সড়ক-মহাসড়কে বেপরোয়া চাঁদাবাজি

সড়ক-মহাসড়কে বেপরোয়া চাঁদাবাজি

ছবিঃ সংগ্রহীত

পরিবহন চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে এবার পুলিশ কঠোর৷ মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো চাঁদাবাজি বন্ধে চিঠি দিয়েছে৷ তারপরও সড়ক-মহাসড়কে বাস-ট্রাকে থামছে না চাঁদাবাজি৷ এই করোনার মধ্যেও কৌশল পাল্টে বেপরোয়া চাঁদাবাজেরা৷

৫৯ দিন বন্ধ থাকার পর চলতি মাসের শুরুতে সারাদেশে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাস-মিনিবাস- ট্রাক চালুর সময় চাঁদাবাজি বন্ধের দাবি ওঠে৷ বলা হয়, চাঁদাবজি বন্ধ হলে যাত্রী ভাড়া বাড়ানোর প্রয়োজন পড়বে না৷ কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি৷ গণপরিবহন চালুর প্রথম দিন থেকেই চাঁদাবাজেরা তৎপর ৷ চাঁদাবাজি বন্ধে পুলিশের আইজির কঠোর হুশিয়ারির পরও তারা থামছেনা৷ কিছু কৌশল পরিবর্তন করেছে মাত্র৷

যে কৌশলে এখন চাঁদা আদায় হয় :
পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শ্রমিক এবং মালিক সংগঠনের নামে এখন সরাসরি বাস টার্মিনাল থেকে চাঁদা আদায় বন্ধ আছে৷ তবে এখন চাঁদা আদায় হচ্ছে বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানির নামে, বাস টার্মিনালের বাইরে৷ যেমন ‘যাত্রী সেবা’ একটি পরিবহন কোম্পানি৷ তাদের অধীনে বিভিন্ন মালিকের পাঁচ শ' বাস চলে ঢাকা থেকে দেশের বিভন্ন রুটে৷ এরমধ্যে ঢাকা-চাটখিল রুটে লাকসাম, মনোহরগঞ্জ, বিপুরা চর, নাসের পেটুয়া স্পটে প্রতিবাস থেকে ৪২০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয় প্রতিদিন৷ এই চারটি স্পটের যেকোনো সুবিধাজনক স্পট থেকে চাঁদা নেয়া হয়৷

এরকম আরেকটি পরিবহন কোম্পনি হলো ‘তিষা’৷ তাদের অধীনে বাসগুলো ঢাকা-কুমিল্লা- লাকসাম রুটে চলাচল করে৷ কোম্পানির নামে লাকসামে প্রতি গাড়ি থেকে ৫২০ টাকা চাঁদা তোলা হয়৷ তবে তারা পরিস্থিতি বুঝে চাঁদা তোলার জায়গা পরিবর্তন করে৷ দেশের অন্যান্য রুটেও একই কৌশলে চাঁদা আদায় হচ্ছে৷

ঢাকা শহরের মধ্যে বাসগুলোও বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানির ব্যানারে চলাচল করে৷ কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে সালসাবিল, বৈশাখী, তুরাগ, অনাবিল প্রভৃতি৷ এই কোম্পানিগুলো এখন প্রতিটি বাস থেকে দিনে ৮২০ টাকা করে এখন চাঁদা নেয়৷ জানা গেছে, চাঁদাবাজির এই নতুন কৌশলকে বলা হচ্ছে ‘সম্মিলিত চাঁদা’৷ এখান থেকে মালিক ও শ্রমিক নেতারা ভাগ নিচ্ছেন৷

ঢাকা শহরের ভিতরে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী হিউম্যান হলার থেকেও নতুন কৌশলে চাঁদা নেয়া হচেছ ৫০০-৮০০ টাকা৷ এই চাঁদা অবশ্য শ্রমিক ইউনিয়নের নামে নেয়া হচ্ছে৷ তারাও স্ট্যান্ড থেকে না নিয়ে নির্ধারিত নতুন জায়গা থেকে নিচ্ছে৷ আর এই চাঁদা না দিয়ে উপায় নেই৷ কারণ ‘দিন সব সময় একই রকম থাকবে না' বলে আশঙ্কা৷

পরিবহন নেতারা চাঁদাবাজদের নাম জানেন
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি মো. হানিফ খোকন বলেন, ‘‘পুলিশ তো সব কিছু ধরতে পারে না৷ চাঁদাবাজির কৌশলে যে পরিবর্তন এসেছে তারা সেটা হয়তো এখনো বুঝে উঠতে পারেনি৷ আর ২৪ ঘণ্টাতো পুলিশের পক্ষে পাহারা দেয়া সম্ভব নয়৷ চাঁদাবাজির ব্যানার পরিবর্তন হয়েছে৷ জায়গা বদল হয়েছে৷ মালিক সমিতির লোকজন তো এইসব চাঁদাবাজদের চেনেন৷ তারা তালিকা দিলেই কিন্তু চাঁদাবাজদের ধরা যায়৷’’

মালিক সমিতি দাবি করছে, পরিবহনে চাঁদাবাজি ৯০ ভাগ কমে এসেছে৷ তারা সারাদেশে চাঁদাবাজি বন্ধে চিঠি দিয়েছেন, পুলিশকে তথ্য দিচ্ছেন৷ নিয়মিত নজরদারি করছেন৷ তবে তারপরও চাঁদাবাজি যে হচেছ তা স্বীকার করেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ ৷ তিনি ব্যানার পরিবর্তন করে পরিবহন কোম্পানির নামে চাঁদাবাজির অভিযোগের কথাও স্বীকার করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা অভিযোগ পাওয়ার সাথে সাথে পুলিশকে জানাই৷ তবে চাঁদাবাজির সঙ্গে তো শুধু পরিবহনের লোকই জড়িত না, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও প্রভাবশালীরাও জড়িত৷ তাদের তো আমার চিনি না৷ তাদের তালিকা দেব কীভাবে?’’

চাঁদাবাজির শিকার সবচেয়ে বেশি হয় পণ্যবাহী ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান৷ পুলিশের বিরুদ্ধেও ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানে চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে৷ বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির আহ্বায়ক রুস্তম আলী বলেন, ‘‘আমরা চাই পুলিশসহ সবার চাঁদাবাজি বন্ধ হোক৷ পুলিশের আইজির নির্দেশের পর চাঁদবাজি কমেছে৷ তবে আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি৷’’

চাঁদাবাজদের নেটওয়ার্ক চিহ্নিত হচ্ছে?
পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, ১ জুন থেকে এ পর্যন্ত পুলিশ সারাদেশের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ১০৯ জন পরিবহন চাঁদাবাজকে আটক করেছে৷ মামলা করেছে ৫১ টি৷ পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য মতে, সারাদেশে চাঁদাবাজদের নেটয়ার্ক চিহ্নিত করে অভিযান চালানো হচ্ছে৷ আর এই অভিযান অব্যাহত থাকবে৷

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা বলেন, ‘‘বাংলাদেশ পুলিশ সড়ক মহাসড়কে চাঁদাবাজি বন্ধে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করছে৷ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যারা আছেন তাদের কাছ থেকে ধারাবাহিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করছে৷’’

২০১৯ সালে পুলিশের এক প্রতিবেদনে বলা হয় শুধুমাত্র মহাসড়কে ২০১৮ সালে ৮৭ কোটি টাকার চাঁদা আদায় করা হয়৷ ২১৫টি সংস্থা ও সংগঠন মহাসড়কে চলাচলকারী যানবাহন থেকে দিনে গড়ে ২৪ লাখ টাকা চাঁদা তোলে৷ তবে এই হিসাব আসলে আদায় রসিদ দিয়ে যে চাঁদা আদায় করা হয় তার৷ ‘বোবা চাঁদার’ হিসেব এরমধ্যে নাই৷ আর এই হিসাবের মধ্যে জেলা থেকে উপজেলা এবং ঢাকা মহানগরীসহ বিভিন্ন মহানগর ও শহরের মধ্যে চলাচলকারী বাস মিনিবাস ও অন্যান্য যানবাহন থেকে আদায় করা চাঁদার হিসেবও ধরা হয়নি৷
সূত্র : ডয়চে ভেলে