মহামারি থেকে বিশ্বমারি

মহামারি থেকে বিশ্বমারি

ছবিঃ সংগ্রহীত

দিলীপ গুহঠাকুরতা

মরণব্যাধি কভিড-১৯ চীন দেশের উহান থেকে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে মহামারি রূপ নেয় যা আজ প্রায় ৪৪ লাখ মানুষকে আক্রান্ত করে ৩ লক্ষ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়ে বিশ্বের ১৮৮ টি দেশে বিশ্বমারি রূপে ছড়িয়ে পড়েছে।

মহামারি এই বারই প্রথম না পৃথিবীতে। ভয়ংকর সব এপিডেমিক অজস্র প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল পৃথিবীর নানা অঞ্চল থেকে। তবে এমন বিশ্বমারি আর কখনো হয়েছিল কি না, এই সুন্দর ধরিত্রীর জ্ঞাত ইতিহাসে তা কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। করোনাভাইরাস প্রকোপের এই লক ডাউনের অবসরে আসুন ঘুরে আসি কিছুক্ষণ সুদূর অতীত থেকে নিকট অতীতে ।

খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩০ অব্দঃ এপিডেমিক অব এথেন্স
আজ থেকে ঠিক আড়াই হাজার বছর আগের কথা। তখন স্পার্টানদের সাথে গ্রিকদের যুদ্ধ চলছিল। মিশর লিবিয়া ইথিওপিয়া থেকে গ্রিসে পৌঁছে মহামারি আকার ছড়িয়ে পড়েছিল যে রোগ, ধারণা করা হয় তা ছিল একপ্রকার টাইফয়েড জ্বর। ভীষণ পিপাসা, জিহ্বা ও গলা রক্তাক্ত হওয়া, চামড়ায় লালচে ক্ষতসহ প্রচণ্ড জ্বর ছিল রোগের সিম্পটম। ঐ অঞ্চলগুলোর প্রতি তিনজনের দুজন মানুষেরই মৃত্যু হয়েছিল। অনেক সাবধানতার পরেও এক এথেন্স শহরেই ৩৫ হাজারের মধ্যে মাত্র ১০ হাজার নাগরিক বেঁচেছিলেন।

৫৪০-৫৪১ খ্রিষ্টাব্দঃ জাস্টিনিয়ান প্লেগ
প্লেগ রোগের জীবাণু ইঁদুরের দেহে আশ্রয় নিয়ে প্রথমে মিসরবাসীকে আক্রমণ করে। সেখান থেকে ফিলিস্থিন হয়ে বাইজেন্টানাইন তথা রোম সাম্রাজ্যে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পরে। এরপর পুরো ভূমধ্যসাগরীয়ে অঞ্চলে সবাইকে তুর্কি নাচ নাচায়। সম্রাট জাস্টিনিয়ান ছিলেন তখন রোমান সাম্রাজ্যের অধিপতি। ৫৪০-৫৪১ খ্রিষ্টাব্দে ঐ অঞ্চলের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের জীবন ছিনিয়ে নেয়। এরপরেও আরও প্রায় ২০০ বছর এই প্লেগের অস্তিত্ব ছিল।

একাদশ শতাব্দীঃ কুষ্ঠ রোগ
লেপরোসি বা কুষ্ঠ ব্যাকটেরিয়া জনিত একটি প্রাণঘাতী রোগ, যার অস্তিত্ব ছিল অনেক আগে থেকেই। কিন্তু একদশ শতাব্দীতে ইউরোপে কুষ্ঠ রোগটি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। সমগ্র ইউরোপে তখন প্রায় ১৯ হাজার কুষ্ঠ হাসপাতাল নির্মাণ করেও অল্প সময়ের ব্যবধানে লক্ষ লক্ষ আক্রান্ত রোগী সামাল দিতে দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছিল। সঠিক চিকিৎসা ছিল না বলে তখন খ্রিষ্টান ধর্মভিরুরা বলতো - এই রোগ পাপাচারী মানুষের উপর আরোপিত অভিশাপ। ১৮৭৩ সালে নরওয়ের বিজ্ঞানী আরমান হ্যানসেন কর্তৃক এই রোগের জীবাণু আবিষ্কার মানুষকে কথিত অভিশাপ থেকে মুক্ত করলেও মৃত্যুকে ঠেকানো গেলো না। এরও ৮৭ বছর পরে ১৯৬০ সালে মার্কিন চিকিৎসা বিজ্ঞানী জন শেফার্ড এন্টিবায়োটিক আবিষ্কার করে এই মরণব্যাধিকে মানুষের নিরাময়ের আওতায় নিয়ে আসেন।

১৩৫০ সালঃ দ্যা ব্ল্যাক ডেথ
বিশ্বের জ্ঞাত ইতিহাসে আর একটি ভয়ঙ্কর মহামারি হলো এক ধরণের বুবোনিক প্লেগ । এই রোগ সম্ভবত এশিয়ায় উৎপত্তি হয়। তবে বণিকদের জাহাজে বসবাসরত ‘কালো ইঁদুর’ ও ‘ইঁদুর মাছি’ নামক দুইটি ইঁদুর প্রজাতির মাধ্যমে ভূমধ্যসাগর ও ইউরোপে রোগটি ছড়িয়ে পড়ে। এক ধরণের ব্যাকটেরিয়া এই প্লেগের জন্য দায়ী। ইয়োরোপের প্রায় আড়াই কোটি মানুষ এই মহামারিতে প্রাণ হারায়, যা তখনকার ইউরোপের জনসংখ্যার একতৃতীয়াংশ। প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল থেকে রাস্তাঘাটে লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায় । মহামারির দাপটে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের যুদ্ধ পর্যন্ত থেমে যায়। গ্রিনল্যান্ডের কুখ্যাত ভাইকিং জলদস্যুরা মরে মরে সয়লাব হয়ে সমুদ্রে তাদের নিয়ন্ত্রণ হারায়। মহামারিটি ‘দ্যা ব্ল্যাক ডেথ; নামে পৃথিবীর ক্যালেন্ডারে কৃষ্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।

ষোড়শ শতাব্দীঃ গুঁটি বসন্ত, হাম, প্লেগ
পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ইউরোপীয়দের নতুন মহাদেশ আমেরিকা আবিস্কারের মহোৎসব শুরু হয়েছিল। তখন তারা জাহাজে করে ইউরোপের হিংস্রতা, কৃষ্টি, সংস্কৃতির সাথে সাথে নিয়ে আসে ভয়ংকর বিউবনিক প্লেগ ও হামের মত জীবাণু। ১৫২০ সালে স্প্যানিশ বণিকদের সাথে আসা একজন আফ্রিকান দাস স্মলপক্স জীবাণু শরীরে নিয়ে আসলে মেক্সিকো, ক্যারিবিয়ান অঞ্চলসহ গোটা এজটেক সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে এই গুঁটিবসন্তের মহামারি। মৃত্যু হয় কোটি কোটি মানুষের। প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে প্লেগ ও হাম তখন ইউরোপিয়ানদের অনেকটা গা সওয়া হয়ে গেলেও ইনোসেন্ট ক্যারিবিয়ান তথা আমেরিকানদের শরীরে ঐ সব রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা সামান্যও ছিল না। ফলে এই তিনটি রোগে প্রায় ৫ কোটি ৬০ লক্ষ আদিবাসীদের মৃত্যু হয় যা ঐ অঞ্চলের জনসংখ্যার ৯০ ভাগ। গণহারে এই মৃত্যু গোটা আমেরিকা মহাদেশে ইউরোপিয়ানদের করায়ত্ব করার সুযোগ করে দেয়। উপনিবেশকারিদের তাই কষ্ট করে কোমর থেকে তরবারি বেশি বের করতে হয়নি।

১৬৬৫ সালঃ দ্য গ্রেট প্লেগ অব লন্ডন
চীন দেশ থেকে শুরু হয়ে হংকং হয়ে জাহাজে করে প্লেগ চলে আসে লন্ডন। এইভাবে মারাত্মক বুবোনিক প্লেগ ১৬৬৫ সালে লন্ডন শহরে ভয়াবহভাবে আক্রমণ করে। লন্ডন শহরের নাগরিক জীবন পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে যায়। সেই সময়ে কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, লকডাউন এই শব্দগুলো ব্যাপক চালু হয়। তখন লন্ডন শহরের অলিতে গলিতে আক্রান্ত মানুষদের বাড়িগুলো বিশেষ রঙ দিয়ে চিহ্নিত করে লকড-ডাউন করা হয় এবং পরিবারের কাউকেই বাইরে আসতে দেয়া হয়নি। মৃতদের লাশ সম্পুর্ণ সতর্কতায় গণ কবরে দাফন করা হয়। এইভাবে কঠিন ব্যবস্থাপনার জন্য মাত্র সাত মাস স্থায়ী হয়ে ছিল মারাত্মক রোগটি। তবে এরই মাঝে সাড়ে তিন লক্ষ নাগরিকের লন্ডন শহরের এক লাখের বেশি মানুষ মারা যায়।
তখন একটা উড়ো খবর কোন এক গেজেটে প্রকাশিত হয়েছিল এমন যে, কুকুর বিড়ালের মাধ্যমে লন্ডনে প্লেগ ছড়িয়েছে। শুরু হয়ে যায় নির্বিচারে শহরের সব কুকুর বিড়াল মেরে ফেলা (আহারে!)। পরে আবিষ্কৃত হয়, ইয়েরসিনিয়া পেস্টিস ব্যাকটেরিয়াম নামক জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত ইঁদুরের মাধ্যমে সংক্রামিত প্লেগটি মহামারি রূপ নিয়েছে। প্লেগতো শেষ হলো। কিন্তু এর পর বছর না ঘুরতেই লন্ডন শহরে সহস্রাব্দের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে যা ‘গ্রেট ফায়ার অব লন্ডন’ নামে অভিহিত। তখন অনেকে বিশ্বাস করতো, ঐ সব নিরিহ নিরপরাধ বিড়াল কুকুরের অভিশাপে লন্ডন শহরে আগুন লাগে। সেই কষ্টবোধের কারণে কি না জানিনা, লন্ডন তথা পুরো বৃটেনবাসী এখনো কুকুর বিড়ালকে মানব শিশুদের মত আদর করে।

১৮১৭ সালঃ প্রথম কলেরা মহামারি
যদিও শুরুটা হয়েছিল রাশিয়ায়, কিন্তু পরে ব্রিটিশ সৈন্যদের মধ্যে রোগটি দেখা দেয়, যাদের মাধ্যমে ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। তখন কলেরায় ভারতবর্ষে ১০ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়। শুধু ভারত নয় - স্পেন, ইতালি, জার্মানি, চীন, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, আফ্রিকা ও আমেরিকায় কলেরা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় ২২-২৩ লাখ মানুষ কলেরায় মারা যায়।

১৮৫৫ সালঃ তৃতীয় প্লেগ মহামারি
চীন থেকে সূত্রপাত হওয়া প্লেগ হংকং ও ভারতে দ্রুত প্রাণঘাতী রূপ নেয়। এই মহামারিতে কোটি কোটি মানুষ আক্রান্ত হয় । মারাও যায় প্রায় দেড় কোটি মানুষ।

১৮৮৯ সালঃ রাশিয়ান ফ্লু
সাইবেরিয়া ও কাজাখস্তানে সূত্রপাত হওয়া মারাত্মক একটি ফ্লু রোগ প্রথমে মস্কো শহরে এসে ঘাঁটি গাড়ে এবং রাশিয়ান ফ্লু নামে পরিচিতি পায়। এর পরে ফিনল্যান্ড, পোল্যান্ডসহ ইউরোপের অনেক অঞ্চলে মহামারির রূপ নেয়। এক পর্যায়ে রাশিয়ান ফ্লু সমুদ্র পেরিয়ে উত্তর আমেরিকা ও আফ্রিকা অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৯০ সালের শেষে এসে এই রোগে প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার লোক মারা যায়।

১৯১৮ সালঃ স্প্যানিশ ফ্লু
চীন থেকে উৎপত্তি হওয়া রোগটি জাহাজে ও সিল্করোড ধরে স্থল পথে ইউরোপে এসে স্পেনের রাজপরিবারসহ ৮০ লাখ লোককে আক্রান্ত করে। একই সাথে ইউরোপসহ আমেরিকা, কানাডাতে ছড়িয়ে পরে। পেনিসিলিন ও সালফার ড্রাগস আবিষ্কৃত না হওয়ায় পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মানুষ তথা দুটি মহাদেশের ৫০ কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়। মৃত্যু হয় প্রায় ৫ কোটি মানুষের। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধেও এতো মানুষ মরেনি। ১৯১৯ সালের গ্রীস্মকালে স্পেনিশ ফ্লুর প্রকোপ কমে যায়।

১৯৫৭ সালঃ এশিয়ান ফ্লু
একটি মারাত্মক ফ্লু রোগ ১৯৫৭ সালে হংকং থেকে উৎপত্তি হয়ে সমগ্র চীনে ছড়িয়ে পরে। পরিচিতি পায় এশিয়ান ফ্লু হিসেবে। এই রোগ মহাদেশ অতিক্রম করে যুক্ত রাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রকেও আক্রান্ত করে। সেই বছর ১৪ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। কিন্তু ১৯৫৮ সালে দ্বিতীয়বার এসে রোগটি মহামারির আকার ধারণ করে । তখন প্রায় ১১ লাখ বিশ্ববাসীর মৃত্যু হয়। এরপর ভ্যাকসিন আবিষ্কার হওয়ায় রোগটি প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়।

১৯৮১ সালঃ এইচআইভি এইডস
শিম্পাঞ্জি বা একশ্রেণীর বানর থেকে সংক্রামিত এইডস রোগ ১৯৮১ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় প্রথম মানব দেহে শনাক্ত হয়। এইচআইভি ভাইরাস মানব দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্থাৎ ইমিউন সিস্টেমকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। ১৯৮১ সাল থেকে আজতক সাড়ে তিনকোটি প্রাণ কেড়ে নেয়া এইডস রোগের এখন পর্যন্ত কোন টিকা বা প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয় নি।

পাদটীকাঃ মানব ইতিহাসের এক ডজন মহামারি নিয়ে বক্ষ্যমাণ এই নিবন্ধটি তৈরি করা হয়েছে। তথ্যপুঞ্জি বিভিন্ন ওয়েবসাইট, গুগল সার্চ ইঞ্জিন এবং সমকালীন একাধিক দৈনিক পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। উক্ত বারোটির বাইরেও কালাজ্বর, সার্স, মার্স, ইবোলা, ম্যাডকাউ, এনথ্রাক্সসহ অনেক রোগ বিভিন্ন সময়ে মানব দেহকে আক্রান্ত করেছে। কিন্তু মৃত্যুর সংখ্যা বিচারে এবং এই নিবন্ধটির কলেবর বৃদ্ধি রোধে সেই রোগগুলোকে আমলে নেয়া হয়নি।
( সংগৃহীত)