড ভ্যানটিতে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। ভেতর থেকে চিৎকার ভেসে আসে। লোকজন ছুটে গিয়ে টেনে বের করে দেখে দুই ব্যাক্তির শরীরের অধিকাংশই পুড়ে গেছে। বাঁচানোর আকুতিতে তাড়াহুড়া করে তাদের নেয়া হলো হাসপাতালে। এদের একজন চালক আমীর হোসেন এবং অপরজন হেলপার আবুল কালাম। আমীর মারা গেছেন আর পোড়া শরীর নিয়ে এখনো জীবনযুদ্ধে কালাম। ঘটনাটি কয়েক মাস আগের।

শুধু এই কাভার্ড ভ্যানটি নয়, ঢাকা শহরে এমন দুই লাখেরও বেশী যানবাহন ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। এর যে কোনটিতে যখন তখন এই কাভার্ড ভ্যানটির মতো বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। হতাহত হতে পারেন যাত্রী-চালক যে কেউ। প্রতি পাঁচ বছর অন্তত গাড়িতে লাগানো গ্যাসের সিলিন্ডার পরীক্ষা করার নিয়ম রয়েছে৷ বিস্ফোরক অধিদফতরে এই পরীক্ষার তালিকা জমা দেয়ার কথা। মাত্র ৩০ থেকে ৪০ হাজার গাড়ির পরীক্ষার তালিকা নিয়মিত জমা দেয়। অন্যরা পরীক্ষা করে কি-না বা মেয়াদ আছে কি-না তার কিছুই জানে না বিস্ফোরক পরিদফতর।

বিস্ফোরক পরিদফতরের প্রধান- পরিদর্শক শামসুল আলম বলেন,‘মেয়াদ উত্তীর্ণ এক একটি সিলিন্ডার একটি বোমার চেয়েও ভয়াবহ। এসব জেনেও আমরা গ্যাসের সিলিন্ডারটি নিয়মিত পরীক্ষা করছি না। মঝে মধ্যে আমরা যে রিপোর্ট পাই সেটা প্রাইভেটকারের। বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান বা অন্যান্য যানবাহনের কোন তথ্যই আমাদের কাছে নেই। ফলে তাদের অবস্থা কি আমরা কিছুই জানি না। একটি প্রাইভেট গাড়িতে মালিক নিজেই চলাচল করেন। তারপরও তিনি জেনে বুঝে নিয়মিত সিলিন্ডারটি পরীক্ষা করাচ্ছেন না। ফলে ঝুঁকিতে থাকছেন তিনি নিজেই। এর জন্যে আমরা নানাভাবে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

শামসুল আলম বলেন,‘প্রতি বছর গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষার সময় গ্যাস সিলিন্ডার পরীক্ষার রিপোর্ট জমা দেয়ার জন্য আমরা বছর দু'য়েক আগে মন্ত্রণালয়কে লিখেছিলাম। তারাও বিষয়টি আন্তরিকভাবে নিয়েছিল। কিন্তু সমস্যা হল দেশে মাত্র ৩০/৩২টি রিটেষ্ট সেন্টার আছে। ফলে এটি আইনের মধ্যে ঢুকালে ওই রিটেষ্ট সেন্টারগুলোতে এমন চাপ পড়বে তখন একটা লেজেগুবরে অবস্থা হয়ে যাবে। এ কারণ তখন আইনের মধ্যে বিষয়টি ঢোকানো হয়নি। ফলে গাড়ির মালিকরা ইচ্ছেমতো হয় পরীক্ষা করাচ্ছেন, নতুবা মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন। আর আইনের মধ্যে কিছু না থাকায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও কোন সুযোগ নেই।’

গত বুধবার বিকেলে রাজধানীর রূপনগর আবাসিক এলাকার ১১ নম্বর সড়কে বেলুনে গ্যাস ভরে বিক্রি করার সময় সিলিন্ডার বিস্ফোরণে সাত শিশুর মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ গ্যাস বেলুন বিক্রেতা আবু সাঈদের বিরুদ্ধে রূপনগর থানায় মামলা করেছে। বিস্ফোরণের ঘটনায় গ্রেফতার আহত আবু সাঈদ বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এই ঘটনার পর থেকে আবারও গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানির (আরপিজিসিএল) হিসাব অনুযায়ী, সারাদেশে প্রায় ৫ থেকে ৭ লাখ সিএনজিচালিত যানবাহন রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ বছরের বেশি সময় অতিক্রম করা গাড়ির সংখ্যা চার লাখেরও বেশি।

এর মধ্যে শুধু ঢাকা শহরেই দুই লাখের মতো। এগুলোর ৬০ থেকে ৭০ ভাগই পুনঃপরীক্ষা করা হয়নি। সিএনজি নিরাপত্তার আন্তর্জাতিক মান নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি গ্যাস সিলিন্ডার পাঁচ বছর পরপর রিটেস্টের বিধান রয়েছে। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ সিলিন্ডার নিয়েই হাজার হাজার যানবাহন রাস্তায় চলাচল করছে। এর ফলে মাঝে মধ্যে গাড়িতে ঘটছে বিস্ফোরণ। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসাব অনুযায়ী গত ৫ বছরে দুই শতাধিক গাড়িতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। সামনে এই সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও তাদের।

ফায়ার সার্ভিসের সদ্য বিদায়ী মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খান বলেন,‘সিএনজি সিলিন্ডারে প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে তিন হাজার পাউন্ড চাপে যখন গ্যাস ভরা হয় তখন রাস্তায় চলাচলকারী একেকটি গাড়ি যেন চলমান বোমা হয়ে ওঠে। গ্যাস ভরার সময় সিলিন্ডার এমনকি গ্যাসও উত্তপ্ত অবস্থায় থাকে। সিলিন্ডার যথাযথ না হলে বড় রকমের অঘটন ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে। বড় বাস-ট্রাকের বিস্ফোরণের ঝুঁকি অনেক বেশি। কারণ বাস- ট্রাকগুলোতে ছয় থেকে আটটি সিলিন্ডার থাকে।’

এর বাইরে বাসা-বাড়িতে যে গ্যাসের সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয় সেগুলোরও একই অবস্থা। তবে ওইসব সিলিন্ডারে গ্যাসের চাপ কম থাকায় বিস্ফোরণের ঝুঁকি বেশি। তবে নিয়মিত পরীক্ষা না করালে লিকেজ থেকে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। যেটা ঘটে যাচ্ছে- বলছিলেন আলী আহমেদ খান। এই সিলিন্ডারগুলোর নিয়মিত পরীক্ষা একটা আইনের মধ্যে আনা দরকার।

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির হিসাব অনুযায়ী, সারাদেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৪২ লাখ৷ যদিও এই হিসাব স্বাধীনতার পর থেকে। এর বাইরে অনিবন্ধিত অনেক গাড়িও আছে। আবার বহু গাড়ি এখন আর রাস্তায় চলে না। সব মিলিয়ে এই সংখ্যা ৩০ থেকে ৩২ লাখ। সংশিষ্টরা বলছেন, আইন করে যদি বিআরটিএর ফিটনেস নেয়ার সময় সিলিন্ডার রিটেস্ট করানো বাধ্যতামূলক করা যায় তাহলে এই ধরনের ঝুঁকি কমবে। সবাই সচেতন হবে। এর ফলে প্রাণহানি ও যানবাহনও নিরাপদ হবে। সূত্র : ডয়চে ভেলে।