বন্ধুদের প্রভাব কি আপনার স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ হতে পারে?

বন্ধুদের প্রভাব কি আপনার স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ হতে পারে?

ছবি: সংগৃহীত

বছরের শুরুতে অনেক মানুষ নতুন করে স্বাস্থ্যকর একটি জীবনযাপনের চেষ্টা শুরু করবেন।অনেকে হয়তো অস্বাস্থ্যকর খাবার বাদ দেবেন, অথবা সপ্তাহ শেষে শরীর চর্চা ক্লাসে যাওয়ার ব্যাপারে মনোযোগী হবেন। সেটা তাদের জন্য সহজ হবে যদি বন্ধু এবং পরিবারের সদস্যরাও একই ধরণের পরিবর্তন আনেন।কিন্তু যেসব সিদ্ধান্ত আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে, তার সবকিছু ইচ্ছা করে করা হয় না। অনেক সময় আমাদের বন্ধু, সহকর্মী এবং পরিবারের সদস্যদের আচরণ আমাদের আচরণের ওপরেও প্রভাব ফেলে।

তবে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, আমরা এমন সব আচরণও নকল করে থাকি, যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ - যেমন ধূমপান করা অথবা বেশি খাওয়া।এর মানে হলো, ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে তখন হৃদরোগ, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ এবং ক্যান্সারের মতো অসংক্রামক রোগ অনেকটা সংক্রমণের মতো করে ছড়িয়ে যায়।

আপনার বন্ধুরা কি আপনাকে স্থূল করে তুলতে পারে?

যেসব মানুষকে আমরা মূল্যায়ন করি এবং নিয়মিতভাবে মিশি, তাদের সঙ্গে আমাদের একটি সামাজিক যোগাযোগ বলয় তৈরি হয়ে থাকে।ম্যাসাচুসেটসের একটি শহর ফ্রামিংহ্যামে হৃদরোগ নিয়ে ১৯৪০ দশকের শেষ থেকে শুরু করে পরবর্তী তিন প্রজন্মের বাসিন্দাদের ওপরে গবেষণা করা হচ্ছে, যেখানে সামাজিক যোগাযোগের ক্ষমতার ওপরে গুরুত্ব দেয়া হয়।।

গবেষণায় ইঙ্গিত দেয়া হয় যে, একজন ব্যক্তির স্থূল হয়ে ওঠার সম্ভাবনা অনেক বেশি হবে যদি তার ঘনিষ্ঠ সার্কেলে কেউ স্থূল হয়ে ওঠেন।সেখানে বলা হয়, এটা যদি বন্ধুদের মধ্যে ঘটে, তাহলে সম্ভাবনা হবে ৫৭%, ভাই বোনের মধ্যে হলে সম্ভাবনা হবে ৪০% এবং সঙ্গী হলে সেই সম্ভাবনা ৩৭% হবে।

এই প্রভাব আরো বেশি সুস্পষ্ট হবে যদি এই দুইজন ব্যক্তি একই লিঙ্গের হন এবং একজন আরেকজনের ব্যাপারে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবেন।উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, ফ্রামিংহ্যাম গবেষণায় বলা দেয়া হয়েছে যে, প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিদিন দেখা হলেও, যদি তাদের মধ্যে কোন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক না থাকে তাহলে একজনের কারণে আরেকজনের ওজন বাড়ার কোন সম্ভাবনা নেই।

দুজনের বন্ধুত্ব যদি একই রকম না হয়, যেমন একজন ব্যক্তি আরেকজনকে যতটা গভীরভাবে ভাবেন, অন্যজন তা ভাবেন না, তাহলেও বিষয়টি আলাদা হবে। যদি গভীরভাবে ভাবেন, তিনি অন্যজনের দ্বারা প্রভাবিত হবেন, কিন্তু অন্যজন তার দ্বারা হবেন না।

বন্ধু এবং পরিবারের সদ্যদের কারণে তালাক, ধূমপান এবং মদ্যপানের প্রবণতা বাড়ে বলে গবেষণায় দেখা গেছে।গবেষণার প্রাপ্ত এসব তথ্যের বিশেষ গুরুত্ব আছে। যদিও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এবং আরো অনেক আচরণ আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, কিন্তু বিশেষ কিছু আচরণের ফলে সাধারণত অসংক্রামক কিছু ব্যাধির প্রবণতা দেয়া যায়:

আপনি ধূমপান করেন কিনা

আপনার খাদ্যাভ্যাস

শারীরিক পরিশ্রম কতটা করেন

কতটা মদ্যপান করেন

এসব অসংক্রামক রোগ- যার মধ্যে রয়েছে হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস এবং ফুসফুসের ব্যাধির কারণে বিশ্বের প্রতি দশজনের মধ্যে সাতজনের মৃত্যু ঘটছে, যা যুক্তরাজ্যের মোট মৃত্যুর প্রায় ৯০ শতাংশ।

আবেগের সংক্রমণ

সামাজিক সম্পর্ক আমাদের আচরণ এবং মেজাজের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, কিশোরদের মধ্যে ধূমপান করার চেষ্টা বেশ জনপ্রিয় একটা ব্যাপার। বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালে কিশোররা ধূমপান করার চেষ্টা করে এবং একজনকে দেখে আরেকজন প্রভাবিত হয়।আবার কোন তরুণ-তরুণীর বন্ধুর মন খারাপ থাকলে, তারও তখন মনখারাপ হয়, যা বিপরীতভাবেও ঘটে।

এটা ঠিক বিষণ্ণতা নয়। সম্পর্কের কারণে বিষণ্ণতা ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা দেখা যায়নি। কিন্তু মন খারাপের ফলে কিশোর-কিশোরীদের জীবনযাপনের ওপর প্রভাব পড়ে এবং অনেক সময় সেটা থেকে বিষণ্ণতার মতো রোগের সৃষ্টি হতে পারে।আবেগের সংক্রমণের ব্যাপারটি গবেষণা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিতর্কিত ওই গবেষণা গোপনে সাত লাখ ফেসবুক ব্যবহারকারীর ওপর চালানো হয়।

ব্যবহারকারীর নিউজ ফিডে কী দেখা যাবে, তা ওই গবেষণায় বিশেষভাবে ফিল্টার করা হয়। এরপর একটি অ্যালগরিদমের সাহায্যে ফেসবুক বন্ধুদের সংশ্লিষ্ট পোস্টগুলো তুলে ধরা হয়।পাশাপাশি দুইটি গবেষণা চালানো হয়। একটিতে ব্যবহারকারীদের নিউজ ফিডে ইতিবাচক পোস্ট কমিয়ে দেয়া হয়, আরেকটিতে নিউজ ফিডে নেতিবাচক পোস্ট কমিয়ে দেয়া হয়।

যে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা ইতিবাচক পোস্ট দেখতে পেয়েছেন, তারা নিজেরাও বেশি করে ইতিবাচক পোস্ট দিয়েছেন। আর যারা নেতিবাচক পোস্ট দেখেছেন, তারা করেছেন ঠিক উল্টোটা।গবেষণার উপসংহারে বলা হয়েছে, সামনাসামনি দেখা না হলেও বা শারীরিক কোন সংস্রব না থাকলেও, মানুষের আবেগ সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সংক্রমিত হতে পারে।

তবে সামাজিক নেটওয়ার্কের ওপর চালানো এই গবেষণার সমালোচনা করে বলা হয় যে, আমরা সেসব মানুষের সঙ্গেই বন্ধুত্ব করি, আমাদের সঙ্গে যাদের একই রকমের বৈশিষ্ট্য মেলে অথবা আমরা একই পরিবেশে থাকি। কিন্তু আরো অনেক গবেষণায় এই থিওরি গ্রহণ করা হয়েছে, যাকে বলা হয় সামাজিক রোগ সংক্রমণ।

আমরা যদি বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের আচরণ নকল করি, তাহলে কীভাবে সেটা ভালো কাজে লাগাতে পারি?শুকনো জানুয়ারি এবং ভেগানুয়ারি - যার মাধ্যমে মানুষজনকে মদ্যপান ছেড়ে দেয়া অথবা নিরামিষ আহারী হয়ে ওঠার পরামর্শ দেয়া হয়- হচ্ছে স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দেয়ার বিশেষ দুইটা উদাহরণ।

স্টপোবার- যার মাধ্যমে ইংল্যান্ডে মানুষজনকে অক্টোবর মাসে ধূমপান ছাড়ার জন্য উৎসাহ দেয়া হয়- হচ্ছে আরেকটি উদাহরণ যে সম্মিলিতভাবে জীবনযাপনে পরিবর্তন আনা সম্ভব।সামাজিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আচরণের বিস্তারের ওপর ভিত্তি করে নেয়া এসব উদ্যোগ ২০১২ সাল থেকে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে।

ধারণা করা হয়, এর ফলে দশ লাখের বেশি মানুষ নেতিবাচক অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। ফলে বুঝতে পারা যায়, একটি ছোট কিন্তু ব্যাপক উদ্যোগ যা করতে পারে, সারা বছর ধরে একজনকে বার্তা পাঠিয়েও তা করা যায় না।যদিও স্টপোবার সফলতা পেয়েছে, কিন্তু স্বাস্থ্য বিষয়ে বড় ধরণের প্রচারণাও সবার ক্ষেত্রে সফল হয় না।

প্রচলিত স্বাস্থ্য বার্তা স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে প্রভেদ আরো বড় করে তুলতে পারে, কারণ যেসব পরামর্শ দেয়া হয়, সেগুলো সবাই নিতে পারেন না।

অনেক সময় শুধুমাত্র সুস্বাস্থ্যের মানুষের ওপর এটা কাজ করে - যারা সবসময় নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দেন এবং যাদের শিক্ষা, অর্থ ও সামাজিক সহায়তা রয়েছে।কিন্তু যারা স্বাস্থ্য সচেতন নন, তারাও যাদের সঙ্গে নিয়মিত মেশেন, তাদের আচরণে ফলে এ ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠতে পারেন।

গবেষকরা বলছেন, আমরা যদি পুরো জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে চাই, তাহলে সামাজিক সম্পর্কের এসব প্রভাবশালী ব্যক্তিদের লক্ষ্য করতে হবে, যারা তাদের অভিজ্ঞতার বিস্তার ঘটাতে পারেন, অনেক মানুষের সঙ্গে মিশতে পারেন এবং যাদের অন্যরা পছন্দ করে।

কীভাবে আচরণের বিস্তার হয়, এ নিয়ে আরো গবেষণা করলে সেটা সরকারের জন্য সহায়ক হয়ে উঠতে পারে, যা হয়তো অসংক্রামক রোগের বিস্তার ঠেকাতেও ভূমিকা রাখবে।-সূত্র: বিবিসি