বদলে যাওয়ার চিন্তা যেন সার্থক হয়

বদলে যাওয়ার চিন্তা যেন সার্থক হয়

ফাইল ছবি

ড. মীর মনজুর মাহমুদ

ইসলামের জীবনবোধ মানুষের জীবন ও সমাজকে ঢেলে সাজাতে চায়। শুধু বিশ্বাসে ধারণ করা নয়, বরং সাথে সাথে কাজ দিয়ে তার প্রমাণ দেয়ার প্রতি সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে ইসলাম। মানুষ পরিবর্তন চায়। যাকে বদলে যাওয়া বা বদলে দেয়া বলা যায়। কিন্তু তা নিজের বেলায় নয়, বরং অন্যের বেলায় সচারচর চেয়ে থাকি। এটি অনেকটা সহজাত। কথাটি সবার জন্য প্রযোজ্য না হলেও এটিই যেন স্বাভাবিক। বদলে যাওয়া মানে পরিবর্তন হওয়া। আর তা হতে হবে সদার্থক। বাস্তবে প্রতিনিয়তই মানুষের এই পরিবর্তন ইচ্ছা-অনিচ্ছায় ঘটছে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে তা ঘটেই চলেছে- যা থামাবার নয়, সেটা মানুষের এখতিয়ারেরও বাইরে। তবে বদলে যাওয়া বা পরিবর্তন হওয়াটা একটি কঠিন কাজ। তবে সেটা অসম্ভব নয় আবার সকল ক্ষেত্রে সম্ভবও নয়। এটি কাঙ্ক্ষিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত দুটোই হতে পারে। অর্থাৎ পরিবর্তন কোথাও অপরিহার্য আবার কোথাও নিষিদ্ধ।  সত্য এই যে, মানুষ ও তার সমাজ সদা পরিবর্তনশীল। পুরাতনের স্থানে নতুনের আগমন মানুষের চিরায়ত বাসনা। সেটি ক্ষেত্রবিশেষের জন্য প্রযোজ্য। আবার পুরাতনকে আঁকড়ে ধরে থাকার প্রবণতাও মানুষের মধ্যে প্রবল। সকল যুগের পরিবর্তনের পথে এটি বড় বাধা হিসেবে বরাবরই কাজ করেছে। এটিকে অতিক্রম করেই মানুষকে পরিবর্তনের নাগাল পেতে হয়েছে। তবে সেটি মানুষের আয়ত্তের বাইরে নয়। কুরআন মানুষের সক্ষমতা নিয়ে বলছে, “আমি কাউকে তার সাধ্যাতীত কষ্ট দেই না…” (সূরা আল-মুমিনূন, ২৩: ৬২)

প্রশ্ন হলো, মানব সমাজের এই পরিবর্তন সাধন কে, কার জন্য, কীভাবে করে থাকে বা হয়ে থাকে? এক কথায়, মানুষের সমাজ মানুষেই গড়ে। ভালো-মন্দ যা-ই হোক, সেটির পরিবর্তন সাধন মানুষই করে থাকে। পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় যে বা যারা-ই থাকুক না কেন, উপকার বা অপকারভোগী হয় সকলেই। রাতারাতি নয় ধীরে ধীরে, একটি দীর্ঘ সময় নিয়ে। আর বদলে যাওয়া বিষয়ের গুরুত্ব বা অবস্থানের উপরে নির্ভর করে এর ব্যক্তিক বা সামাজিক সমাজ প্রভাব। পরিবর্তিত বিষয়টি ভালো হলে সমাজের মানুষের কল্যাণের দরজা খুলে যায়। আর খারাপ হলে শত অকল্যাণে এসে চেপে বসে। এর মধ্যদিয়েই সভ্যতা ও সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধিত হয়। ইতিহাস বলে, সমাজের সকল মানুষ এর নিয়ামক হতে পারে না। পরিবর্তনের পরিকল্পনা আসে সমাজের চিন্তাশীল মানুষের মাধ্যমে আর তা সর্বপ্রথম ধারণ করে এবং চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে যুব সমাজ। সে সর্বজন স্বীকৃত যে, সমাজের যুবক শ্রেণীই সকল কালে, সকল যুগে পরিবর্তন বা বদলে যাওয়া অথবা দেয়ার নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে থাকে। সুতরাং পরিবর্তনের উভয়বিধ টার্গেট হয়ে থাকে নিজ নিজ সমাজের যুবশ্রেণী। নিকট অতীতেও নারীরা এর বাইরে বিবেচিত হলেও বর্তমানে যুব সমাজ বলতে, নারী-পুরুষের সক্রিয় ভূমিকাকে মাথায় রেখেই চিন্তা করতে হবে। আদর্শিকভাবে ইসলাম সেটিকে বরাবরই গুরুত্বারোপ করে থাকে।   

বিশ্বায়নের যুগে মানুষের মাঝে পরিবর্তনের আগ্রহ, নতুনকে আহবানের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। আমাদের জীবনেও সেটা দেখা যাচ্ছে। দৈনন্দিন জীবনের রুটিন, পারিবারিক একান্ত অঙ্গন, সমাজব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রে একই চিত্র। আমরা সকল ক্ষেত্রেই উন্নয়নকে টার্গেট করেছি। কেবলই উন্নয়ন আমাদের লক্ষ্য। ফলে সকল ক্ষেত্রেই পরিবর্তন আসছে দ্রুত। তবে সদার্থক পরিবর্তন কতখানি তা সচেতনভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটছে, কিন্তু তা যেন কাঙ্ক্ষিত মানবিক হচ্ছে না। দেশের স্বল্পসংখ্যক মানুষের মানুষের মাঝে ধন-সম্পদ, বিত্ত-বৈভব, সুখ-সাচ্ছন্দের উপকরণ বিরাজ করছে। দিন দিন বঞ্চিত মানুষের দল ভারী হচ্ছে। ব্যবধান বাড়ছে সমাজের মানুষে মানুষে। অসম প্রতিযোগিতায় বাড়ছে হিংসা-বিদ্বেষ, অবিশ্বাস-অনাস্থা, অকল্যাণকামিতা, পরশ্রীকাতরতা। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের বৃহত্তর অঙ্গনে দরদ, ভালোবাসা, সম্প্রীতি-সৌহার্দ, মিল-মহব্বত একেবারে উবে যাওয়ার পথ ধরেছে। এমন মানবিকতাশূন্য পরিবর্তন বা উন্নয়ন আমাদেরকে কতখানি কল্যাণ দেবে!  আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরি করে দেন। এবং তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিযক দিবেন যা সে কল্পনাও করতে পারবে না। আর যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তাঁর উদ্দেশ্য পূর্ণ করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ প্রত্যেক জিনিসের জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন।” (সূরা ত্বলাক, ৬৫:২-৩)

আমরা গভীর উৎকন্ঠার সাথে প্রত্যক্ষ করছি, শিক্ষিত মানুষ, শিক্ষার হার, পেশাগত উন্নয়ন হলেও সেবার মান প্রত্যাশার আলোকে বাড়ছে না। ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে পারিবারিক ও সামাজিক অনুশাসনের অনাকাঙ্ক্ষিত অনুপস্থিতিতে সমাজের হানাহানি, বিভেদ মোটেই কমছে না। দিন দিন আমাদের সমাজ বাসযোগ্যতা হারাতে বসেছে। অনেক চেষ্টা করেও ব্যক্তি থেকে সামষ্টিক জীবনে এই উন্নয়ন বা পরিবর্তনের কল্যাণকামিতা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। ফলে কী হচ্ছে- আলোকিত শহরের রাস্তায় অন্ধকারের যাত্রীরা পথ চলছে, প্রশস্ত পথে সংকীর্ণ মনের মানুষের ভীড়, উঁচু তলায় নীচু মনের ও মানের মানুষের বাস, সেবার নামে প্রতারণা, শিক্ষার নামে বিভ্রান্তি, বিনোদনের নামে বিকৃতি আর বল্গাহীনতার মহড়া, সততা ও সত্যবাদিতার বিতাড়নে অসত্য-মিথ্যাচারের জয়জয়াকার, মেকির আড়ালে আসল হারিয়ে হাহাকার, অতীত ভুলে নেশাগ্রস্ত বর্তমান নিয়ে ভবিষ্যত গড়ার প্রতিযোগিতা চলছে। হালের আনুগত্য ভুলে দাঁড় বেয়ে চলেছি ঘাটে ভেড়ার আশায়। প্রজন্মকে নিয়ে ভাবছি সবাই। কিন্তু দিশেহারা কেন- মা-বাবা, শিক্ষক, সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলগণ? আমাদের পরিবর্তনের নায়ক যে যুবসমাজ তাদের কী অবস্থা! কেউ ড্রাগের নেশায়, কেউ রঙীন পানি, কেউ অবৈধ যৌনাচার, কেউ প্রযুক্তির আসক্তিতে আবার কেউ সন্ত্রাসের পথে পা বাড়িয়ে গোটা দেশ ও জাতির অর্জনকে নিঃশেষ করছে। এগুলো জাতীয় জীবনের জন্য এক বিরাট দুঃস্বপ্ন, মহাপ্রলয়ের আগমনী বার্তা। কোনো এক বা কিছু হতভাগা বাবা-মার ব্যর্থতার দায় এখন গোটা জাতির দায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সমাজের জন্য মহামারি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতি আর অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ার স্বপ্নে বিভোর মানুষগুলো সমাজ ও দেশের অনিষ্ট সাধন করছে-এর দায় কার?  এ সকল সীমালঙ্ঘনকারীকেও সংশোধনের সুযোগ দিয়ে আমাদের মহান রব জানিয়ে দিচ্ছেন, "যদি তোমরা বৃহত্তর নিষিদ্ধ কাজগুলো থেকে বিরত থাকতে পার তাহলে আমি তোমাদের অন্যন্য গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেব। এবং তোমাদেরকে সম্মানজনক স্থানে প্রবেশ করাব" (সূরা আন নিসা, ০৪: ৩১)

আমরা ভালোভাবেই জানি যে, এ দায়ভার কাউকে না কাউকে নিতেই হবে কিছু আগে বা পরে, কিন্তু ততদিনে সর্বনাশ যা হবে তার ঋণ শোধ দিতে হবে গোটা জাতিকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। আর্থিক ঋণ নিয়ে আমাদের চিন্তা ও মাথা ব্যথা একেবারে কম নয়, একই সাথে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হিসাব কষতেও আমরা যথেষ্ট তৎপর। এগুলো দোষের নয়, অনিবার্যও বটে। তবে অন্যটি বাদ দিয়ে। একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বখে যাওয়া, মদমত্ত উন্মাদ তরুণের দায়ভার শুধু সংশ্লিষ্ট বাবা-মা বা অভিভাবক, নয় কেবল রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্বশীলদের; বরং সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের সকলের। হ্যাঁ, কারো কম বা বেশি। প্রতিদিন, প্রতি মূহুর্তেই এ বিষয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কিছু না কিছু ভূমিকা পালনের চেষ্টা করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে হতাশ হওয়া নয়, বরং আমাদেরকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সংশোধনের জন্য সচেষ্ট হতে হবে।  আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে অভয় দিয়েছেন এভাবে- “হে আমার বান্দারা! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছো, আল্লাহর অনুগ্রহ হতে নিরাশ হয়ো না; আল্লাহ সমুদয় পাপ ক্ষমা করে দিবেন। তিনি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (সূরাহ আয-যুমার, ৩৯:৫৩)

মনে রাখতে হবে, বরকে বাদ দিয়ে যেমন বরযাত্রী হাস্যকর তেমনি বর্তমান প্রজন্মকে ধ্বংসের পথগুলো কার্যরভাবে বন্ধের উদ্যোগ নিয়েই বদলে যাওয়া অথবা বদলে দেয়ার স্বপ্ন দেখতে হবে। যুবসমাজ আগে নিজেকে বদলাবে তারপর অন্যের স্বপ্ন দেখলেই তা সার্থক হবে। নতুবা ‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শেখাও’ সূত্রে তার প্রচেষ্টা প্রত্যাখ্যাত হবে। উপকরণ হিসেবে মানবিকতাকে সবার উপরে স্থান দিতে হবে। তাদের সামনে পরিবর্তনের সুনির্দিষ্ট রোলমোডেল দিতে হবে। কোনোভাবেই শুধু বিত্ত-বৈভবের স্বপ্ন, বৈষয়িক উন্নয়ন কর্মসূচি জীবনের লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা যাবে না। বাবা-মা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে যুগপথভাবে সন্তানের ভালো ফলাফলের সাথে ভালো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন জাগাতে হবে। এ দেশের সকল ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাসের আলোকে সন্তান-সন্ততিকে মানুষ হিসেবে গড়ার উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু সন্তানের বা নিজের কল্যাণ চিন্তায় নয়, বরং মানবতার কল্যাণকামী হিসেবে জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখাতে হবে। দেশপ্রেম ও মানবতার প্রতি দায়িত্বশীল হওয়ার প্রথম তালিম যেন পরিবার থেকেই শুরু হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। এক কথায়, মানুষে মানুষে বিভেদ নয়, প্রীতিপূর্ণ সমাজ গড়ার জন্য ভালো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখাতে হবে আমাদের তরুণ সমাজকে। সকল ক্ষেত্রেই সফলতার মানদন্ড যেন মানবিকতা হয় তা মাথায় রাখতে হবে। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের পার্থিব কষ্টসমূহ থেকে কোনো কষ্ট দূর করবে কিয়ামতের কষ্টসমূহ থেকে আল্লাহ তার একটি কষ্ট দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবীকে দুনিয়াতে ছাড় দেবে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে ছাড় দেবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের দোষ গোপন রাখবে, আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। আর আল্লাহ তা‘আলা বান্দার সাহায্য করেন যতক্ষণ সে তার ভাইয়ের সাহায্য করে। আর যে কেউ ইলম অর্জনের কোনো পথ দেখাবে, আল্লাহ তাকে এর কারণে জান্নাতের দিকে একটি পথ সুগম করে দিবেন…” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং, ৭০২৮)   

লেখক, গবেষক।