একজন বড় ভাই, অভিভাবক,শিক্ষক ও শুভাকাঙ্ক্ষীকে হারালাম

একজন বড় ভাই, অভিভাবক,শিক্ষক ও শুভাকাঙ্ক্ষীকে হারালাম

ছবিঃমো.আবু ইউসুফ আলী খান

মো. আবু ইউসুফ আলী খান, একজন মানুষ গড়ার কারিগড়, করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২রা জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। তিনি কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলার 'মহিচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়' এ ২০০৬-বর্তমান পর্যন্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। যোগদানের পর থেকেই 'মহিচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়' চমৎকার ফলাফল করা সহ অসংখ্য শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়ে ভালো স্কুলে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে তার দক্ষ পাঠদান এবং সহশিক্ষকদের সঠিকভাবে গাইড করার কারণে। তিনি বেশ কয়েকবার মনোনিত হয়েছেন উপজেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে। অদম্য পরিশ্রমের মাধ্যমে তার কর্মরত বিদ্যালয়টিকে চান্দিনা উপজেলার অন্যতম সেরা প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন।

তার অসংখ্য শিক্ষার্থী বর্তমানে ঢাবি, জাবি, মেডিকেল, বুয়েট, কুবিসহ দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। এমন একজন পরিশ্রমী, মেধাবী, দক্ষ ও সৎ মানুষ গড়ার কারিগড় হারিয়ে আজ আমি সত্যিই শোকাহত।

ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি আমাদের পরিবারের সাথে ওনার খুবই ভালো সম্পর্ক। পড়ালেখা, মানসিক মনোবল যোগানো থেকে শুরু করে বিপদে আপদে তাকে সদা আমাদের পরিবারের পাশে পেতাম। আমরা চার ভাইবোন প্রত্যেকেই ওনার কাছ থেকে শিখেছি ও দিকনির্দেশনা পেয়েছি। সদা হাস্যোজ্বল এই মানুষটির কাছে যে কোন কিছু জানার জন্য গেলে এত চমৎকারভাবে বুঝাতেন, সত্যিই বিমোহিত হতাম। সর্বদা তিনি আমাকে ও আমার ভাইবোনদের একজন বড় ভাইয়ের মতো দেখতেন, পাশে থাকতেন। তাই আমি ও আমার ভাইবোনরা তাকে স্যার না ডেকে 'ভাই' বলে সম্ভোধন করতাম।

পাচ/ছয় বছর অাগের ঘটনা। আমি ইউসুফ ভাইয়ের বাসায় ওনার বড় ছেলেকে পড়াতে যেতাম। প্রায়শই নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম। চমৎকার ভাবে কথা বলতেন। অনেক বিষয়ে জানতে পারতাম। একদিন কথায় কথায় পঞ্চম শ্রেনির সমাপনী পরীক্ষার প্রসঙ্গ উঠলো। ইউসুফ ভাই আফসোস করে বলছিলেন ," যেভাবে দেশে প্রশ্ন ফাস হচ্ছে , জাতির জন্য খুবই দুঃখজনক। এমনকি সমাপনীর প্রশ্নও এখন ফেজবুক, ওয়াটসএপে পাওয়া যাচ্ছে, যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তবে অনেকেই অসদুপায় অবলম্বন করলেও আমি আমার কোনো শিক্ষার্থীকে অসদুপায় অবলম্বন করতে দেবোনা। প্রয়োজনে দু ঘন্টার যায়গায় চার ঘন্টা শ্রম দেবো, কোন পাঠ না বুঝলে বার বার বুঝাবো। আমি চাই আমার প্রতিটা ছাত্রছাত্রী সৎ, আর্দশবান ও প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হোক।" ওনি শুধু কথায় নয় কাজেও প্রমান করে গেছেন তার আদর্শ।

বর্তমানে রুপালী ব্যাংকে কর্মরত আমার বড় ভাই এনামুল হক সরকার ইউসুফ ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে অশ্রুশিক্ত নয়নে বলেন, "আজ আমি আমার একজন বড় ভাই, অভিভাবক ,শিক্ষক ও শুভাকাঙ্ক্ষীকে হারালাম। আমার শিক্ষাজীবনে উনি বিরাট স্হান দখল করে আছেন। আমার বর্তমান অবস্থানে পৌছতে ইউসুফ ভাই যেভাবে আমাকে পড়ালেখায় সাহায্য ও মানসিকভাবে সাপোর্ট দিয়েছেন, তা কখনো পূরণ করার মতো নয়।"

শুধু আমার পরিবার নয়, তার প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীর ভাষ্য,"আমরা আজ একজন গুণী, কর্মঠ ও আদর্শবান শিক্ষককে হারালাম।"

নোয়াখালি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাজিব হোসেন যিনি ইউসুফ আলী খান স্যারের ছাত্র, ফেজবুকে লিখেছেন,"২০০৬ -২০২০ পর্যন্ত মহিচাইলে তৈরি করেছেন অনেক মেধাবী স্টুডেন্ট আলোকিত করেছেন মহিচাইল তথা তার আশেপাশের এলাকাকে,আমি স্যারের সরাসরি স্টুডেন্ট, কাছ থেকে দেখেছি স্যার কতো নিষ্ঠার সাথে পাঠদান করাতেন, আল্লাহ যেন স্যারকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করেন।"

বর্তমানে ঢাবিতে পড়ছেন তার আরেক ছাত্র সুমন আহম্মেদ লিখেছেন, "আর হয়তো বা কেউ দেখা হলে সমাজে বেড়ে উঠার অনুপ্রেরণা দিবে না। আমার সবচেয়ে অনুপ্রেরণার স্থানটি আজ হারালাম। এমন একজন আদর্শ স্যার আজ আমাদের মাঝে নেই মানতে কষ্ট হচ্ছে।স্যারের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।আল্লাহ যেন স্যারকে বেহেশত নসিব করেন।"

সমাজসেবামূলক কর্মেও পিছিয়ে ছিলেন না ইউসুফ ভাই। সমাজসেবক মোঃ রফিকুল ইসলাম লিখেছেন,"ইউছুফ ভাই বামুটিয়া গ্রামের একজন কৃতি সন্তান। আমার সকল জনকল্যাণকর কাজের ভূয়সী প্রশংসা করতেন সব সময়। নিজে ও মাঝেমাঝে কল দিতেন। গত মার্চে উনার সাথে আমার সর্বশেষ আলাপটা হয়েছিল। পোনসাই কমপ্লেক্স আয়োজিত শ্রাবন্তী হক মেমোরিয়াল বৃত্তি অনুষ্ঠানে সশরীরে উপস্থিত থাকতেন এবং উৎসাহব্যঞ্জক বক্তব্য দিতেন। শিক্ষক হিসেবে ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। মহিচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গত কয়েক বছর চমৎকার ফলাফল করে আসছিল উনার দক্ষ পাঠদান এবং সহশিক্ষকদের সঠিকভাবে গাইড করার কারণেই। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মরহুম ইউছুফ ভাইকে জান্নাতবাসী করুন এবং উনার পরিবারকে এই সাগরসম শোক সইবার শক্তি দান করুন।"

এমদাদুল হক সরকার

শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।