ইতিকাফ কি এবং কেন করবেন?

ইতিকাফ কি এবং কেন করবেন?

ছবিঃ সংগ্রহীত

পবিত্র রমজান মাসে বিভিন্ন ইবাদত-বন্দেগীর মধ্যে ইতিকাফ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। রমজান মাসের শেষ ১০ দিন কিংবা গোটা রমজান মাসই মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার মানসিকতা নিয়ে পুরুষের জন্য মসজিদে এবং নারীর জন্য নিজ নিজ ঘরে বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করে ইবাদত করাই হলো ইতিকাফ।

এই ইবাদত কেবল পবিত্র রমজান মাসের সঙ্গেই বিশেষভাবে সম্পর্কিত। ইসলামি শরীয়তের দৃষ্টিতে পবিত্র রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ পালন করা সুন্নত।

ইতিকাফ : ইতিকাফ আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ অবস্থান করা, স্থির থাকা, কোনো স্থানে আটকে পড়া বা আবদ্ধ হয়ে থাকা। ইসলামি শরীয়তের পরিভাষায় রমজান মাসের শেষ দশক বা অন্য কোনো সময় জাগতিক কাজকর্ম ও পরিবার-পরিজন থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহকে খুশি করার নিয়তে পুরুষের জন্য মসজিদে এবং নারীদের জন্য ঘরে নামাজের নির্দিষ্ট একটি স্থানে ইবাদত করার উদ্দেশ্যে অবস্থান করা ও স্থির থাকাকে ইতিকাফ বলে। রমজান মাস ছাড়া অন্য যেকোনো সময়ই আমলটি করা যায়। তবে রমজান মাসের সঙ্গে এর বিশেষ একটি সম্পর্ক রয়েছে।

ইতিকাফের উদ্দেশ্য : আত্মশুদ্ধির চর্চা ও আত্মার পবিত্রতা অর্জন করাসহ ইতিকাফ পালন করার মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। এ ছাড়া রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করার আরো বিশেষ একটি উদ্দেশ্য রয়েছে, তা হলো শবে কদরের তালাশ করা। এ সময় ইতিকাফ করার মাধ্যমে নিশ্চিতভাবে মহিমান্বিত এ রাতে আমলের সুযোগ লাভ করা যায়।

ইতিকাফের গুরুত্ব : আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জন এবং আল্লাহ সন্তুষ্টি লাভ করার উত্তম পন্থা হলো ইতিকাফ। মানবিক সব চিন্তা-ভাবনার ঊর্ধে অবস্থান করে একজন মানুষ ইতিকাফে একান্তে আল্লাহর ধ্যানে বসার সুযোগ লাভ করেন। এ একান্ত যাপন প্রক্রিয়ার প্রভাব সীমাহীন। ইতিকাফ একজন মানুষের ওপর এমনভাবে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক প্রভাব বিস্তার করে, যা তাকে দীর্ঘদিন আল্লাহর পথে পরহেজগারির সঙ্গে পরিচালিত হতে সহযোগিতা করে।

আল কোরআনে ও হাদিসে ইতিকাফ : পবিত্র কোরআনের আয়াতে সূরা বাকারার ১৮৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, আর তোমরা মসজিদে ইতিকাফকালে স্ত্রীদের সঙ্গে মেলামেশা করো না। নবীজি (সা.) ইতিকাফকে খুব গুরুত্ব দিতেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, রাসূল (সা.) প্রতি রমজানের শেষ দশক (মসজিদে) ইতিকাফ করতেন। এ আমল তার ইন্তেকাল পর্যন্ত জারি ছিল (বুখারি ও মুসলিম)।

ইতিকাফ আদায় সহিহ হওয়ার জন্য চারটি শর্ত রয়েছে ১. পুরুষের মসজিদে এবং নারীদের জন্য ঘরে অবস্থান করা। ২. ইতিকাফের নিয়ত করা। ৩. বড় নাপাক থেকে পবিত্রতা অর্জন করা। ৪. রোজা রাখা। ইতিকাফের ফজিলত সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রোজার শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করবে, সে ব্যক্তি দু’টি হজ ও দু’টি ওমরার সমপরিমাণ সওয়াব পাবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)।

হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলে পাক (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইতিকাফ করবে, আল্লাহ তায়ালা তার এবং জাহান্নামের আগুনের মধ্যে তিনটি পরিখার দূরত্ব সৃষ্টি করবেন। প্রত্যেক পরিখার প্রশস্ততা দুই দিগন্তের চেয়েও বেশি (বায়হাকি)।

মসজিদুল হারামে আদায়কৃত ইতিকাফ ইসলামের দৃষ্টিতে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ইতিকাফ। তারপর মসজিদে নববীর ইতিকাফ এবং তারপর বায়তুল মুকাদ্দাস। তারপর উৎকৃষ্ট ইতিকাফ হলো কোনো জামে মসজিদে ইতিকাফ করা, যেখানে রীতিমতো জামাতে নামাজ হয়। এরপর মহল্লার মসজিদে।

একজন মুসলিম যেসব কারণে ইতিকাফ করতে পারেন ১. ইসলামের বিধান মান্য করার মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করার উদ্দেশ্যে। ২. পাশবিক প্রবণতা ও অহেতুক কাজ থেকে দূরে থাকার চর্চা। ৩. শবেকদর তালাশ করার উদ্দেশ্যে। ৪. মসজিদে অবস্থানের অভ্যাস গড়ে তোলা। ৫. দুনিয়ামুখী মানসিকতা ত্যাগ ও বিলাসিতা থেকে দূরে থাকা এবং ইতিকাফ করার ফজিলত অর্জনের উদ্দেশ্যে।

ইতিকাফের প্রকারভেদ : ইতিকাফ মূলত তিন প্রকার। এক. ওয়াজিব ইতিকাফ। দুই. সুন্নত ইতিকাফ। তিন. মুস্তাহাব ইতিকাফ। ইতিকাফ তিন ধরনের ১. ওয়াজিব, ২. মুস্তাহাব, ৩. সুন্নতে মুয়াক্কাদা আলাল কিফায়া। ইতিকাফ করার মানত করলে তা আদায় করা ওয়াজিব। রমজানের শেষ ১০ দিনে ইতিকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা আলাল কিফায়া। সুন্নতে মুয়াক্কাদা আলাল কিফায়া মানে হলো একটি মহল্লা বা এলাকার সবার পক্ষে অন্তত একজন আদায় করতে হবে। একজনও আদায় না করলে পুরো এলাকাবাসীর গুনাহ হবে। এ ছাড়া রমজানের শেষ ১০ দিন ছাড়া যত ইতিকাফ করা হবে, তা মুস্তাহাব বা নফল।

ইতিকাফের শর্তাবলি : একজন ইতিকাফকারীকে পাঁচটি গুণে গুণান্বিত হতে হবে। অর্থ্যাৎ পাঁচটি গুণ না থাকলে কোনো মানুষ ইতিকাফ করতে পারবে না। ১. মুসলমান হওয়া। ২. বালেগ বা প্রাপ্তবয়স্ক ও বিবেচনাবোধ সম্পন্ন হওয়া। ৩. পবিত্র হওয়া। ৪. ইতিকাফের নিয়ত করা। ৫. পূর্ণাঙ্গ সময় (একান্ত আবশ্যক কাজ ছাড়া) ইতিকাফের স্থানে অবস্থান করা।

ইতিকাফে কী করা যাবে, কী করা যাবে না : শুদ্ধভাবে ইতিকাফ করার জন্য এর বিধান জানা জরুরি। ইতিকাফের শর্ত, আদব ও ইতিকাফে কী করা যাবে আর কী করা যাবে না এসব বিষয় না জানা থাকলে সঠিকভাবে ইতিকাফ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। শুদ্ধভাবে ইতিকাফ আদায় হওয়ার জন্য বেশ কিছু শর্ত রয়েছে। অন্যতম শর্ত হলো নিয়ত করা। নিয়ত ছাড়া ইতিকাফ সহিহ হবে না। জামে মসজিদে ইতিকাফ করা। নারীরা নিজ গৃহে নামাজের স্থানে বা অন্য পবিত্র স্থানে ইতিকাফ করবে। এছাড়া ইতিকাফ শুদ্ধ হওয়ার শর্ত হলো মুসলমান হওয়া, জ্ঞানবান হওয়া, অপবিত্রতা এবং হায়িজ ও নিফাস থেকে পবিত্র হওয়া। বালিগ বা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া ইতিকাফের শর্ত নয়। তাই জ্ঞানবান নাবালিগরাও ইতিকাফ করতে পারবে। নারীর জন্য স্বামীর অনুমতি নিয়ে ইতিকাফ করা জায়েজ। নারীর জন্য মসজিদে ইতিকাফ করা নাজায়েজ। (বুখারি, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৭২)।

ইতিকাফে কী করা যাবে আর কী করা যাবে না : বিনা ওজরে দিনে বা রাতে সামান্য সময়ের জন্য মসজিদ থেকে বের হলেও ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যায়। অনুরূপভাবে নারীরা তার ঘরের নির্ধারিত স্থান থেকে বের হবে না। পেশাব-পায়খানা ও জুমা আদায় ইত্যাদি ওজরের কারণে মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েজ। ইতিকাফের স্থানে ঘুমাবে ও পানাহার করবে। কোনো কারণে যদি মসজিদ ভেঙে যায় অথবা জোরপূর্বক মসজিদ থেকে বের করে দেয়া হয় তাহলে ইতিকাফকারী ব্যক্তি মসজিদ থেকে বের হয়ে সঙ্গে সঙ্গে অন্য মসজিদে চলে যাবে, এতে ইতিকাফ নষ্ট হবে না। জান বা মালের ক্ষতির আশঙ্কা হলেও এই হুকুম প্রযোজ্য হবে। অসুস্থ ব্যক্তিকে সেবা করার জন্যও মসজিদ থেকে বের হবে না। কোনো মৃত ব্যক্তিকে দেখার উদ্দেশ্যে বা তার জানাজা আদায়ের উদ্দেশ্যে ইতিকাফ থেকে বের হলে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। অবশ্য মানতের ইতিকাফের সময় যদি রোগীর সেবা, জানাজার নামাজ ও ইলমের মজলিসে যাওয়ার শর্ত করে, তা হলে এসব তার জন্য জায়েজ হবে।

ইতিকাফকারী ব্যক্তি মুয়াজ্জিন হোক বা অন্য কেউ হোক, আজানের জন্য মিনারে আরোহণ করলে ইতিকাফ নষ্ট হবে না। মিনার মসজিদের বাইরে হলেও। এ ছাড়া ইতিকাফ নষ্ট হওয়ার একটি কারণ হলো সহবাস বা সহবাসের দিকে আকৃষ্টকারী কাজ, তা দিনেই হোক বা রাতেই হোক। স্বপ্নদোষে ইতিকাফ নষ্ট হয় না। কয়েকদিন পাগল বা বেহুশ থাকার ফলে লাগাতার ইতিকাফ করতে না পারলেও ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যায়। একেবারে চুপ থাকাকে ইবাদত মনে করে সারাক্ষণ চুপ থাকলে ইতিকাফ মাকরুহ হয়। অন্যথায় মুখের গুনাহ থেকে চুপ থাকা বড় ইবাদত। ইতিকাফের স্থানকে ব্যবসাস্থল বানানো মাকরুহ। ওয়াজিব ইতিকাফ যে কোনো কারণে নষ্ট হয়ে গেল তার কাজা করা ওয়াজিব।