করোনাকালে স্ট্যান্ডবাজি

করোনাকালে স্ট্যান্ডবাজি

ছবিঃ সংগৃহীত

১. কর্পোরেট আশাজাগানিয়া পিপিই
বাংলাদেশে করোনা যাত্রার প্রথমদিকে একটি বাণিজ্যিক সংস্থা ঘোষনা দিল তারা প্রায় চার লক্ষ পিপিই দেবে স্বাস্থ্যকর্মীদের। অনেক অনেক হৈচৈ হলো, মিডিয়া সয়লাব, ফেইসবুকে পক্ষে বিপক্ষে অনেকে দাড়িয়ে গেল। কিন্তু চার লক্ষ পিপিই অল্পসময়ে তৈরী করা সম্ভব কিভাবে সেটা কেউ ভেবে দেখলো না। একটা বিশেষধরণের ফেব্রিক প্রয়োজন এই পিপিই তৈরীর জন্য, সেটা বাংলাদেশে আছে কিনা, বাইরে থেকে কতদিনে আমদানি করা যাবে সেটা নিয়ে আলাপ হলো না। কিছুদিন মিডিয়া ব্রেকিং নিউজ করে চুপচাপ, সেই পিপিই পাওয়া গেল কিনা,পাবলিক সেটা জানতে চায়।

২. স্বপ্নে পাওয়া করোনার মহৌষধ
একজন মাওলানা কিছুদিন সোশ্যাল মিডিয়া জাগিয়ে রাখলেন করোনা এটমিক নাম্বার নিয়ে। ধর্মনিরপেক্ষ মিডিয়া তাকে নিয়ে উচ্চবাচ্চ না করলেও, ধার্মিক সোশ্যাল মিডিয়া তার গর্জনে প্রকম্পিত। নিরীহ ধর্মপ্রাণ তাকে বিশ্বাসও করলো, কিছুদিন তার আয় রোজগার ভালই হলো, তারপর চুপচাপ।

৩. পশুর থেরাপি মানুষে প্রয়োগ বুদ্ধি
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক ইথানল বাস্প পান করার ফাতোয়া দিলেন। মিডিয়াতে হৈচৈ। বাংলাদেশে করোনার এক অকল্পনীয় আবিস্কার হয়ে গিয়েছে, বাংলাদেশে এসে করোনা কুপোকাত। প্রত্যেক টেলিভিশন চ্যানেল এক্সক্লুসিভ সাক্ষাতকার, ব্যখ্যাবিশ্লেষণ। তারপর কিছু বোধসম্পন্ন চিকিৎসক এটার বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা দিলেন। তারপর এটা চুপচাপ।

৪. ফুসফুস ধৌত করার পরামর্শ
এক রাজনীতিক ফুসফুস বের করে ধৌত করার মহান আবিস্কারের কথা বললেন। হৈচৈ হলো। অন্যদেশের প্রেসিডেন্ট হারপিক বা স্যাভলন খাওয়ার পরামর্শ দিলেন। বিক্রিবাট্টা বেড়ে গেলো। পরে কোম্পানিগুলোকে বিবৃতি দিয়ে বন্ধ করা হলো।

৫. মেধাস্বত্ব হাইজাক
জাপানীজ ড্রাগ বায়োগান করোনা চিকিৎসায় উপোযোগী। দেশের দুটো কোম্পানীকে দায়িত্ব এবং মেধাস্বত্ব দেওয়া হলো এই ঔষধ তৈরীর। বলা হলো এই ঔষধ বিনামূল্যে দেওয়া হবে এক রবিবার থেকে। অনেক রবিবার গেল তেত্রিশ বছর কাটলো না নাদের আলী। ঔষধ কি উৎপাদন হলো??, ব্যবহার হলো বিনে পয়সায়?? কার্যকারিতা কতটুকু?? কোন খবর নেই।। মাঝখান থেকে বেনিয়া দুই কোম্পানি বিনে পয়সায় মেধাস্বত্ব পেয়ে গেলো, যার সুবিধা পাওয়ার কথা গরীব দেশের সরকারের, জনসাধারণের।

৬. অপ্রমানিত হট্টগোল
রেমডিসিভির অ্যামেরিকায় অনুমোদন পাওয়ার পর এইটা নিয়ে চরম হট্টগোল। সব মিডিয়াতে আলোচনা, করোনার প্রতিষেধক পাওয়া গিয়েছে। পাঁচ কোম্পানি মেধাস্বত্ব পেলো এই দামী ঔষধের উৎপাদনে। এর পুরোপুরি কার্যকারিতা এখনো প্রমানিত নয়। কিন্তু আমরা আমাদের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপরে এই দামী ঔষধের আর্থিক চাপ প্রায় চাপিয়ে দিতে যাচ্ছি। দশ হাজার টাকার ইনজেকশন দিলে মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসবে জানলে ঘটিবাটি বিক্রি করে চিকিৎসা করবে নিরিহ এবং স্বল্পজানা মানুষ, কিন্তু আসলেই মৃত্যু রুখতে পারবে এই ঔষধ। এমন কোন প্রমান নেই। কেন নেই তার বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা নিয়ে কেউ আলাপ আলোচনা করলো না।

৭. উকুনের ঔষধে করোনা কাত
গত দুই দিন কি নিয়ে আলাপ হচ্ছে। ইভারমেকটিন ২টা আর ডক্সিসাইক্লিন দশদিনে দশটা কম অসুস্থ রোগীর উপরে ভাল কাজ করে। ভাইরাস আক্রান্ত কম অসুস্থ রোগীর আসলে কোন চিকিৎসারই দরকার নেই। উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা করলেই পাঁচদিনে রোগ সেরে যায়। না করলে সাতদিন হয়তো। কিন্তু বাংলাদেশ বিশাল আবিস্কার করে ফেলেছে। সব চ্যানেল এবং এই নিয়ে কথাবার্তা। আমার চোখে শুধু ডাঃ কাওসারের এই ঔষধ কি, কিভাবে কাজ করে, করোনাতে কতটুকু কাজ করবে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কি, সম্ভাবনা কতটুকু তার বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা ছাড়া খালি প্রশংসা অথবা ট্রোলিং। এটা কিন্তু বাংলাদেশে প্রথমে ব্যবহার হয়নি, অষ্ট্রেলিয়াও হয়েছে। কিন্তু বলা হচ্ছে আমরাই..
তবে ঘাবড়ানোর কোন কারণ নেই। এটা কয়েকদিনের মধ্যে আড়ালে চলে যাবে। অন্যকিছু উদ্ভট কিছু আসবে।

৮.দশ হাজারের নতুন ফর্মুলা
জিন এক্সপার্ট টেষ্ট দিয়ে কোভিড ডায়াগনোসিস করার একটা আকাঙ্খা কিছুদিন টেলিভিশন চ্যানেলে সয়লাব ছিল। খালি ক্যাসেট আনতে পারলেই দিনে ১০হাজার টেষ্ট অনায়াসে করা যাবে। ক্যাসেট জাহাজে উঠেছে কিনা জানা যায় নি।

৯. মে'তে বাংলাদেশে করোনা শেষ
সিঙ্গাপুরের এক ইউনিভার্সিটি দাবি করলো মে'র মাঝামাঝি নাগাদ বাংলাদেশে কোভিড কমতে থাকবে। মে' র মাঝামাঝি আছি, কি অবস্থা ভাই।

ক্যান এমন হয়
১. কোভিড ১৯ একটি নতুন রোগ। এর সম্পর্কে মানুষ তেমন কিছুই জানে না। তখন আমাদের মতো জ্ঞানী মানুষরা তার সুযোগ নিয়ে নিজেদের জ্ঞান যাহির করার জায়গা পায়।
২. কর্পোরেট দুনিয়ায় মাথা নীচু করে কেউ কাজ করে না। সবাই বিখ্যাত হতে চায়। সেটা গুজব,অপব্যখ্যা দিয়ে হউক আর যে করেই হউক।
৩. পুজিবাদী দুনিয়ায় মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করে কর্পোরেট অফিসগুলো। আপদকালীন সময় হচ্ছে মুনাফা লুটার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। মুনাফা আসে স্ট্যান্ডবাজি থেকে, ব্রেকিং নিউজ থেকে। অতএব মুনাফামুখি হৈচৈ তো করতে হবেই।
৪. আমরা আপদকালীন সময় অনেক ছোট ছোট ভুল করি। যার কারণে আমরা হাজার টাকার টেষ্ট, ট্রেসিং, অক্সিজেনএবং আইসোলেশনে দিকে না ছুটে, লাখ টাকার ভ্যান্টিলেটর বা আইসিইউ'র দিকে ছুটি। গরীবের খাওয়ার কথা না চিন্তা করে, "আবার জমবে মেলা হাটখোলা" বিজ্ঞাপনে অর্থ নষ্ট করি। এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক নেতৃত্ব এই ভুলগুলো অনেক সময় স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু ভুলেরতো ফলাফল আছে। সে ভুলকে একটি বড় সাফল্য দিয়ে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা হয়। তার জন্যই ছুটে সেনসেশনের দিকে। একটা বড় আবিস্কার সকল ব্যর্থতা জনগনের মন থেকে মুঝে দেবে, রাজনৈতিক ফায়দা আসবে। আশা ছিল মনে মনে, বাস করিব তোমার মনে।।
-সংগৃহীত