ট্রাম্পের যুদ্ধ ক্ষমতা খর্ব করে প্রস্তাব পাস

ট্রাম্পের যুদ্ধ ক্ষমতা খর্ব করে প্রস্তাব পাস

ফাইল ছবি

ইরানের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যাতে নিজের ইচ্ছামতো যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিতে না পারেন সেজন্য তার ক্ষমতা খর্ব করে মার্কিন কংগ্রেসে প্রস্তাব পাস হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে প্রস্তাবটি ২২৪-১৯৪ ভোটে পাস হয়।

তবে ডেমোক্রেট নিয়ন্ত্রিত নিম্নকক্ষে প্রেসিডেন্টের যুদ্ধ ক্ষমতা খর্বের প্রস্তাব পাসকে ‘হাস্যকর’ ও ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে হোয়াইট হাউসের এক মুখপাত্র অভিহিত করেছেন।

এদিকে, আইআরজিসির অ্যারোস্পেস ফোর্সের প্রধান আমির আলী হাজিযাদেহ বলেছেন, ইরাকের দুটি মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বিপুলসংখ্যক মার্কিন সেনা হত্যার লক্ষ্য নিয়ে করা হয়নি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা আঘাত হানলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে চার থেকে পাঁচ হাজার মার্কিন সেনা প্রাণ হারাত। খবর বিবিসি, রয়টার্স ও আরব নিউজের।

৩ জানুয়ারি ইরাকের রাজধানী বাগদাদে ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) অভিজাত কুদস ফোর্সের প্রধান জেনারেল কাসেম সোলেমানিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্দেশে হত্যা করা হয়। এ হত্যার প্রতিশোধ নিতে মঙ্গলবার রাতে ইরাকে অবস্থিত দুটি মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। এ নিয়ে দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধ দামামা শুরু হয়।

এমন পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যাতে হুট করে নিজের সিদ্ধান্তে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে না পারেন সেজন্য মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে প্রস্তাবটি উত্থাপন করা হয়। প্রস্তাবের পক্ষে ২২৪ জন এবং বিপক্ষে ১৯৪ জন ভোট দেন।

প্রতিনিধি পরিষদে প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন বিরোধী ডেমোক্রেট দলের সদস্যরা। নিয়ম অনুযায়ী, প্রস্তাবটি এখন উচ্চকক্ষ সিনেটে যাবে। সিনেটে রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় এটি পাস হবে না বলেই অনুমান করা হচ্ছে। তবে সিনেটে প্রস্তাবটি পাস হলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অনুমোদন ছাড়াই সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হবে।

প্রস্তাবটি পাস হওয়া সম্পর্কে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান ইলিয়ট অ্যাঞ্জেল বলেন, প্রেসিডেন্টকে প্রথমে যুদ্ধের অনুমতি নিতে হবে। কুমন্ত্রণা থেকে হামলা করার পর তিনি হামলার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে বৈধতা চাইবেন- তা হতে পারে না।

অপরদিকে, রিপাবলিকান দলের মাইক ম্যাককল বলেছেন, আমাদের ডেমোক্রেট দলের বন্ধুরা এ গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রকে বিভক্ত করে ফেললেন। এ প্রস্তাব প্রেসিডেন্টের হাত-পা বেঁধে ফেলবে।

বৃহস্পতিবার প্রতিনিধি পরিষদে ভোটের কয়েক ঘণ্টা আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানান, সোলেমানি যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন এবং এ কারণেই তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। হোয়াইট হাউসের প্রশাসনিকনীতি বিভাগের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে- এ প্রস্তাব পাস হওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নাগরিকদের রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের সামর্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

সোলেমানি হত্যাকাণ্ড নির্বাচনী প্রচারণায় থিম হিসেবে ব্যবহার : জেনারেল কাসেম সোলেমানি হত্যাকাণ্ড নির্বাচনী প্রচারণায় থিম হিসেবে ব্যবহার করছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের ওহিও রাজ্যের তলিদোতে শোভাযাত্রার ভাষণে তিনি বলেন, এ হত্যাকাণ্ড মার্কিনিদের জীবন ও স্বার্থ রক্ষা করেছে। মার্কিনিরা ন্যায়বিচার পেয়েছেন।

সোলেমানি হত্যাকাণ্ডে ডেমোক্রেটদের সমালোচনা উড়িয়ে দিয়ে নিজের পক্ষে সাফাই গেয়ে ট্রাম্প বলেন, বিক্ষোভকারীরা বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসে চড়াও হয়েছিলেন। তাদের সংগঠিত করেছিলেন সোলেমানি। সেখানে সেনা না পাঠালে বিক্ষোভকারীরা হয়তো ভাংচুর চালাত, মার্কিনিদের হত্যা করত ও জিম্মি করত।

২০১১ সালে লিবিয়ার বেনগাজিতে এমনই ঘটনা ঘটেছিল এবং রাষ্ট্রদূত খুন হয়েছিলেন। সেনা পাঠিয়ে বাগদাদে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকানো হয়েছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে মার্কিনিদের জীবন রক্ষা এবং ন্যায়বিচারও পাইয়ে দেয়া হয়েছে।

বাগদাদে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে ৮০ জন মার্কিন সেনা নিহত হওয়ার দাবি করেছে তেহরান। তবে এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন ট্রাম্প।

জবাব দিলে ৪৮ ঘণ্টায় ৫ হাজার মার্কিন সেনা প্রাণ হারাত : আইআরজিসির অ্যারোস্পেস ফোর্সের প্রধান আমির আলী হাজিযাদেহ বলেছেন, ইরাকের দুটি মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বহু মার্কিন সেনা হতাহত হয়েছে। আমরা চাইলে প্রথম ধাপেই ৫শ’ মার্কিন সেনাকে হত্যা করতে পারতাম। কিন্তু প্রথম ধাপের হামলায় বিপুল সংখ্যায় মার্কিন সেনা হত্যার লক্ষ্য নিয়ে করা হয়নি।

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা আঘাত হানলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমাদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের হামলায় চার থেকে পাঁচ হাজার মার্কিন সেনা প্রাণ হারাত। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র নয়টি বিমানে করে হতাহতদের ইসরাইল ও জর্ডানে নিয়ে গেছে। হতাহতদের সরাতে সি-১৩০ বিমান ব্যবহার করা হয়েছে।

জেনারেল হাজিযাদেহ আরও বলেন, আমরা ‘শহীদ সোলেমানি’ নামের যে অভিযান শুরু করেছিলাম তা ছিল একটি বৃহৎ অভিযান। এ অভিযানের কয়েকটি ধাপ ছিল। আমরা যদি অভিযান অব্যাহত রাখার প্রয়োজন অনুভব করতাম তাহলে তা গোটা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ত। পশ্চিম এশিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যের সর্বত্র এ অভিযান চলত বলে তিনি জানান।

তিনি বলেন, মার্কিন ঘাঁটিতে আমরা ১৩টি ক্ষেপণাস্ত্র মেরেছি। তবে আমরা প্রথম কয়েক ঘণ্টায় কয়েকশ’ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের জন্য প্রস্তুত ছিলাম। উভয়পক্ষ সংযম না দেখালে যুদ্ধ সীমিত পর্যায়ে ৩ দিন থেকে ১ সপ্তাহ পর্যন্ত চলত। এজন্য আমরা কয়েক হাজার ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুত রেখেছিলাম।

তিনি দাবি করেন, মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ১৫ মিনিট পর ইলেকট্রনিক যুদ্ধ পরিচালনা করা হয়। এর ফলে আমেরিকার ড্রোন ও বিমানগুলো কয়েক মুহূর্তের জন্য নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। আর এ ঘটনায় মার্কিন সেনাদের মনোবল ভেঙে যায় এবং হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। ইরানের হামলায় আমেরিকার ‘আইন আল আসাদ’ ঘাঁটির কমান্ড সেন্টার ধ্বংস হয়ে যায়।

তিনি বলেন, মার্কিন বাহিনী সতর্ক ছিল, তারা হামলার আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন ছিল। এ কারণে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আগ পর্যন্ত আমেরিকার ১২টি বিমান ও ড্রোন সব সময় ইরাকের আকাশে নানা তৎপরতা চালাচ্ছিল। তারা আমাদের চপেটাঘাতের অপেক্ষায় ছিল। থাপ্পড় খাওয়ার পর তারা কিছুটা শান্ত হয়েছে।

জানা গেছে, ইরাকের দুই মার্কিন ঘাঁটিতে হামলায় ইরান ‘ফতেহ-৩১৩’ এবং ‘কিয়াম’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। ‘ফতেহ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে বিজয়ী এবং ‘কিয়াম’ মানে জাগরণ। ‘ফতেহ-৩১৩’ ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ৫০০ কিলোমিটার আর ‘কিয়াম’র পাল্লা ৭০০ কিলোমিটার।

দুই বছরেই পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ হবে ইরান : ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে ইরান আগামী ২ বছরের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশে পরিণত হতে পারে। শুক্রবার ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিন-ইয়েভস লে দ্রিয়ান বলেন, ইরান খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে অর্থাৎ দু-এক বছরের মধ্যেই পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে সক্ষম।

এদিকে, বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তিনি যতদিন প্রেসিডেন্ট থাকবেন ততদিন ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী দেশ হতে দেবেন না।

তিনি বলেন, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের চেষ্টা বাদ দেয় এবং সন্ত্রাসের পথ ত্যাগ করে তাহলে শান্তি স্থাপনে আমরা প্রস্তুত। যদি তারা শান্তির পথ বেছে না নেয় তাহলে দেশটির ওপর আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।

যুক্তরাষ্ট্র-ইরানের মধ্যেকার উত্তেজনাকর পরিস্থিতি নিয়ে শুক্রবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে বৈঠক হয়। মূলত উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ এড়ানোই বৈঠকের উদ্দেশ্যে। তাদের আশঙ্কা, মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে যে কোনো পক্ষের ভুল পদক্ষেপ ইউরোপের দেশগুলোকে সংঘর্ষে জড়িয়ে ফেলতে পারে।

ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ইরান ভিয়েনায় হওয়া চুক্তির শর্ত ধারাবাহিকভাবে লঙ্ঘন করতে থাকলে অবশ্যই, অতি অল্প সময়ের মধ্যে, হয়তো এক থেকে বছরের মধ্যেই তারা পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের পিঠটানের পর ইরানের চড়া সুর : ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাবে যুক্তরাষ্ট্র আর সামরিক সংঘাতে না গিয়ে পিছিয়ে আসার পর এবার সুর চড়িয়েছে ইরান।

দেশটির রেভল্যুশনারি গার্ডের এক কমান্ডার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শিগগিরই জেনারেল সোলেমানি হত্যার ‘আরও কঠোর বদলা’ নেবে ইরান। সোলেমানির বদলা নিতে ইরাকের দুটি মার্কিন ঘাঁটিতে ইরান ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়।

ওই হামলায় কোনো আমেরিকানের প্রাণহানি হয়নি। সেনারা সব অক্ষত আছে এবং সেনা ঘাঁটিরও খুব সামান্যই ক্ষতি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

ইরান বলেছে, তারা আত্মরক্ষার্থে হিসাব-নিকাশ করে ভারসাম্যপূর্ণভাবেই মার্কিন ঘাঁটিতে প্রতিশোধমূলক হামলা চালিয়েছে। তবে ইরান এমন কথা বললেও ওই অঞ্চলের কর্মকর্তারা অবশ্য সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন, ইরান হয়তো এতেই ক্ষান্ত নাও দিতে পারে এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে তাড়ানোর যে লক্ষ্য তারা স্থির করেছে তা থেকে নাও সরে আসতে পারে।

এ আশঙ্কার মধ্যেই রেভল্যুশনারি গার্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আরাঘি জানান, ইরানের সশস্ত্র বাহিনী খুব শিগগিরই শত্র“পক্ষের ওপর আরও কঠোর প্রতিশোধ নেবে। রেভল্যুশনারি গার্ড বাহিনীর ডেপুটি জেনারেল আলি ফাদাভিও প্রতিশোধ নেয়ার অঙ্গীকার করেছেন।

মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার পদক্ষেপটি ইরানের শক্তির প্রদর্শনী ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, কোনো দেশই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কখনও আমাদের মতো এমন বড় ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি। আমরা ইরাকের মার্কিন ঘাঁটির প্রাণকেন্দ্রে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছি। আর তারা এর জবাবে কিছুই করতে পারেনি। এ অঞ্চল থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে তাড়ানোই ইরানের চূড়ান্ত লক্ষ্য জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইসমাইল ঘানি।