কিভাবে ঈদ উদযাপন করবেন

কিভাবে ঈদ উদযাপন করবেন

ইসলামে ঈদ এবং এর উদযাপন বিশেষ তাৎপর্য ও চেতনা বহন করে

কিভাবে ঈদ উদযাপন করতে হবে, ইসলাম মুসলমানদের তা শিক্ষা দিয়েছে। দুই ঈদের দিনে মুসলমানরা গোসল করে তাদের সবচেয়ে ভালো পোশাক পরিধান করে। ঈদের দিন রোজা রাখার অনুমতি নেই। তবু নিছক খানাপিনাই ঈদের প্রধান দিক নয়, বরং নামাজই ঈদের বড় বিষয়। এই নামাজ আল্লাহতায়ালার নিয়ামতের কথা স্মরণ এবং তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও গৌরব উদযাপনের জন্য মুসলমানদের একত্রিত করে থাকে।

ইসলামে ঈদ এবং এর উদযাপন বিশেষ তাৎপর্য ও চেতনা বহন করে। অন্যান্য জাতি ও সংস্কৃতির আনন্দ উৎসব থেকে এটা সম্পূর্ণ আলাদা। অন্যান্য জাতির জন্য ছুটির দিন হলো পার্থিব আনন্দ-উপভোগে নিমজ্জিত হওয়া কিংবা হারাম কাজে নিজেকে চরমভাবে লিপ্ত করার সুযোগ। মুসলিমদের ক্ষেত্রে এটা হয় না। কারণ, ঈদ নেক কাজ বাড়ানোর একটি উপলক্ষ। প্রতিটি ঈদ হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের সমাপ্তি এবং মহান আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ অব্যাহত রাখার প্রত্যয়ের স্মারক।
পরম আনন্দ কিংবা চরম দুঃখের মুহূর্তে মুসলমান তার মহান প্রভুর শ্রেষ্ঠত্ব, শক্তি, গৌরব এবং নজরদারির বিষয় কখনো ভোলে না। আর এই অব্যাহত স্মরণ ও সতর্কতাই একজন মুসলমানের কার্যকলাপকে সব সময়ে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।


এই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, ইসলাম নির্দেশিত দায়দায়িত্ব ও অঙ্গীকার থেকে অব্যাহতি লাভ কিংবা সময় ও অর্থের অপচয় ঘটানোর কোনো উপলক্ষ নয় ঈদ। ‘আনন্দের খাতিরে আনন্দ’ নয় এটা, বরং ঈদের অর্থ নিয়ন্ত্রিত ও নির্দেশিত আনন্দ, যা মুসলমানদের জন্য সুনির্দিষ্ট ও পরম কল্যাণ বহন করে

ঈদ হচ্ছে এমন এক সুযোগ, যা সৎ কাজ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। আর এটা করা হয় অপরাপর মুসলমানের মনে সুখ ও আনন্দ এনে, দুস্থ-দরিদ্রদের সাহায্য-সহায়তা দিয়ে এবং ইসলামের জোরালো বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আনন্দ-বিনোদনে সম্পৃক্ত হয়ে।


‘ঈদ’ একটি আরবি শব্দ। এর মূল অর্থ, যা ফিরে ফিরে আসে বা যার পুনরাবৃত্তি ঘটে থাকে। ঈদ প্রতি বছর দু’বার প্রত্যাবর্তন করে। ‘ঈদ’-এর বহুল প্রচলিত শাব্দিক অর্থ হলো আনন্দ-উৎসব। প্রত্যেক জাতির উৎসব রয়েছে। আসমানি কিতাবের অনুসারী হোক অথবা মূর্তিপূজারী হোক কিংবা অন্য কিছু, সবাই উৎসবের আয়োজন করে থাকেন। কারণ, আনন্দ উদযাপন করা মানব প্রকৃতির একটি সহজাত বৈশিষ্ট্য। সবাই এমন কোনো বিশেষ উপলক্ষ উদযাপন করতে চায়, যখন তারা একত্র হয়ে সুখ ও আনন্দ প্রকাশ করতে পারবে।
বিভিন্ন জাতির উৎসব বর্ষ শুরু, কৃষি মৌসুমের সূচনা, আবহাওয়া পরিবর্তন, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, শাসকের ক্ষমতা গ্রহণ প্রভৃতি পার্থিব বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত থাকতে পারে। ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে কিছু ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট। যেমন ক্রিসমাস, থ্যাঙ্কসগিভিং ইত্যাদি। বিশেষত ইউরোপ-আমেরিকার দেশে দেশে এসব উদযাপিত হয়ে থাকে। অজ্ঞতাবশত মুসলমানদের কেউ কেউ এগুলোতে অংশ নিতে পারে। জরথুস্ত্রবাদী বা পারসিক সম্প্রদায় মাহরাজান উৎসব পালন করে।


আমরা বিদায় জানাই মাহে রমজানকে। এর সুন্দর দিন আর সুবাসিত রাত্রিকে। আমরা বিদায় জানাই কুরআনের মাসটিকে। এই মাস আল্লাহভীতি, ধৈর্য, জিহাদ, দয়া ও করুণা, ক্ষমা এবং জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির।


আমরা কি তাকওয়ার চাহিদা পূরণ করেছি এবং ‘রমজান স্কুল’ থেকে ‘আল্লাহভীতির ডিপ্লোমা’ নিয়েছি? আমরা আমাদের প্রবৃত্তি ও কুকামনার বিরুদ্ধে লড়েছি, এগুলোকে পরাস্ত করেছি, নাকি আমরা পরাজিত হয়েছি সমাজে প্রচলিত কুপ্রথা ও অন্ধ অনুকরণের হাতে?


আমরা কি আমাদের কার্যাবলি এমনভাবে সম্পাদন করেছি যে, আল্লাহর করুণা ও ক্ষমা অর্জন আর দোজখের আগুন থেকে মুক্তি লাভের যোগ্য হয়েছি?
এমন বহু প্রশ্ন এবং অসংখ্য ভাবনা জন্ম নেয় নিষ্ঠাবান মুসলিমের হৃদয়ে, যাদের জিজ্ঞাসা ও জবাব দুটোই হয়ে থাকে সত্যবাদিতার সাথে।


আমরা মাহে রমজান থেকে কী শিখেছি? রমজান হলো ঈমানের বিদ্যায়তন। এটা একজন মানুষের ‘আধ্যাত্মিক ব্যাটারি রিচার্জ’ করার সুযোগের মতো। এভাবে বছরের বাকি এগারো মাসের আধ্যাত্মিক রসদ জোগানো হয়। তাই বলতে হয়, যদি রমজানের মাসে শিক্ষা না নিই এবং জীবনকে আরো উন্নত করতে বদলে না দিই, তাহলে এ জন্য রমজানের চেয়ে বেশি উপযোগী সময় আর আছে কি?


রমজান একটি মহান মাস, যা মানুষের চরিত্রে রূপান্তর ঘটানোর শিক্ষাদানের প্রকৃত বিদ্যাপীঠ। এ মাসটিতে আমরা নিজেদের সেসব কাজকর্ম, অভ্যাস-আচরণ বদলে ফেলি, যেগুলো আল্লাহর বিধানমাফিক হয়নি। কুরআনের সূরা আর রা’দ-এর ১১ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলছেন, ‘নিশ্চয়ই, আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটায়।’


আপনি যদি তাদের একজন হয়ে থাকেন, যারা রমজান থেকে কল্যাণ অর্জন করেছেন, পূরণ করেছেন তাকওয়ার চাহিদা, এ মাসে প্রকৃত অর্থেই রোজা পালন করেছেন, নামাজ আদায় করেছেন যথাযথভাবে এবং প্রবৃত্তির তাড়নায় মোকাবেলা করে গেছেন সংগ্রাম, তাহলে আল্লাহর প্রশংসা করুন, তাঁকে ধন্যবাদ দিন এবং আমৃত্যু যেন দৃঢ়তার সাথে এভাবে তাঁর পথে চলতে পারেন, সে জন্য তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করুন।


যে ব্যক্তি একটি জামা তৈরি করার পর তা ধ্বংস করে দিয়েছে, তার মতো হবেন না। আপনি কি এমন কাউকে দেখেছেন যে একটি জামা বা পোশাক সেলাই করল, সেটা পছন্দ করল। কিন্তু তারপর সেটাকে বিনা কারণে একটার পর একটা সুতা খুলে দিলো ধ্বংস করে? এমন লোককে মানুষ কী বলবে? এক ব্যক্তি দিনভর ব্যবসা করে মুনাফা পেল। যখন রাত এলো, দিনের সব উপার্জন সে ছুড়ে ফেলে দিলো। এমন লোক দেখেছেন কি? মানুষ তাকে কী ভাববে?


এই দৃষ্টান্ত দু’টি সে ব্যক্তির যে রমজানের পর আল্লাহর আনুগত্য ও নেক আমল ছেড়ে আবার গোনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ে। রমজানে সে আল্লাহর অনুগত থেকে তাঁর রহমত পেয়েছিল এবং তাঁর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ মিলেছিল। কিন্তু রমজান শেষে লোকটি পাপের অগ্নিশিখার দিকে ফিরে গেল। যারা শুধু রোজার মাসে আল্লাহকে স্মরণ করে, তারা কতই না মন্দ।


রমজানের পর ইসলাম প্রতিপালনে উদাসীনতা নানাভাবে প্রতিভাত হয়ে থাকে। যেমন এ মাসে তারাবিহ আদায়ের জন্য যেখানে মসজিদ থাকে ভরপুর, সেখানে রমজান শেষ হলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ছেড়ে দেয়া কিংবা অশ্লীল গানবাজনা ও সিনেমা উপভোগ করা, মহিলাদের অশালীন চলাফেরা, নারী-পুরুষ অবাধ মেলামেশা ইত্যাদি।
নিশ্চয়ই এসব কাজ আল্লাহর রহমত লাভের অনুকূল নয়। এসব কাজ তাঁর কাছে গ্রহণীয় হতে পারে না।


যিনি প্রকৃতপক্ষেই রোজা পালন করেন, ঈদে আনন্দ উপভোগ করেন, সব রোজা সম্পন্ন করায় সাহায্যের জন্য আল্লাহর প্রশংসা করেন, অপর দিকে ভীত থাকেন এটা ভেবে যে, আল্লাহ তার রোজা কবুল না-ও করতে পারেন, তিনি আল্লাহতায়ালার আশ্রয়ই প্রার্থনা করে থাকেন। ইসলামের প্রথম যুগের মুসলমানরা মাহে রমজানে তাদের করা আমলগুলো কবুলের জন্য এর পর ছয় মাস ধরে আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন।


আল্লাহতায়ালা রোজা কবুল করার একটি লক্ষণ হলো, রোজাদার নারী বা পুরুষের মধ্যে রমজানের পর আল্লাহর আনুগত্য বৃদ্ধি পায়। সূরা ইবরাহীমের ৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর স্মরণ করো যখন তোমার প্রভু ঘোষণা করলেন : যদি তুমি কৃতজ্ঞ হও, আমি নিশ্চিতই তোমার রিজিক বাড়িয়ে দেবো (আমার অনুগ্রহের ক্ষেত্রে)।’ যদি বান্দা তার প্রভুর প্রতি সত্যিই কৃতজ্ঞ হয়ে থাকে, সে আরো বেশি হবে অনুগত এবং আরো বেশি সরে যাবে গোনাহর কাজ থেকে। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রমাণ, পাপকর্ম আরো অধিক হারে বর্জন। ইসলামের সূচনাকালের মুসলিমরা এটাই বলতেন।


‘আর আপনার প্রভুর উপাসনা করুন, যে পর্যন্ত না আপনার কাছে নিশ্চিত কথা (অর্থাৎ মৃত্যু) আসে’ (সূরায়ে হিজর, আয়াত ৯৯)। মুসলমানদের অবশ্যই অব্যাহতভাবে আল্লাহর অনুগত থাকতে হবে, তাঁর শরীয়াহ প্রতিপালনে এবং দীনের অনুসরণে দৃঢ়তার প্রমাণ দিতে হবে অবিরাম। তা হলেই ওদের মতো হবেন না, যারা কেবল বিশেষ একটি মাসে কিংবা শুধু একটি জায়গায় আল্লাহর ইবাদত করে থাকে। ঈমানদার মানুষ ভালো করেই জানেন, রমজান মাসের প্রভু বছরের অন্য সব মাসেরও প্রভু এবং তিনি সর্বকাল ও স্থানেরই প্রভু। তাই মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর সাথে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত শরীয়াহ পালনে অটল থাকেন। আর যখন সাক্ষাৎ ঘটে, আল্লাহতায়ালা তার ওপর হন সন্তুষ্ট।
আল্লাহতায়ালা বলছেন, অতএব সঠিক পথ অনুসরণ করতে থাকো যেভাবে তোমাদের আদেশ দেয়া হয়েছে, (তুমি) এবং যারা তোমার সাথে মুখ ফিরিয়েছে (আল্লাহর দিকে) [সূরা হুদ, আয়াত-১১২] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, বলো, আমি আল্লাহর ওপর ঈমান রাখি, এরপর এতে অটুট থেকো (সহীহ মুসলিম)।


মাহে রমজানের ফরজ বা বাধ্যতামূলক রোজা শেষ হলে বছরের অন্য সময়ে নফল বা স্বেচ্ছামূলক রোজা থাকে। যেমন শাওয়াল মাসে ছয় দিন, সোমবার ও বৃহস্পতিবার, এ মাসের মাঝামাঝি তিন দিন, আশুরা ও আরাফাতের দিনের রোজা ইত্যাদি।
রমজানের তারাবিহ শেষ হলে বছরের বাদবাকি সময়ে প্রতি রাতে নফল ইবাদতের সুযোগ আছে। আল-কুরআনে বলা হয়েছে তারা রাতে সামান্যই নিদ্রা যেত (আয যারিয়াত : ১৭)।


রমজানের দান-খয়রাত ও ফিতরাহ ছাড়াও রয়েছে ফরজ ইবাদত হিসেবে জাকাত দেয়া। এর বাইরেও দয়া-দাক্ষিণ্যের এ স্বেচ্ছাসেবক বহু পথ খোলা আছে।


কুরআন মজিদ তিলাওয়াত এবং এর সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা শুধু রমজান মাসের জন্য নয়, সব সময়ের জন্যই। নেক কাজ সর্বদা সর্বত্র করণীয়। অতএব আলস্য ঝেড়ে ফেলে কঠিন পরিশ্রম করুন আল্লাহর পথে। মনে রাখুন, ফরজ কাজ ত্যাগ করা কিংবা এ ক্ষেত্রে বিলম্ব ঘটানোর অবকাশ নেই। যেমন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যথাযথভাবে আদায় করা। অপর দিকে বিরত থাকা চাই হারাম কথা ও কাজ, খাদ্য-পানীয় থেকে। যা দেখা বা শোনা হারাম, তা-ও নিষিদ্ধ।


আমরা কখন, কোন মুহূর্তে মৃত্যুদূতের সাক্ষাৎ পাবো, তা কেউই জানি না। তাই জীবনের সর্বক্ষণ আল্লাহর দীনের আনুগত্যে অটুট থাকা জরুরি। আপনি পাপকাজে লিপ্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবেন কি না, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। মানবহৃদয়ে পরিবর্তন আনেন আল্লাহই। সে অন্তর যাতে তাঁর পথে অটল থাকে, সে সামর্থ্য তাঁর কাছে কামনা করুন।


আল্লাহ, আমাদের রোজা, নামাজ এবং অন্য সব নেককাজ কবুল করে নিন। আমাদের মান যেন রমজানের পর আরো উন্নত হয়। উম্মাহর অবস্থার যেন ঘটে উন্নতি। আমরা সবাই যেন সত্যিকারভাবেই আমাদের প্রভুর দিকে ফিরে যাই। আমীন
ভাষান্তর : মীযানুল করীম