"রোযা কোন বোঝা নয় "

"রোযা কোন বোঝা নয় "

ফাইল ছবি

মানুষ আল্লাহ তা’য়ালার সৃষ্ট সেরা জীব। তার হাতেই সকলের জীবন-মরণ। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তিনিই সব কিছুর প্রধান নিয়ন্ত্রক। সব ক্ষমতা তাঁরই হাতে। মানব জাতির পথনির্দেশিকা হিসেবে তিনি অসংখ্য বিধি-বিধান তাঁর ঐশী গ্রন্থ আল কুরআনে বর্ণনা করেছেন। তাঁর দেয়া এসকল বিধি-বিধান মেনে চলার মাঝেই রয়েছে প্রকৃত শান্তি ও সফলতা।

কিন্তু যুগে যুগে কিছু মানুষ তাঁর দেয়া এসকল বিধানকে বোঝা বা কষ্ট মনে করে আসছে। প্রকৃতপক্ষে তাঁর কোন বিধানকে বোঝা বা কষ্ট ভাবার কোন সুযোগ নেই। যুগে যুগে যারা তার বিধানকে এরূপ ভেবে লঙ্ঘন করেছে তারাই বরণ করেছে করুণ পরিণতি। যেমন- কাবিল, ফেরাউন, নমরুদ, সাদ্দাদ, বনী ইসরায়েল, আদ জাতি, সামূদ জাতি, আবু জাহেল, উতবা, সায়াবা প্রমুখ।

যাই হোক, আমাদের মাঝে পবিত্র রমযান মাস সমাগত। এই রমযানের রোযাকে কোনোরূপ বোঝা মনে না করে তা থেকে উপকার গ্রহণের মাধ্যমে তাকে নিয়ামত হিসেবে গ্রহণ করাই হবে আমাদের মৌলিক কাজ। তাই নিজেদের মনের সকল পাপ মোচন করিয়ে নেওয়ার এখনই সময়।

আল্লাহ তায়ালা রোযার বিধান দিয়েছেন মানবতার কল্যাণে, মুক্তির লক্ষ্যে। কোন প্রকার কষ্ট দেওয়া তার উদ্দেশ্য নয়। আল্লাহ তায়ালা সূরা বাকারার রোযা সম্পর্কিত ১৮৫ নং আয়াতে ঘোষণা করেন “তোমাদের পক্ষে যা সম্ভব আল্লাহ তাই ইচ্ছা করেন, তোমাদের পক্ষে যা অসম্ভব তিনি তার ইচ্ছা করেন না, যাতে তোমরা (রোযার) নিদিষ্ট সংখ্যা পূরণ করে নিতে পার। আর তিনি তোমাদের যে সুপথ দেখিয়েছেন তার জন্য তোমরা আল্লাহর মহত্ব ঘোষণা কর এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর”।

পবিত্র কুরআনে  মহান আল্লাহ তা’য়ালা আরো বলেন, “ওহে, তোমরা যারা ইমান এনেছ, তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমনিভাবে ফরয করা হয়েছিলো তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পারে” (সূরা বাকারা : ১৮৩)। উল্লিখিত আয়াতের ‘যেমনিভাবে ফরয করা হয়েছিলো তোমাদের পূর্ববতীদের উপর’ এ অংশ দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, রোযা শুধু উম্মতে মুহাম্মদীর উপরই ফরয হয়নি বরং অন্যান্য নবীদের যুগেও ফরয ছিলো।

ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায়, প্রথম মানুষ ও প্রথম নবী হযরত আদম (আ.) এর যুগে থেকে হযরত ঈসা (আ.) এর যুগ পর্যন্ত রোযার প্রচলন ছিল। অবশ্য সেই রোযার ধরণ ও প্রকৃতি আমাদের মত ছিলোনা। সংখ্যাতেও ছিলো নানা ব্যবধান। উদাহরণস্বরূপ-

হযরত আদম (আ.)–এর রোযা :

প্রথম মানব ও নবী আদম (আ.) রোযা পালন করেছিলেন। এ ব্যাপারে ওলামায়ে উম্মত একমত পোষণ করেছেন। তবে তিনি কতদিন কিভাবে রোযা পালন করেছেন সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট দলিল প্রমাণ পাওয়া যায় নি। এ ব্যপারে যে বক্তব্যগুলো প্রচলিত আছে তার নির্ভরযোগ্যতাও প্রশ্নাতীত নয়। যেমন, মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘হে আদম তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর। তবে এই গাছটার কাছেও যেওনা।’ কেউ কউে বলতে চান তাদেরকে ঐ বৃক্ষের কাছ থেকে নিবৃত রাখাটাও এক ধরনের রোযা। কতিপয় ওলামায়ে কেরাম বলেন, হযরত আদম (আ.) এর উপর প্রতি চাঁদের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোযা আবশ্যক ছিল। আল্লামা আহামদ ইবনে মুহাম্মদ নিশাপুরী উল্লেখ করেছেন, জান্নাতের নিয়ামত চলে যাবার পর আদম ও হাওয়া সুদীর্ঘকাল ক্রন্দন করেছেন। তারা খাবার গ্রহণ করেননি, পান করেননি, এমনকি শারীরিকভাবেও বিচ্ছিন্ন ছিলেন। এটাও ছিল এক ধরনের রোযা পালন।

হযরত ইদ্রিস (আ.)–এর রোযা :

আল্লামা নিশাপুরী ‘আল আরাইশ’ এর ৩৭ ও ৩৮ পৃষ্ঠায় বলেছেন, ‘সাইয়্যেদিনা হযরত ইদ্রিস (আ.) সারা জীবন রোযা রেখেছেন।’

হযরত নূহ (আ.)–এর রোযা :

হযরত নূহ (আ.) এর ব্যাপারে কেউ কেউ বলেছেন, তিনি দুই ঈদের দিন ছাড়া সর্বদা রোযা রাখতেন। ইমাম তাবারী (র.) কাতাদাহ (র.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, মুহাররমের ১০ তারিখ নূহ (আ.) তার তরণী থেকে নামেন। অনুসরীদের লক্ষ করে তিনি বলেন, ‘আজ যে রোযা রেখেছো তা পূর্ণ কর, আর যে রাখনি সে রোযার নিয়ত করে নাও’ (তাবারী)। হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল ইবনে মাসউদ, ইবনে আব্বাস, মা আতা, কাতাদাহ ও দাহহাক প্রমূখ তাফসীরকারকদের থেকে আল্লামা ইবনে কাসির (র.) বর্ণনা করেন যে, ইসলামে প্রাথমিক পর্যায়ে রোযা ছিলো, যেমনিভাবে অন্যান্য জাতি পালন করতো। আর তা ছিলো প্রত্যেক মাসে তিন দিন। নূহ (আ.) এর যুগ থেকে এটি শুরু হয়। আর রমযানের ৩০ রোযা ফরয হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তা বহাল ছিল (ইবনে কাসির)।

হযরত ইব্রাহিম (আ.)–এর রোযা :

হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর রোযা সম্পর্কে আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেন, ইব্রাহিম (আ.) প্রতি মাসের তিনদিন রোযা রাখতেন (ইবনে মাযাহ)। তবে ইমাম তাবারী (র.) বলেন, রমযানের ত্রিশ রোযা ফরয ছিলো হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর উপর প্রদত্ত ফরয এর অনুযায়ী।

হযরত দাউদ (আ.)–এর রোযা :

উচ্চ মর্যাদাশীল নবী হযরত দাউদ (আ.)। যাদের উপর প্রধান চারখানা আসমানি কিতাব নাযিল হয়েছে তার একজন তিনি। তার উপর নাযিলকৃত আসমানি কিতাবের নাম হল ‘যাবুর’। হযরত দাউদ (আ.) একদিন রোযা রাখতেন আর একদিন বাদ দিতেন। তার রোযার ব্যাপারে মুসলিম শরিফে উল্লেখ রয়েছে, “তুমি রোযা রাখ, আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য সর্বোত্তম আমল রোযা। আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম রোযা হচ্ছে হযরত দাউদ (আ.) এর রোযা। তিনি একদিন রোযা রাখতেন আর একদিন ইফতার করতেন”। একবার সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আমর সারা জীবনে রোযা পালনের সিদ্ধান্ত নিলেন। ব্যাপারটা মহানবী (স.) শুনে আব্দুল্লাহকে ডাকলেন। ইব্রাহিম (আ.) এর প্রচলিত রোযা পালনকে আদর্শ হিসাবে নিয়ে এক মাসে তিনদিন রোযা পালন করতে পরামর্শ দিলেন। আব্দুল্লাহ তাতে সন্তষ্ট না হয়ে তিনি এর চেয়ে বেশি ইবাদতের শক্তি রাখেন বলে জানালেন। তখন মহানবি (স.) বললেন, তাহলে তুমি আল্লাহর নবী দাউদ (আ.) এর রোযা পালন কর। তার চেয়ে বেশি করতে যেওনা। আব্দুল্লাহ (রা.) দাউদ (আ.) এর পদ্ধতি জানতে চাইলে রাসূল (সা.) বললেন, তিনি একদিন রোযা পালন করতেন, একদিন ভাঙতেন। তিনি আরও বলেন, এটাই উৎকৃষ্ট রোযা পালন। আব্দুল্লাহ এর চেয়েও বেশী পারবেন বলে জানালেন। রাসূল (সাঃ) বললেন, এর চেয়ে ভাল রোযা পালন আর নেই (বুখারি)।

পূর্ববর্তীদের  রোযার পরিধি :

ওমর ( রা.) বলেন, ‘পূর্ববর্তী উম্মতের প্রতি এই নির্দেশ ছিল যে, এশার নামায আদায় করার পর যখন তারা শুয়ে যেত তখন তাদের  পানাহার, স্ত্রী সহবাস হারাম হয়ে যেত।’ রোযা মুমিন বান্দাদের জন্য আল্লাহ একটি নিয়ামত হিসেবে প্রেরণ করেন।

রোযা অন্যতম নিয়ামক :

রাসূল ( স.) বলেছেন : ‘হে যুবকবৃন্দ, তোমাদের মধ্যে যার বিয়ে করার সামর্থ রয়েছে সে যেন বিয়ে করে, আর যার সামর্থ নেই সে যেন রোযা রাখে।’ আসল কথা আল্লাহ তায়ালা তার বান্দার উপর এমন কোন বিধান চাপিয়ে দেন নি যা সে পারবে না।

আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন, “আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কখনো কোন কাজের ভার দেন না, সে তাই পায় যা সে উপার্জন করে এবং তাই তার ওপর বর্তায় যা সে করে। হে আমাদের পালনকর্তা, যদি আমরা ভুলে যাই কিংবা ভুল করি, তবে আমাদের অপরাধী করো না। হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের ওপর এমন দায়িত্ব অর্পণ করো না,  যেমন আমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর অর্পণ করেছ। হে আমাদের প্রভূ, আমাদের দ্বারা ওই বোঝা বহন করায়ও না, যা বহন করার শক্তি আমাদের নেই। আমাদের পাপ মোচন কর। আমাদেরকে ক্ষমা কর এবং আমাদের প্রতি দয়া কর। তুমিই আমাদের প্রভু। সুতরাং কাফের সম্প্রদায়ে বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য কর। (সুরা: বাকারা, আয়াত ২৮৫-২৮৬ )।

শামীম ওসমান

আল-কুরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ