নারী নিরাপত্তা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, সচেতনতা জরুরি!

নারী নিরাপত্তা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, সচেতনতা জরুরি!

ছবিঃ আবু জাফর

কবির ভাষায়, পৃথিবীতে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’! সত্যিই মা, মেয়ে, বোন, স্ত্রী সব গুলো অভিধা, ভালোবাসা,মায়া মিশে যায় নারী শব্দটার মাঝে! সে নারীই নাকি হয় হেনস্তার শিকার, উত্যক্তের শিকার! প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় কেউ হয়তো নারী অধিকার নিয়ে অতিরঞ্জন করছে আবার কেউ হয়তো না বুঝেই নারী অধিকারের প্রতিবাদ করছে! তাই দিন শেষে হচ্ছে না সমাধান! আড়ালে আবডালে বাড়ছেই নারী উত্যক্তের সংখ্যা! এলাকার বখাটে গুলোও নতুন আঙ্গিকে সাজাচ্ছে তাদের বখাটেপনা! নারী উত্যক্ত বলতে সমাজ যা বুঝে, বিষয়টা এর থেকেও ভয়াবহ! বখাটে ছেলেদের পথে দাঁড়িয়ে দু'টো শব্দ উড়িয়ে দেওয়া বা শিস দেওয়া ছাড়াও এটা হতে পারে৷ ধরুন আপনার অফিসে একজন নারী সহকর্মীকে হেয় করে কিছু বলা ইভ টিজিং। পুরুষ শিক্ষক নারী শিক্ষার্থীকে তুচ্ছজ্ঞান করা বা কোনো দায়িত্ব থেকে নেহায়েত নারী হওয়ার কারনে সরিয়ে রাখাটাও ইভ টিজিং৷ বাসে মহিলা সিট খালি নেই বলে একজন নারীকে কন্ডাক্টর বাসেই উঠতে দিলেন না সেটাও ইভ টিজিং৷ মোদ্দা কথা হল নারীকে নারী হওয়ার কারনেই হেয় করাটাই হবে ইভটিজিং! বাংলাদেশে এ নিয়ে আছে শক্ত আইন, শিশু ও নারী নির্যাতন দমন আইন ২০০০ মতে, নারী উত্ত্যক্তকরণের সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। পেনাল কোড ৫০৯-এ শুধু বলা আছে যে, কোনো নারীর শালীনতা ক্ষুণ্ণ করার উদ্দেশ্য, কোনো শব্দ উচ্চারণ, আওয়াজ বা অঙ্গভঙ্গি তৈরি বা কোনো কিছু প্রদর্শন করে, এটা জেনে যে উক্ত নারী সেই শব্দ, আওয়াজ শুনবেন বা উক্ত নারী সেই অঙ্গভঙ্গি দেখবেন বা তা উক্ত নারীর গোপনীয়তায় আঘাত হানবে, সেক্ষেত্রে তিনি সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷ দণ্ডবিধির ২৯৪ ধারায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি অন্যদের বিরক্তি সৃষ্টি করে কোনো প্রকাশ্য স্থানের কাছাকাছি কোনো অশ্লীল কাজ করে অথবা প্রকাশ্য স্থানে কোনো অশ্লীল গান বা উচ্চারণ করলে সেই ব্যক্তি তিন মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবে। তাছাড়া মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি হেল্পলাইন রয়েছে, যার নম্বর ১০৯। এই নম্বরে ফোন করে ইভটিজিং সংক্রান্ত অভিযোগ করা যায়। এই কেন্দ্র ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও ৫০ ভাগ নারীও তাদের এসব অধিকার সম্পর্কে অবহিত নয়। যারা অবহিত তারাও নানাভাবে ভোগান্তির শিকার হয়ে বিচারের আশা ত্যাগ করেন। একথা চরম সত্য যে, মোটেই উত্যক্ত হননি এমন নারী পাওয়া খুবই বিরল৷ আপনি হয়ত কোন দিনই ইভটিজিং করেননি তবে কোনোদিন ইভ টিজিংয়ের শিকার হননি এমনি নারী পাওয়া দুঃস্কর! হয়তো বহু মেয়ে এগুলো বাড়িতে উত্থাপন করে তবে বাড়ি থেকে বলা হয়, নিশ্চয়ই তুই কিছু করেছিস? সবসময় কি তোর সাথেই এমন হয়? এভাবে ঘটনা সেখানেই রফাদফা দেওয়া হয়৷ পরিনতিটাও পরিস্কার, দুই দিন পরই আত্মব্যথা গুলো আত্মহত্যায় রূপ নেয়! আজকাল উত্ত্যক্তকারীদের জন্য কোনো নারীই রাস্তাঘাটে নিরাপদ তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে না। অফিসপাড়ায় বসের কাছে সুন্দরী সহকর্মী, শিক্ষকের কাছে ছাত্রী সবাই কোনো না কোনোভাবে উত্ত্যক্তের শিকার হচ্ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের একটি তথ্যমতে, দেশে ১০ থেকে ১৮ বছর বয়সের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ মেয়ে যৌন হয়রানির শিকার হয়। এর মধ্যে ৩৬ শতাংশ মেয়েকে উত্ত্যক্ত করা হয় তাদের স্কুলের সামনেই। আর দেশের প্রায় প্রতিটি মেয়েই কোনো না কোনোভাবে জীবনের কোনো এক সময় যৌন হয়রানির শিকার হয়ে থাকে! পাড়ার বখাটে গুলো হয়তো নাটক-সিনেমার ডায়লগগুলোই খারাপ উদ্দেশ্যেই পুনরাবৃত্তি করে তাদের সামনে! আর তাতে টিজিংয়ের শিকার মেয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয়, আতঙ্কিত বোধ করে! পরিবার নিরাপত্তার খাতিরে মেয়েটির লেখাপড়া বা বাইরে বের হওয়ায় বাধা দেয়, হয়তো তাঁকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়! তাতেও দেখাযায় এক নারী উত্যক্তের শিকার হলে অন্যসব নারী নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। আর তাতেই বেড়ে চলে উত্যক্তের পরিমান। উত্যক্তকারীরা একবারও ভাবে না, তাদের এই অপকর্ম মেয়েটির কী ভয়াবহ মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করে। মেয়েটি একদা মা -নানী, দাদী হয়ে যায় তবুও ভুলেনা সেদিনে সে টিজিংয়ের কথা। পাঠ্যপুস্তক, গণমাধ্যম, ও ঘরে বাবা-মায়েদের মাধ্যমে সন্তানদের বুঝাতে হবে নারীদের উত্যক্ত করা মহা অন্যায়। তাতে হয়তো নতুন আগামী পাবে নারীউত্যক্তমুক্ত এক ধরনী। কবি বলেন, সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান। সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো বা ম্রিয়মাণ। মুক্ত কর ভয়, আপনা- মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।

আবু জাফর

 শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ,

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়