ইসলামে উত্তম চরিত্র

ইসলামে উত্তম চরিত্র

ইসলামে উত্তম চরিত্র

ইসলাম মানুষকে একটি শাশ্বত জীবনবোধ দিয়েছে। এই জীবনদর্শনের বিশিষ্টতা মুসলিম জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ। এ জন্য সৎ চরিত্রকে মানবজীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ বলা হয়ে থাকে। মানব সন্তানের চরিত্র গঠনের সর্বোত্তম সময় শিশুকাল। তবে জীবনকে সত্য সুন্দরের পথে পরিচালিত করতে জীবনব্যাপি সাধনা ও সাবধানতা অব্যাহত রাখতে হয়। পরিবার হলো চরিত্র ও মানবিক মূল্যবোধ গঠন ও চর্চার প্রথম এবং স্থায়ী প্রতিষ্ঠান। মাতা-পিতা হলেন এই প্রতিষ্ঠানের আল্লাহ নিযুক্ত শিক্ষক- যে দায়িত্বের জন্য তাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে। এটি অধিকাংশ বাবা-মা যেন ভুলেই গেছি। নানা ব্যস্ততার নামে আমরা এই শিক্ষকতার দায়িত্ব পালনে অবহেলা করে থাকি। মানুষের চরিত্রবান হওয়াটা বিকল্পহীন। কারণ চরিত্রহীন মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য করতেও কেউ কেউ আপত্তি করেছেন। এটি হারালে কুরআনের ভাষায় সে পশু অথবা তার চেয়েও অধম হয়ে পড়ে। আল্লাহ বলেন, “আর এটি একটি অকাট্য সত্য যে, বহু জিন ও মানুষ এমন আছে যাদেরকে আমি জাহান্নামের জন্যই সৃষ্টি করেছি৷ তাদের হৃদয় আছে কিন্তু তা দিয়ে তারা উপলব্ধি করে না৷ তাদের চোখ আছে কিন্তু তা দিয়ে তারা দেখে না ৷ তাদের কান আছে কিন্তু তা দিয়ে তারা শোনে না৷তারা পশুর মত বরং তাদের চাইতেও অধম৷ তারা চরম গাফলতির মধ্যে হারিয়ে গেছে ৷ [সূরা আরাফ,০৭: ১৭৯]

এখন আসি, চরিত্র কি? একজন মানুষের ভিতর ও বাইরের সমন্বিত সৌন্দর্যময় প্রকাশকে চরিত্র বলা যেতে পারে। এটি কোনো ধারণাগত বিষয় নয়, বরং মানবজীবনের কাঙ্খিত ঐ সকল আচরণ যার উপস্থিতিতে একজন মানুষ সকলের জন্য কল্যাণকামী হয়ে উঠতে পারে। এর অনুপস্থিতিতে একই মানুষ ঘৃণিত ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে। চরিত্রগুণ মানুষকে অর্জন করতে হয়- এটি এমনিতে আসে না। বিশ্বমানবতার জন্য সে চরিত্রের মান নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীগণ। আলকুরআন ও সুন্নায় প্রত্যাশিত মানবচরিত্রের ছবি আঁকা হয়েছে। সেটিকে অনুসরণ করলেই একজন মানুষ উত্তম চরিত্রের অধিকারী হতে পারবে। মহান আল্লাহর নির্দেশনায় নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে নকশার বাস্তব নমুনা ছিলেন। তাই প্রত্যেক মানবসন্তানের উত্তম চরিত্র গঠনের জন্য তাঁর নির্দেশনাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে সকলের জন্যই তিনি আদর্শ। সাধারণভাবে মানবতার প্রতি ইসলামের আহবান এটিই। আমরা জানি, মানুষের আখলাক (চরিত্র) তার নিজ নিজ বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। মানব মনে বিশ্বাসের যে বীজ বপন করা হয়, কথা ও কাজ এবং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে। একজন মুসলিমের ইসলামের প্রতি তার বিশ্বাসের গভীরতার ওপরে নির্ভর করে চরিত্র মাধুর্য গড়ে ওঠবে- এটাই স্বাভাবিক। স্বভাবগতভাবে মানুষ যা বিশ্বাস করে, সে অনুযায়ী চিন্তা করে। আর যে চিন্তা করে, সে অনুসারে সে কাজ করে থাকে। তাই, যে মানুষের বিশ্বাস ভালো, তার চিন্তা ও কাজ সুন্দর। সুতরাং চরিত্র গঠনের সূচনা হবে বিশ্বাসের পুনর্গঠন থেকে এবং তার বহি:প্রকাশ ঘটবে দৈনন্দিন আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে।

ইসলামের দৃষ্টিতে মানবচরিত্রের উন্নতি-অবনতি, উত্থান-পতন সবই নির্ভর করে তার মানসিক বিকাশ ও মূল্যবোধের জাগৃতির ওপর। আলকুরআনের বক্তব্য অনুযায়ী রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাতের অন্যতম দায়িত্ব ছিল মানুষের তাযকীয়ায়ে নাফস বা চরিত্র গঠনের কাজ করা। সে কারণে মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল কুরআনের আলোকে মানুষের চরিত্র গঠনের কাজ করেছিলেন। তিনি নিজেকে উত্তম চরিত্রের মডেল হিসেবে পেশ করেছিলেন। সাহাবীগণ তাঁকে সঠিকভাবে অনুসরণ করেছিলেন। ফলে তারা সকলেই উত্তম চরিত্রের অধিকারী হয়েছিলেন। অনাগতকালের মানুষের জন্য সে একই কথা প্রযোজ্য হবে। নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরিত্রের একটি অন্যতম দিক উল্লেখ করে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,  “অতঃপর আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমতের কারণে তুমি তাদের জন্য নম্র হয়েছিলে। আর যদি তুমি কঠোর স্বভাবের, কঠিন হৃদয় সম্পন্ন  হতে, তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে পড়ত।” [আলে ইমরান, ০৩:১৫৯] তিনি আরো বলেছেন, “আর ভাল ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দকে প্রতিহত কর তা দ্বারা যা উৎকৃষ্টতর, ফলে তোমার ও যার মধ্যে শত্রুতা রয়েছে সে যেন হয়ে যাবে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু।” [ফুছ্ছিলাত, ৪১:৩৪]  নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আমাকে সৎচরিত্রের পূর্ণতা সাধনের নিমিত্তেই প্রেরণ করা হয়েছে।”  [ মুসনাদে আহমাদ, ১৪/৫১২ ]

উল্লেখ্য, দ্বীনের এক অর্থ সৎচরিত্রতা। এক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দ্বীনের সংজ্ঞা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “উত্তম চরিত্র।” অন্যত্র তিনি বলেছেন, “মুমিনের পূর্ণতা ঈমানে এবং উত্তম চরিত্রগুণে”। [সুনান আবু দাউদ, ৪/৩৫৪] মুসলিম ঈমানের অবস্থান অনুযায়ী আখিরাতে মর্যাদালাভ করবেন এবং চরিত্র অনুযায়ী দুনিয়াতে সমাদৃত অথবা অনাদৃত হবেন। দুনিয়াতে গ্রহণযোগ্যতা লাভ এবং সফলভাবে কাজের জন্য ব্যক্তি চরিত্রমাধুরি বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।

এ কথা বলা যায় যে, একজন মুসলিম মানেই উত্তম চরিত্রের অধিকারী একজন ভাল মানুষ। এই গুণ অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপরিহার্য। একজন মুসলিম কখনই খারাপ চরিত্রের হতে পারে না। অর্থাৎ একজন চরিত্রহীন মানষের জন্য প্রকৃত অর্থে মুসলিম হওয়া অসম্ভব। উদাহরণটা এমন যে, ভালো খাবার ময়লা পাত্রে রাখলে যেমন তা খাওয়ার উপযুক্ততা বা বিশুদ্ধতা হারায়, তেমনি একজন ঈমানদারের জীবনে মন্দকাজ তাকে ভালো মুসলিম হওয়ার অনুপযুক্ত করে দেয়। উত্তম চরিত্রের অধিকারী একজন মানুষ এবং মুসলিম একে অন্যের পরিপূরক।
উত্তম চরিত্র বলতে ইসলামী চরিত্রকে আমরা জানি। আরবী ভাষায় চরিত্র বলতে আখলাক বুঝায়। বহুবচনে ‘খুলুক’। অর্থ মানুষের জন্মগত স্বভাব ও প্রকৃতি। ধাতুগত অর্থে বস্তুর পরিমিতি বুঝায়। চরিত্র, স্বভাব, সদাচার, সৌজন্যমূলক আচরণ, কোন কিছুর অংশও বুঝায়। রাগিব আল-ইসপাহানী বলেন, খালক ও খুলক মূলত এক ও অভিন্ন শব্দ। তবে ব্যবহারিক অর্থে খালক শব্দটি আকৃতি ও অবয়বের জন্য নির্দিষ্ট এবং খুলুক শব্দটি বোধ ও অনুভবের সাথে সংশ্লিষ্ট। ইবনে মানযূর বলেন, খুলুক হচ্ছে দীন, স্বভাব এবং প্রকৃতি, মানুষের অন্তর্নিহিত চিত্র। পরিভাষায় মানুষের দৈনিক কাজকর্মের মাধ্যমে যেসব আচার ব্যবহার চাল-চলন এবং স্বভাবের প্রকাশ পায়, সে সবের সমষ্টিই হল ‘আখলাক বা চরিত্র।  
 ইমাম গাযালী র.-এর মতে, “সৎচরিত্রতা বলতে বুঝায় মানব মনে গ্রোথিত ঐ অবস্থাকে যা থেকে অনায়াসে কোন কর্ম সম্পাদিত হয়”। ইমাম জুরজানী র. বলেন, খুলুক বলা হয় মনের এমন এক প্রবল অবস্থাকে, যা দ্বারা অতি সহজে চিন্তাভাবনার প্রতি কোন রকম প্রয়োজন ছাড়াই কার্যাদি প্রকাশ পায়, আর চরিত্রের এ অবস্থাকে বলা হয় উত্তম চরিত্র।

সাধারণভাবে আখলাক হলো, মানুষের সাথে পারস্পরিক সুসম্পর্ক, সৌহার্দ্য ও সৌভ্রাতৃত্ব বজায় রেখে সদাচার ও সৌজন্যমূলক ব্যবহার করা। আর সৎচরিত্রতা হলো, মানব মনের ঐ সকল মূল্যবোধ ও মৌলিক গুণাবলি- যার মানদন্ডে কোন কাজ সুন্দর বা অসুন্দর বিবেচিত হয়। মানুষের মাঝে এ সকল অনিন্দ্যসুন্দর গুণাবলীর সমাহার ঘটাতে হবে ভিতরে বাহিরে সমানভাবে; নতুবা তা হবে আপাত সুন্দর বা মেকী, যা কখনো স্থায়ী কল্যাণ বয়ে আনবে না। সে ইসলাম তাকওয়া, সত্যবাদিতা, যিকর, সবর, শোকর, ইহসান, খিদমাতে খালক ইত্যাদি গুণাবলি আখলাকে হাসানার অন্তর্ভুক্ত করেছে। এর বিপরীত হলো আখলাকে সায়্যিআ। যেমন, ফিসক, খিয়ানত, গীবত, নিফাক, কিযব ইত্যাদি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে উত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়ার তাওফিক এনায়েত করুন। আমীন।

গবেষক, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক।