আল্লাহর আযাবে ধ্বংশ হয়েছিল যারাঃ প্রসঙ্গ নূহ (আঃ) ও তাঁর উম্মাত

আল্লাহর আযাবে ধ্বংশ হয়েছিল যারাঃ প্রসঙ্গ নূহ (আঃ) ও তাঁর উম্মাত

প্রফেসর ড. মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান

প্রফেসর ড. মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান

নূহ আলাইহিস সালাম আল্লাহর একজন মহাসম্মানিত, দৃঢ়চিত্ত ও উচ্চ মর্যাদাশীল রাসূল ছিলেন। আদম আলাইহিস সালাম-এর পরে ইনি প্রথম নবী, যাকে প্রথম রাসূল হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। তিনি সর্বপ্রথম যাবতীয় হুকুম আহ্কাম ও বিধি-বিধানের প্রবর্তক ছিলেন। ফলে, পরবর্তীতে যাবতীয় বিধি-বিধান তাঁর পথ ধরেই প্রণীত হয়েছে।

আদম (আঃ) থেকে নূহ (আঃ) পর্যন্ত দশ শতাব্দীর ব্যবধান ছিল। যার শেষ দিকে মানবকুলে ক্রমবর্ধমান শিরক ও কুসংস্কারের আবির্ভাব ঘটে এবং তা বিস্তৃতি লাভ করে। ফলে তাদের সংশোধনের জন্য আল্লাহ নূহ (আঃ)-কে নবী ও রাসূল করে পাঠান। তিনি সাড়ে নয়শত বছরের দীর্ঘ জীবন লাভ করেছিলেন এবং সারা জীবন পথহারা মানুষকে সঠিক পথে আনার জন্য দাওয়াতী কাজ চালিয়ে যান। কিন্তু গোটা জাতি আল্লাহকে অস্বীকার করেছিল আর রাসূলের প্রতি হঠকারিতা দেখিয়েছিল, সেহেতু আল্লাহ নূহ ও সেই ক’জন মুমিনকে রেখে সেদিনের পৃথিবীর গোটা মানবজাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। ফলে সত্যের পথে আপতিত বাধাবিঘ্ন প্রতিরোধকারী স্বল্প সংখ্যক হকের ঝাণ্ডাবাহকদের খাতিরে আল্লাহ তা‘আলা কাফিরদের ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। যদিও তারা ছিল সংখ্যাগুরু। 

নূহ (আঃ)-এর পরিচয়:

নূহ আলাইহিস সালাম এর নাম ছিল আবদুশ-শাকুর অথবা আবদুল গাফ্ফার। (ইসলামী বিশ্বকোষ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, বায়তুল মোকাররম-১৯৯৩,১৪শ খন্ড, পৃ. ২২৩।) অত্যধিক রোনাজারী ও ক্রন্দনের ফলে তাঁর উপাধি হয় নূহ। (মাহমুদ আলূসী, রুহুল মা‘আনী, মাকতাবাতে এমদাদীয়া, মুলতান, তা.বি, ৮ম খন্ড, পৃ. ১৪৯।)

পরবর্তীতে এ উপাধিতেই তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন। (ابو البشر الثانى ) বা মানবজাতির দ্বিতীয় পিতা হিসেবে পরিচিত নূহ (আলাইহিস সালাম) ছিলেন আদম (আলাইহিস সালাম)-এর দশম অথবা অষ্টম অধঃস্তন পুরুষ। আদম (আঃ) ৯৬০ বছর বেঁচে ছিলেন এবং নূহ (আঃ) ৯৫০ বছর জীবন পেয়েছিলেন। নূহ (আঃ) ইরাকের মূছেল নগরীতে স্বীয় সম্প্রদায়ের সাথে বসবাস করতেন। তারা বাহ্যতঃ সভ্য হ’লেও শিরকের অন্ধকারে নিমজ্জিতছিল। তিনি তাদের হেদায়াতের জন্য প্রেরিত  হয়েছিলেন। আল্লাহবলেন,

لَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوْحاً إِلَى قَوْمِهِ فَقَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوْا اللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَـهٍ غَيْرُهُ إِنِّيْ أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيْمٍ-

‘নিশ্চয়ই আমি নূহকে তাঁর জাতির নিকট প্রেরণ করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, হে আমার জাতি! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, যিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন উপাস্য নেই। আমি তোমাদের জন্য এক কঠিন দিবসের শাস্তির ভয় করি’ (সূরা আল-আ‘রাফ -৫৯)।

তিনি ছিলেন পৃথিবীতে প্রথম রাসূল। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, তিনি চল্লিশ বছর বয়সে নবুয়াত লাভ করেন এবং মহাপ্লাবনের পর ষাট বছর জীবিত ছিলেন। ফলে সুদীর্ঘকাল যাবত তিনি নবী হিসাবে শিরকে নিমজ্জিত হঠকারী কওমকে দাওয়াত দেন। প্লাবনের পর তাঁর সাথে নৌকারোহী মুমিন নর-নারীদের মাধ্যমে পৃথিবীতে নতুনভাবে আবাদ শুরু হয় এবং তাদেরকে তিনি সত্যের পথে পরিচালিত করেন। এ কারণে তাঁকে ‘মানব জাতির দ্বিতীয় পিতা’ বলা হয়।

উল্লেখ্য যে, কুরআনে বেশী মাত্রায় তাঁর প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। ২৯টি সূরার ৪৩ স্থানে তাঁর কথা এসেছে। এমনকি,‘‘নূহ’’ নামে একটি সূরাও নাযিল করা হয়েছে। বলা চলে কুরআনের এক চতুর্থাংশ সূরায় প্রসঙ্গটি স্থান পেয়েছে।

নূহ (আঃ)-এর দাওয়াত ও তার প্রতিক্রিয়া:

নূহ (আঃ) তাঁর সাড়ে নয়শত বছরের সুদীর্ঘ জীবনে শতাব্দীর পর শতাব্দী অক্লান্তভাবে দাওয়াত দেওয়া সত্ত্বেও তাঁর কাওম ঈমান আনেনি। তাঁর কওম সংখ্যাশক্তি ও ধনাঢ্যতার শিখরে উপনীত হয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। তারা নূহ (আঃ)-এর দাওয়াতকে তাচ্ছিল্য ভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল। নূহ (আঃ) তাদেরকে দিবারাত্রি দাওয়াত দেন। কখনো গোপনে কখনো প্রকাশ্যে অর্থাৎ সকলপন্থা অবলম্বন করে তিনি তাদেরকে দ্বীনের পথে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করেন (সূরা নূহ ৫-৯)।

আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, এই সুদীর্ঘ সময়ে তিনি যেমন কখনো চেষ্টায় ক্ষান্ত হননি, তেমনি কখনো নিরাশও হননি। সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে নানাবিধ নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েও তিনি ছবর করেন। কওমের নেতারা বলল,

قَالُوا لَئِنْ لَمْ تَنْتَهِ يَا نُوحُ لَتَكُونَنَّ مِنَ الْمَرْجُومِينَ

‘হে নূহ! যদি তুমি বিরত না হও, তবে পাথর মেরে তোমার মস্তক চূর্ণ করে দেওয়া হবে’ (সূরা আশ-শো‘আরা ১১৬)। তবুও বারবার আশাবাদী হয়ে তিনি  দাওয়াত অব্যহত রাখেন। আর তাদের জন্য দো‘আ করে বলতে থাকেন, 

رَبِّ اغْفِرْلِ قَوْمِيْ إَنَّهُمْ لاَيَعْلَمُوْنَ- 

হে আমার পালনকর্তা! তুমি আমার কওমকে ক্ষমা কর। কেননা তারা জানে না’ (তাফসীর কুরতুবী, সূরা নূহ)।

ওদিকে তাঁর সম্প্রদায়ের অনীহা, অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য এবং ঔদ্ধত্য ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক্ব বলেন, ‘নিহত কোন নবী ব্যতীত অন্য কোন নবী তার কওমের নিকট থেকে নূহের মত নির্যাতন ভোগ করেননি’ (ইবনু কাছীর, সূরা আল-আ‘রাফ ৫৯-৬২)। বলা চলে যে, তাদের অহংকার ও অত্যাচার চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল এবং পাপ ষোলকলায় পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। আল্লাহর চিরন্তন নীতি এই যে, তিনি অবাধ্য জাতিকে সাময়িকভাবে অবকাশ দেন (সূরাতুল বাক্বারাহ-১৫)। ফলে এক পর্যায়ে নূহ (আঃ) স্বীয় কওমকে ডেকে বললেন,

وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ نُوحٍ إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ يَا قَوْمِ إِنْ كَانَ كَبُرَ عَلَيْكُمْ مَقَامِي وَتَذْكِيرِي بِآَيَاتِ اللَّهِ فَعَلَى اللَّهِ تَوَكَّلْتُ فَأَجْمِعُوا أَمْرَكُمْ وَشُرَكَاءَكُمْ ثُمَّ لَا يَكُنْ أَمْرُكُمْ عَلَيْكُمْ غُمَّةً ثُمَّ اقْضُوا إِلَيَّ وَلَا تُنْظِرُونِ (71) فَإِنْ تَوَلَّيْتُمْ فَمَا سَأَلْتُكُمْ مِنْ أَجْرٍ إِنْ أَجْرِيَ إِلَّا عَلَى اللَّهِ وَأُمِرْتُ أَنْ أَكُونَ مِنَ الْمُسْلِمِينَ (72) فَكَذَّبُوهُ فَنَجَّيْنَاهُ وَمَنْ مَعَهُ فِي الْفُلْكِ وَجَعَلْنَاهُمْ خَلَائِفَ وَأَغْرَقْنَا الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُنْذَرِينَ (73)

‘হে আমার কওম! যদি তোমাদের মাঝে আমার অবস্থিতি ও আল্লাহর আয়াত সমূহের মাধ্যমে তোমাদের উপদেশ দেওয়া ভারি বলে মনে হয়, তবে আমি আল্লাহর উপরে ভরসা করছি। এখন তোমরা তোমাদের যাবতীয় শক্তি একত্রিত কর ও তোমাদের শরীকদের সমবেত কর, যাতে তোমাদের মধ্যে কোনরূপ দ্বিধা-সংকোচ না থাকে। অতঃপর আমার ব্যাপারে একটা ফায়ছালা করে ফেল এবং আমাকে মোটেও অবকাশ দিয়ো না। ‘এরপরেও যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও। তবে জেনে রেখ, আমি তোমাদের কাছে কোনরূপ বিনিময় কামনা করি না। আমার বিনিময় কেবলমাত্র আল্লাহর নিকটেই রয়েছে। আর আমার প্রতি নির্দেশ রয়েছে যেন আমি আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত হই’। ‘কিন্তু তারপরও তারা তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল (সূরাইউনুস-৭১-৭৩)। এ সময় আল্লাহ পাক অহী নাযিল করে বলেন,

أَنَّهُ لَنْ يُؤْمِنَ مِنْ قَوْمِكَ إِلَّا مَنْ قَدْ آَمَنَ فَلَا تَبْتَئِسْ بِمَا كَانُوا يَفْعَلُونَ

‘তোমার কওমের যারা ইতিমধ্যে ঈমান এনেছে, তারা ব্যতীত আর কেউ ঈমান আনবে না। অতএব তুমি ওদের কার্যকলাপে বিমর্ষ হয়ো না’ (সূরা হূদ -৩৬)। এভাবে আল্লাহর অহী মারফত তিনি যখন জেনে নিলেন যে, এরা কেউ আর ঈমান আনবে না। বরং কুফর, শিরক ও পথভ্রষ্টতার উপরেই ওরা যিদ করে থাকবে, তখন নিরাশ হয়ে তিনি প্রার্থনা করলেন,

قَالَ رَبِّ انصُرْنِي بِمَا كَذَّبُوْنِ

‘হে আমার রব! আমাকে সাহায্য কর। কেননা ওরা আমাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করেছে’ (সূরা আল-মুমিনূন-২৬)। 

فَافْتَحْ بَيْنِي وَبَيْنَهُمْ فَتْحًا وَنَجِّنِي وَمَنْ مَعِيَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ

‘অতএব তুমি আমার ও তাদের মাঝে চূড়ান্ত ফয়ছালা করে দাও এবং আমাকে ও আমার সাথী মুমিনদেরকে তুমি (ওদের হাত থেকে) মুক্ত কর’ (সূরা আশ-শো‘আরা-১১৮)। তিনি আরো বললেন,  ‘তখন তিনি তাঁর রবকে আহবান করে বলেছিলেন, নিশ্চয় আমি অসহায়, অতএব আপনি প্রতিবিধান করুন’ (সূরা আল-ক্বামার-১০)। তিনি অতঃপর চূড়ান্তভাবে বদ দো‘আ করে বললেন,

وَقَالَ نُوحٌ رَبِّ لَا تَذَرْ عَلَى الْأَرْضِ مِنَ الْكَافِرِينَ دَيَّارًا (26) إِنَّكَ إِنْ تَذَرْهُمْ يُضِلُّوا عِبَادَكَ وَلَا يَلِدُوا إِلَّا فَاجِرًا كَفَّارًا

নূহ  আরো বলেছিলেন, হে আমার রব ! যমিনের কাফিরদের মধ্য থেকে কোন গৃহবাসীকে অব্যাহতি দেবেন না। আপনি তাদেরকে অব্যাহতি দিলে আপনার বান্দাদেরকে বিভ্রান্ত করবে এবং জন্ম দিতে থাকবে শুধু দুস্কৃতিকারী ও কাফির। (সূরা নূহ-২৬-২৭)।

বলা বাহুল্য, নূহ (আঃ)-এর এই দো‘আ আল্লাহ সাথে সাথে কবুল করেন। যার ফলে তাদের ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হ’ল এবং কেবলমাত্র মুষ্টিমেয় মুমিন নর-নারী মুক্তি পেলেন। বর্তমান পৃথিবীর সবাই তাদের বংশধর। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা তাদের বংশধর, যাদেরকে আমরা নূহের সাথে (নৌকায়) সওয়ার করিয়েছিলাম। বস্তুত: সে ছিল একজন কৃতজ্ঞ বান্দা’ (সূরাতুল ইসরা-৩; সূরা আস-সাফফাত -৭৭)।

গযবের কারণ: 

নূহ (আ.) এর প্রতি মিথ্যা বাদীর অপবাদ, শিরক ও কুফুরীতে আকন্ঠ নিমজ্জিত থাকা, তারা সতর্ক থাকা সত্ত্বেও বারবার দাওয়াতকে অস্বীকার করা এবং সর্বোপরী তাদের নেতাদের অহমিকাই তাদের উপর আজাব আসার মূল কারণ। (সূরা হুদ-২৭) এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন, 

مِمَّا خَطِيئَاتِهِمْ أُغْرِقُوا فَأُدْخِلُوا نَارًا فَلَمْ يَجِدُوا لَهُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْصَارًا

‘তাদের অপরাধের কারণে তাদেরকে (প্লাবনে) নিমজ্জিত করা হয়েছিল। অতঃপর তাদেরকেঅগ্নিতে প্রবেশ করানো হয়েছিল। কিন্তু নিজেদের জন্য আল্লাহর মুকাবেলায় কাউকে তারা সাহায্যকারী পায়নি’ (সূরা নূহ-২৫)।

নূহের প্লাবন ও গযবের কুরআনী বিবরণ:

সূরা হূদের ৩৭-৪৮  আয়াতগুলোতে এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছ। মহান আল্লাহ বলেন “তুমি আমার সম্মুখে আমারই নির্দেশনা মোতাবেক একটা নৌকা তৈরী কর এবং (স্বজাতির প্রতি দয়া পরবশ হয়ে) যালেমদের ব্যাপারে আমাকে কোনো কথা বলো না। অবশ্যই ওরা ডুবে মরবে’ (সূরা হূদ -৩৭)। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর নূহ নৌকা তৈরী শুরু করল। তার কওমের নেতারা যখন পাশ দিয়ে যেত, তখন তারা তাকে বিদ্রুপ করত। নূহ তাদের বলল, তোমরা যদি আমাদের উপহাস করে থাক, তবে জেনে রেখো তোমরা যেমন আমাদের উপহাস করছ, আমরাও তেমনি তোমাদের উপহাস করছি’ (সূরা হূদ -৩৮)। ‘অচিরেই তোমরা জানতে পারবে লাঞ্ছনাকর আযাব কাদের উপরে আসে এবং কাদের উপরে নেমে আসে চিরস্থায়ী গযব’ (সূরা হূদ ৩৯)। আল্লাহ বলেন, ‘অবশেষে যখন আমার হুকুম এসে গেল এবং চুলা উদ্বেলিত হয়ে উঠল, (অর্থাৎ রান্নার চুলা হ’তে পানি উথলে উঠলো), তখন আমি বললাম, সর্বপ্রকার জোড়ার দু’টি করে এবং যাদের উপরে পূর্বেই হুকুম নির্ধারিত হয়ে গেছে, তাদের বাদ দিয়ে তোমার পরিবারবর্গ ও সকল  ঈমানদারগণকে নৌকায় তুলে নাও। বলা বাহুল্য, অতি অল্প সংখ্যক লোকই তার সাথে ঈমান এনেছিল’ (৪০)। ‘নূহ তাঁদের বলল, তোমরা এতে আরোহণ কর। আল্লাহর নামেই এর গতি ও স্থিতি। নিশ্চয়ই আমার প্রভু অতীব ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (৪১)।

‘অতঃপর নৌকাখানি তাদের বহন করে নিয়ে চলল পর্বতপ্রমাণ তরঙ্গমালার মাঝ দিয়ে। এ সময় নূহ তার পুত্রকে (ইয়ামকে) ডাক দিল- যখন সে দূরে ছিল, হে বৎস! আমাদের সাথে আরোহণ কর, কাফেরদের সাথে থেকো না’ (৪২)। ‘সে বলল, অচিরেই আমি কোনো পাহাড়ে আশ্রয় নেব। যা আমাকে প্লাবনের পানি হ’তে রক্ষা করবে’। নূহ বলল, ‘আজকের  দিনে আল্লাহর হুকুম থেকে কারু রক্ষা নেই, একমাত্র তিনি যাকে দয়া করবেন সে ব্যতীত।  এমন সময় পিতা-পুত্র উভয়ের মাঝে বড় একটা ঢেউ এসে আড়াল করল এবং সে ডুবে গেল’ (৪৩)। অতঃপর নির্দেশ দেওয়া হ’ল, হে পৃথিবী! তোমার পানি গিলে ফেল (অর্থাৎ হে প্লাবনের পানি! নেমে যাও)। হে আকাশ! ক্ষান্ত হও (অর্থাৎ তোমার বিরামহীন বৃষ্টিবন্ধ কর)। অতঃপর পানি হরাস পেলও গযব শেষ হ’ল। ওদিকে জূদীপাহাড়ে গিয়ে নৌকা ভিড়ল এবং ঘোষণা করা হ’ল, যালেমরা নিপাত যাও’ (৪৪)। ‘এ সময় নূহ তার প্রভুকে ডেকে বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমার পুত্র তো আমার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত, আর তোমার ওয়াদাও নিঃসন্দেহে সত্য, আর তুমিই সর্বাপেক্ষা বিজ্ঞ ফায়ছালাকারী (৪৫)। ‘আল্লাহ বললেন, হে নূহ! নিশ্চয়ই সে তোমার  পরিবারভুক্ত নয়। নিশ্চয়ই সে দুরাচার। তুমি আমার নিকটে এমন বিষয়ে আবেদন কর না, যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই। আমি তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি যেন জাহিলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’ (৪৬)। ‘নূহ বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমার অজানা বিষয়ে আবেদন করা হ’তে আমি তোমার নিকটে পানাহ চাচ্ছি। তুমি যদি আমাকে ক্ষমা না কর ও অনুগ্রহ না কর, তাহ’লে আমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’ (৪৭)। ‘বলা হ’ল, হে নূহ! এখন (নৌকা থেকে) অবতরণ কর আমাদের পক্ষ হ’তে নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি সহকারে তোমার উপর ও তোমার সঙ্গী দলগুলির উপর এবং সেই (ভবিষ্যৎ) সম্প্রদায় গুলির উপর- যাদেরকে আমরা সত্বর সম্পদরাজি দান করব। অতঃপর তাদের উপরে আমাদের পক্ষ হ’ত মর্মান্তিক আযাব স্পর্শ করবে’ (৪৮)। সূরা হূদে বর্ণিত উপরোক্ত আয়াত সমূহে নূহ (আঃ)-এর প্লাবনের নাতিদীর্ঘ ঘটনা বিবৃত হয়েছে। তা মোটামুটি নিম্নরূপঃ

নৌকা (কিশতী) তৈরীর আদেশ: 

আল্লাহ নির্দেশ দিলেন, আর আপনি আমাদের চাক্ষুষ তত্ত্বাবধানেও আমাদের ওহী অনুযায়ী নৌকা তৈরী করুন।’ (সূরা হূদ ৩৭; আল-মুমিনূন ২৭)। নূহ (আঃ)-কে যখন নৌকা তৈরীর নির্দেশ দেওয়া হয়, তখন তিনি নৌকাও চিনতেন না, তৈরী করতেও জানতেন না। আল্লাহর নির্দেশনার আলোকে নূহ (আ,) নৌকা তৈরী করলেন। একথা অনুমান করা মোটেই অমূলক হবে না যে, উক্ত নৌকা তৈরী করতে নূহ (আঃ)-এর বহুদিন সময় লেগেছিল। আয়তনে নৌকাটি অনেক বড় ছিল। যাতে মানুষ, পশু ও পাখি পৃথকভাবে থাকতে পারে। কিন্তু এজন্য নৌকাটি কয় তলা বিশিষ্ট ছিল, কি কাঠের ছিল, কত গজ লম্বা ও চওড়া ছিল, এসব কাহিনীর কোনো সঠিক ভিত্তি নেই। নদীবিহীন মরু এলাকায় বিনা কারণে নৌকা তৈরী করাকে পন্ডশ্রম ও নিছক পাগলামি বলে ‘কওমের নেতারা নূহ (আঃ)-কে ঠাট্টা করত’ (সূরা হূদ-৩৮)। এ ব্যাপরে নূহ (আঃ) বলতেন, তোমাদের ঠাট্টার জবাব সত্বর তোমরা জানতে পারবে (সূরা হূদ-৩৯)।

 তান্নূর ও তূফান: 

দীর্ঘ দিন ধরে নৌকা তৈরী শেষ হবার পরেই আল্লাহর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেমে আসে এবং গযবের প্রাথমিক নিদর্শন হিসাবে ‘তান্নূর’ তথা চুলা থেকে পানি বের হ’তে থাকে। ‘তান্নূর’ বলা হয় মূলতঃ উনুন বা চুলাকে। ইরাকের মূছেল নগরীতে অবস্থিত নূহ (আঃ)-এর পারিবারিক চুলা থেকে পানি উথলে বের হওয়ার আলামতের মাধ্যমেই নূহের তুফানের সূচনা হয়। অর্থাৎ এটি ছিল প্লাবনের প্রাথমিক আলামত মাত্র (কুরতুবী)। ‘আল্লাহ বলেন, ‘আমরা নূহকে প্রেরণ করেছিলাম তার সম্প্রদায়ের নিকট। সে তাদের মধ্যে পঞ্চাশ কম এক হাজার বছর অবস্থান করেছিল। অতঃপর তাদেরকে ‘তূফান’ (অর্থাৎ মহা প্লাবন) গ্রাস করেছিল । আর তারা ছিল অত্যাচারী (সূরা আল-আনকাবূত -১৪)। যদিও অনেকে এর নানারূপ ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

অবিরাম বৃষ্টি:

ভূতলের উত্থিত পানি ছাড়াও তার সাথে যুক্ত হয়েছিল অবিরাম ধারায় বৃষ্টি। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অবশেষে যখন আমার হুকুম এসে পৌঁছল এবং চুলা উচ্ছ্বসিত হ’ল (অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠ পানিতে উদ্বেলিত হয়ে উঠল)-(সূরা হূদ ৪০)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

فَفَتَحْنَا أَبْوَابَ السَّمَاءِ بِمَاءٍ مُنْهَمِرٍ (11) وَفَجَّرْنَا الْأَرْضَ عُيُونًا فَالْتَقَى الْمَاءُ عَلَى أَمْرٍ قَدْ قُدِرَ (12) وَحَمَلْنَاهُ عَلَى ذَاتِ أَلْوَاحٍ وَدُسُرٍ (13) تَجْرِي بِأَعْيُنِنَا جَزَاءً لِمَنْ كَانَ كُفِرَ (14) وَلَقَدْ تَرَكْنَاهَا آَيَةً فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ (15)

‘তখন আমরা খুলে দিলাম আকাশের দুয়ারসমূহ প্রবল বারি পাতের মাধ্যমে’। ‘এবং ভূমি থেকে প্রবাহিত করলাম নদী সমূহকে। অতঃপর উভয় পানি মিলিত হ’ল একটি পূর্ব নির্ধারিত কাজে (অর্থাৎ ডুবিয়ে মারার কাজে)’। ‘আমি নূহকে আরোহন করালাম এককাষ্ঠ ও পেরেক নির্মিত জলযানে’।‘ যা চলত আমার দৃষ্টির সম্মুখে। এটা তার (অর্থাৎ আল্লাহর) পক্ষ থেকে প্রতিশোধ ছিল, যাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল’। ‘আমরা একে নিদর্শন হিসাবে রেখে দিয়েছি। অতএব কোনো চিন্তাশীল আছে কি’? (সূরা আল-ক্বামার ১১-১৫)। যে কারণে নূহ-পুত্র ‘ইয়াম’ পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েও রেহাই পায়নি (সূরা হূদ ৪৩)। ঐ সময় কোনো কোনো ঢেউ পাহাড়ের চূড়া হ’তেও উঁচু ছিল। অতঃপর প্লাবন বিধ্বংসীরূপ ধারণ করে এবং পাহাড়ের মত ঢেউয়ের মধ্য দিয়ে নৌকা চলতে থাকে’ (সূরা হূদ ৪২)।

নৌকায় আরোহণের নির্দেশ:

তূফানের আলামত প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে নূহ (আঃ)-কে আদেশ দেওয়া হ’ল, ‘জোড় বিশিষ্ট প্রত্যেক প্রাণীর এক এক জোড়া করে নৌকায় তুলে নাও’ (সূরা হূদ ৪০; সূরা আল-মুমিনূন ২৭)। এর দ্বারা কেবল ঐসব প্রাণী বুঝানো হয়েছে, যা নর ও মাদীর মিলনে জন্মলাভ করে এবং যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনে অতীব প্রয়োজনীয়। যেমন গরু-ছাগল, ঘোড়া-গাধা ও হাঁস-মুরগী ইত্যাদি পশু-পক্ষী।

নৌকার যাত্রী যারা হলেন:

শুধুমাত্র ঈমানদারগণকেই নৌকায় তোলার অনুমতি দিয়ে নূহ (আঃ)-কে নির্দেশ দেওয়া হয় কেবল ঈমানদার নর-নারীকে নৌকায় তুলে নিতে। এমনকি তাঁর পরিবারের মধ্যে তাঁর সন্তান যে ঈমান গ্রহন করেনি তাকেও বাদ দিতে বলা হয়েছে। উল্লেখ্য তাঁর পুত্র ইয়াম মতান্তরে কিন‘আন (কুরতবী) নিমজ্জিতদের অর্ন্তর্ভুক্ত ছিল। (সূরা হুদ-৪৩) যাদের সংখ্যা অতীব নগণ্য ছিল (সূরা হূদ ৪০ ও ৪৬ )। তাদের সঠিক সংখ্যা কুরআন বা হাদীসে উল্লেখিত হয়নি। তবে আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, তাদের সংখ্যা ছিল চল্লিশ জন করে পুরুষ ও নারী মোট আশি জন।

যালিমদের পানি ডুবি ও ঈমানদারদের মুক্তি:

লাগাতার বৃষ্টি ও প্লাবনের পানিতে তাঁর জাতির যারা ঈমান আনেনি সলিল-সমাধির মাধ্যমে তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। আল্লাহ বলেন, ‘যারা আমার বিধানাবলীকে অস্বীকার করেছিল আমি তাদের পানিতে নিমজ্জিত করেছিলাম। তারা ছিল একটি জ্ঞানান্ধ জাতি’ (সূরা আল-আ‘রাফ-৬৪)।

অপরদিকে নূহ (আঃ) ও তাঁর সঙ্গী মুমিনগণ ডুবে মরা থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। আল্লাহ বলেন, ‘অনন্তর আমি তাঁকে ও তাঁর সঙ্গে যারা জাহাজে ছিলেন সবাইকে মুক্তি দিয়েছিলাম’ (সূরা আল-আ‘রাফ-৬৪)। ‘আমি তাকে তক্তা ও কীলক নির্মিত জলযানে আরোহণ করিয়েছিলাম, যা আমার দৃষ্টিপথে চলছিল’ (সূরা আল-ক্বামার -১৩, ১৪)।

অবশেষে যমীন ও আসমান আল্লাহর হুকুম পালন করলো, প্লাবন সমাপ্ত হলো ‘জূদী’ পাহাড়ে গিয়ে নৌকা নোঙর করল আর বলে দেয়া হলো যে দুরাত্না কাফেররা চিরকালের জন্য আল্লাহর রহমত থেকে দূরীভুত হয়েছে। (সূরা হূদ-৪৪)। এ পাহাড়টি  আজও ঐ নামেই পরিচিত। সেটি ইরাকের মোসেল শহরের উত্তরে ইবন ওমর দ্বীপের অদূরে আর্মেনীয়া সীমান্তে অবস্থিত। আধুনিককালে এ পাহাড়ে নূহ (আ.) এর কিশতীর ধবংসাবশেষ পাওয়া গেছে। বর্তমান তাওরাতে দেখা  যায় যে, নূহ (আ.) এর কিশতী আরারাত পর্বতে ভিড়েছিল।                        

আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাগণের পক্ষে তাদের দুশমনদেরথেকে প্রতিশোধ নিয়ে থাকেন এবং প্রিয় বান্দাদের মুক্ত করেন। যেমন নূহের শত্রুদের থেকে আল্লাহ প্রতিশোধ নিয়েছিলেন এবং নূহ ও তাঁর ঈমানদার সাথীদের মুক্ত করেছিলেন। দুনিয়াবী জৌলুস সত্ত্বেও যালেমরা সর্বযুগেই নিন্দিত ও ধিকৃত হয়। পক্ষান্তরে নির্যাতিত হওয়া সত্ত্বেও ঈমানদারগণ সর্বযুগে নন্দিত ও প্রশংসিত হন।

লেখকঃ প্রফেসর, আল হাদীস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।