বাংলাদেশে এতো মামলা কেন ঝুলে রয়েছে?

বাংলাদেশে এতো মামলা কেন ঝুলে রয়েছে?

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিচারের রায় দ্রুত হওয়ায় বিচার বিভাগের উপর মানুষের আস্থা অনেক বেড়েছে।শনিবার রাজধানীতে জাতীয় বিচার বিভাগের সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন তিনি।

তবে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ২০১৭-২০২২ সাল পর্যন্ত কৌশলগত পরিকল্পনায় বলা হয়েছে যে, বিচার ব্যবস্থার অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ঝুলে থাকা বা বিচারাধীন মামলা।তাদের হিসাবে বর্তমানে বাংলাদেশে ৩ দশমিক ১ মিলিয়ন বা ৩১ লাখ মামলা ঝুলে আছে। আর প্রতিনিয়তই এই সংখ্যা বাড়ছে।তবে বেসরকারি একটি সংস্থা বলছে, ঝুলে থাকা মামলার সংখ্যা ৩৩ লাখেরও বেশি।

"গতিটা খুব স্লো আরকি"

বাংলাদেশে শীর্ষস্থানীয় লেখক হুমায়ুন আজাদকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করা হয়েছিল ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে।আক্রমণের ঐ ঘটনার পরপরই হত্যার চেষ্টার অভিযোগে মামলা হয়েছিল লেখকের পরিবারের পক্ষ থেকে।

সেই বছর অগাস্ট মাসে জার্মানিতে মারা যান তিনি। তাঁর মৃত্যুর আট বছর পর ঢাকার একটি আদালত তাকে হত্যা অভিযোগে পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।নিহত হুমায়ুন আজাদের মেয়ে এবং এই মামলার একজন সাক্ষী মৌলি আজাদ বলেন, মৃত্যুবার্ষিকী ছাড়া তাকে আর কেউ স্মরণ করে না। হামলার ১৫ বছর পরও এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে বলে জানান তিনি।

মৌলি আজাদ বলেন, "এটা তো সিআইডির হাতে আছে, আছে তো আছে, কোন কিছুই হয় না আরকি"।"বিচারক বলছেন যে, সব সাক্ষীর সাক্ষ্য নেয়া হয়নি। তাই কিছু করা যাচ্ছে না। আবার এই মামলায় একাধিকবার বিচারক পরিবর্তন করা হয়েছে। এর গতিটা খুব স্লো," বলেন তিনি।

২০১৪ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর মিরপুরে একটি বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে দুই ভাই ইশতিয়াক হোসেন জনি এবং ইমতিয়াজ হোসেন রকিকে আটক করে পুলিশ।মিস্টার রকি অভিযোগ করেন, ওই রাতে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনায় মারা যান তার বড় ভাই ইশতিয়াক হোসেন জনি।

এ ঘটনায় মামলা করেন তিনি। তবে এখনো সেই মামলায় তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি বলে জানান মিস্টার রকি।"২০১৪ সালে মামলাটা করেছি, ২০১৫ সালে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে, ২০১৬ সালে বিচার শুরু হয়। কিন্তু ২০১৭ সালে হাইকোর্টে বিচার প্রক্রিয়া থামিয়ে দেয়া হয়," বলেন মিস্টার রকি।

মামলার প্রতিটা ধাপে দীর্ঘসূত্রিতা

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশের কাছে মামলা ফাইল হওয়া থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি ধাপে এটি দীর্ঘসূত্রিতার মুখে পড়ে।এছাড়া তদন্তে সময় নেয়া, ঠিক সময়ে সাক্ষী হাজির না হওয়া, অসংখ্যবার তারিখ নেয়া এবং আদালতের বাইরে বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়াও মামলা ঝুলে যাওয়ার পেছনে বড় কারণ বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক তাসলিমা ইয়াসমীন।বাংলাদেশে আইন অনুযায়ী, বিচার বা মামলার তদন্তের একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া থাকলেও খুব কম ক্ষেত্রে সেটি মান্য করা হয় বলে জানান তাসলিমা ইয়াসমীন।

তিনি বলেন, "অনেক সময় তদন্ত করতেই অনেক সময় নেয়া চলে যায়। সমনের প্রক্রিয়াই চলে অনেক দিন ধরে। আর সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হলে তাও দেখা যায় যে সেটি বছরের পর বছর ধরে চলছে।"তার মতে, ক্রিমিনাল কেস বা ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা আরো বেশি পরিমাণ দেখা যায়।

"এসব মামলা রাষ্ট্র পক্ষ থেকে তৈরি করার বিধান থাকে বলে অনেক সময় মামলা প্রস্তুতিতে অনেক দুর্বলতা থাকে। যার জন্য আসামীরা জামিন পেয়ে যায় এবং মামলাটি ঝুলে যায়," তিনি বলেন।এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে আদালতের বাইরে নিষ্পত্তি সম্ভব এমন অনেক ঘটনাও মামলায় গড়ায়। যা নিয়ন্ত্রণে সুষ্ঠু তদন্ত দরকার বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা।

সম্প্রতি ফেনীর নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলাসহ বেশ কয়েকটি মামলার রায় হওয়ায় অনেকেই আশা করছেন যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে হয়তো ঝুলে থাকা মামলার নিষ্পত্তি হবে।এমন আশার কথা জানিয়েছেন অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের মেয়ে মৌলি আজাদও।

তবে তাসলিমা ইয়াসমীন বলছেন, মামলার দীর্ঘসূত্রিতা এড়াতে হলে বিচার বিভাগের দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি সাক্ষীর সুরক্ষা নিশ্চিতের মতো পদক্ষেপ নিতে হবে।তিনি বলেন, আদালতের বাইরে অভিযোগের নিষ্পত্তি করার উপর জোর দেয়া গেলে মামলা ঝুলে যাওয়া ঠেকানো সম্ভব।এছাড়া বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিতও গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।সূত্র-বিবিসি।