সারা বিশ্বের মানুষের হৃদয় জয় করলেন জাসিন্ডা

সারা বিশ্বের মানুষের হৃদয় জয় করলেন জাসিন্ডা

জাসিন্ডা আরডের্ন


জাসিন্ডা আরডের্ন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী। যার নাম এখন দুনিয়া জুড়ে আলোচিত। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্ট চার্চ মসজিদে গত ১৫ মার্চ এক শে^তাঙ্গ  উগ্রপন্থী বন্দুকধারী ৫০ জন নামাজরত মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনার পর সবার দৃষ্টি ছিলো নিউজিল্যান্ড সরকার কিভাবে এর প্রতিক্রিয়া দেখায় । কয়েক ঘন্টার মধ্যে দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডের্ন তার বিবৃতিতে এ ঘটনাকে “ সন্ত্রাসী ” হামলা বলে উল্লেখ করেন।


পশ্চিমা বিশে^  মুসলমানদের ওপর কোনো শে^তাঙ্গ খ্রিস্টানের হামলার ঘটনাকে এই প্রথম কোনো সরকার প্রধান সন্ত্রাসী হামলা বলে উল্লেখ করেন। গোটা পশ্চিমা বিশে^ যখন শে^তাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে তখন জাসিন্ডা আরডের্ন শক্তভাবে তা প্রতিরোধের কথা বলেছেন।  বর্নবাদ, জাতি বিদ্বেষ ও ইসলাম আতঙ্ক ছড়ানোর যে কোনো তৎপরতার বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দিয়েছেন।


 জাসিন্ডা আরডের্ন সারা বিশে^ প্রশংসিত হয়েছেন তার সাহসী ও নৈতিক অবস্থানের জন্য। শ্বেতাঙ্গ কোনও ব্যক্তির দ্বারা  হামলার ঘটনায় পশ্চিমা দেশের সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করতে সাধারনত অনীহা প্রকাশ করা হয়।


এই হামলা যিনি ঘটিয়েছেন তিনি অস্ট্রেলীয়  নাগরিক এবং হামলার শিকার হতাহত ব্যক্তিরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা। যাদের মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিশর, জর্ডান এবং সোমালিয়ার বংশোদ্ভুত লোক আছে।


জাসিন্ডা আরডের্ন শুধু বিবৃতির মধ্যে ছিলেন না নিউজিল্যান্ডে বসবাসরত মুসলমানদের পাশে দাড়ান এবং তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্যর প্রতি সম্মান দেখান।  ক্রাইস্টচার্চে ঘটনার শিকার পরিবারগুলোর স্বজনদের জড়িয়ে ধরে সাত্বনা ও সমবেদনা জানান । সেসময় মাথায় কালো রং এর স্কার্ফ পরেন। যা তাদের প্রতি শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ। সারা বিশে^র গনমাধ্যমে জাসিন্ডা আরডের্নের কাজের প্রশংসা করা হয়। 


আসুন আমরা জেনে নেই কে এই জাসিন্ডা আরডের্ন। 
জাসিন্ডা আরডের্ন নিউজিল্যান্ডের ৪০ তম প্রধানমন্ত্রী। ২০১৭ সালের ২৬ অক্টোবর তিনি নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব গ্রহন করেন। একই সাথে ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। জাসিন্ডা আরডের্নের জন্ম নিউজিল্যান্ডের হ্যামিলটনে ২৬ জুলাই ১৯৮০ সালে। তার বাবা রোজ আর্ডেন ছিলেন একজন পুলিশ অফিসার। তার মা লরেল আর্ডেন একটি স্কুলের ক্যাফেটারিয়াতে রান্নার কাজে সহযোগিতা করতেন। জাসিন্ডা অরর্ডেন ওয়াইকাটো ইউনিভার্সিটি থেকে  রাজনীতি ও জনসংযোগ বিষয়ে  গ্রাজুয়েশন করেন। 


তিনি নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্কের কার্যালয়ে গবেষক হিসাবে কাজ করেন। এছাড়া তিনি বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের উপদেষ্টা হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব সোশালিস্ট ইয়ুথ এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। 


জাসিন্ডা আরর্ডেন বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুতে সোচ্চার ছিলেন। এরমধ্যে দেশটিতে সবার জন্য বাড়ি ও স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা। বেতন ভাতা বাড়ানো, পরিবেশগত বিভিন্ন দিক এবং শিশু দারিদ্রতা বিষয়ে তিনি কাজ করেছেন। বিশেষ করে অভিবাসীদের বেতন বাড়ানোর পক্ষে তিনি দাবি করে আসছেন।  


জাসিন্ডা আরর্ডেন সম লিঙ্গের বিয়ে সমর্থক  এবং গর্ভপাতকে অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করার নীতির বিরুদ্ধে। তিনি দুই রাষ্ট্রের ভিত্তিতে ফিলিস্তিন-ইসরাইল সমস্যার সমাধানের প্রতি সমর্থন দিয়ে আসছেন। গাজায় ইসরাইলি হামলার কঠোর সমালোচক। 


আদর্শিকভাবে মধ্যবাম রাজনীতিতে বিশ^াসী আর্ডেন মাত্র ৩৭ বছর বয়সে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহন করেন। জাসিন্ডার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহনকে সে সময় বিশে^ তরুন নেতৃত্বের উন্থান হিসাবে দেখা হতো।  ২০১৭ সালে  আরডের্ন যখন প্রথম তার নির্বাচনী প্রচার কাজ শুরু করেন তখন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোর সাথে তুলনা করা হতো । এই তিনজনই প্রগতিশীল, উচ্চাকাঙ্খী এবং তরুণ।


২০১৮ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন অবস্থায় জাসিন্ডা এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। যা নিয়ে বিশ^জুড়ে আলোচিত হয়। এর আগে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্রো। দায়িত্ব পালনের সময় সন্তানের জন্ম দেন।


ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে হামলার পর দেশটির মুসলিম সম্প্রদায়ের পাশে যেভাবে জাসিন্ডা আরর্ডেন দাড়িয়েছেন তাতে গোটা মুসলিম বিশে^ তিনি বিশেষ মর্যাদার আসনে অভিষিক্ত হয়েছেন। এই ঘটনার পর প্রথমবারের মত পার্লামেন্টে দৃঢ় ভাষায় বক্তব্য রাখেন। ইসলামি কায়দায় সবাইকে সম্ভাষন জানান "আসসালামু আলাইকুম" বলে।  হামলার ঘটনার কয়েক ঘন্টার মধ্যে তিনি দেশের অস্ত্র আইনে "১০ দিনের মধ্যে" কঠোর সংস্কার আনার বিষয়ে ঘোষণা দেন। তিনি নিউজিল্যান্ড এবং বিশ্ব থেকে বর্ণবাদ "বিতাড়িত" করার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেন। আরর্ডেন জোর দিয়ে বলেন, এই বিষয় গুলোর ক্ষেত্রে "সীমানা দিয়ে  ভাবলে আমাদের চলবে না"। 


জাসিন্ডা আরর্ডেন যে বর্নবাদ শে^তাঙ্গ আধিপত্যবাদের ব্যাপারে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন তার প্রমান পাওয়া যায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্পকে উদ্দেশ্য করে দেয়া জবাবে। ঘটনার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন  'আমেরিকা কী ধরনের সহায়তা দিতে পারে?' উত্তরে তিনি বলেছেন, "সকল মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য সহমর্মিতা এবং ভালবাসা।"


মসজিদে হামলার ঘটনার ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়ার সিনেটর ফ্রেশার অ্যানিংস হামলার ঘটনার জন্য অভিবাসনকে দায়ী করে মন্তব্য করার পর এই মন্তব্যকে নিন্দনীয় বলে বর্ননা করেন আরর্ডেন। 


হামলার পর দিন থেকে জেসিন্ডা আরডের্নকে হতাহতদের পরিবারকে সান্তনা দেয়ার যে ছবি দেখা গেছে তাতে পশ্চিমা রাজনৈতিক নেতাদের থেকে সম্পুর্ন ভিন্নরুপে দেখা গেছে। তাকে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিটি সদস্যর মতো শোকাভিভুত দেখা গেছে।  প্রতিটি অনুষ্টানে তিনি কালো পোশাক ও হিজাব পরে শোকের অনুষ্টানগুলোতে যোগ দেন। 
এই হামলার এক সপ্তাহ পরে ক্রাইস্ট চার্চ মসজিদে জুমার  নামাজে আসা মুসলমানদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা অ’ডুর্ন বললেন, “তোমাদের সঙ্গে আজ পুরো নিউ জিল্যান্ড কাঁদছে। আমরা সবাই আজ এক। জুমার নামাজের সময় হ্যাগলি পার্কের এই সমাবেশে জড়ো হয়েছিল প্রায় দশ হাজার মানুষ। মুসলমান রীতিতে কালো কাপড়ে মাথা ঢেকে প্রধানমন্ত্রী অরডেন সেখানে উপস্থিত ছিলেন । তার বক্তব্যে তিনি হাদিস থেকে পড়ে শোনান। এছাড়া নিউজিল্যান্ডের রেডিও  ও টেলিভিশনে আজান প্রচার করা হয়। জাসিন্ডা আরর্ডেনের মানবতাবাদী ভুমিকার কারনে তিনি নিজেও এখন হুমকির মুখে পড়েছেন। টুইটারে তাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে।
 জাসিন্ডার অবস্থান সর্ম্পকে বিবিসির একজন সাংবাদিক মন্তব্য করেছেন "তিনি দৃঢ়, গম্ভীর, ইতিবাচক এবং দায়িত্বশীল।  তার শরীরে কোন বাজে কোষ নেই, কিন্তু আবার তাকে সহজে প্রভাবিত করা যায় না , এটা একটা ব্যতিক্রমী সমন্বয়।"


মুসলিম বিশে^র নেতারাও জাসিন্ডা আরর্নেডের প্রশংসা করেছেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান ওয়াংশিংটন পোস্টে এক নিবন্ধে বলেন জাসিন্ডা আরর্ডেনের আন্তরিক মনোভাব থেকে ইউরোপীয় নেতাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। নাগরিকদের প্রতি তার সমান দৃষ্টিভঙ্গিকে আন্তরিক ভাবে গ্রহণ করে ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোতেও তা চর্চা করতে হবে।


আর্ন্তজাতিক গনমাধ্যমেও জাসিন্ডা আরর্ডেনের প্রশংসা করা হয়েছে নিউইয়র্ক টাইমসের এক সম্পাদকীয়তে বলা হয় পুরো বিশ্ব দেখেছে, নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরর্ডেনের কাছে শেখার আছে, কিভাবে সন্ত্রাস, ভয়াবহতাকে জবাব দিতে হয়। কিভাবে ওই ধরনের পরিস্থিতি সামলাতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের এখন জেসিন্ডা আরর্ডেনের মত একজন নেতা প্রয়োজন। 


শোকাবহ একটি ঘটনায় নিজের নেতৃত্বের প্রমান দিয়ে জাসিন্ডা আর্ডেন সারা বিশে^র মানবতাবাদী মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন।