রহমানের মেহমানকে বলছি

রহমানের মেহমানকে বলছি

ফাইল ছবি

সুদূর মক্কা মদীনার পথে আমি রাহী মুসাফির- এ ‘মুসাফির’-এর পরিচয় তিনি দয়াময়-মায়াময় এক মহান সত্ত্বার মেহমান। সহজ কথায়, একটি বিশেষ সময়কালের জন্য আল্লাহ তায়ালা মেজবান এবং একজন হজ্জ পালনকারী মুসলমি হয়ে যান তাঁর সম্মানিত মেহমান। এটি কত বড় পরিচয়, কী মহান মর্যাদা তা ক জনের কাছে স্পষ্ট! আমরা যারা হজ্জ পালন করতে যাই বা গিয়েছি তাদের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট করা গেলে ব্যক্তি সমাজ তথা দুনিয়ার চিত্রটিই পাল্টে যেত। অনায়াসে পৃথিবীর মানুষ মানব সমাজের সেই কাঙ্খিত রূপটিও আবার নতুন করে দেখতো- যা দেখছিলেন মদীনার সেই সোনালী সমাজ তপ্ত মরু আর পাহাড়ঘেরা ছোট্ট একটি জনপদ, সদস্য সংখ্যা আনুমানিক ৩০০০- যারা কুরআনের মত এক শাশ্বত গ্রন্থের জীবন্ত সাক্ষী বনে গেলো চিরকালের কিন্তু কিভাবে মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে কোন পথ রেখার অনুকরণ তাদেরকে এক প্রাণময় মানবসভ্যতার স্থপতি বানিয়ে দিয়েছিল? সেদিনের গুটি কয়েক মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত দ্বীন দেড় হাজার বছর ধরে গোটা দুনিয়ার মানুষকে পথ দেখাচ্ছে। পৃথিবীর শেষ সূর্যস্ত  পর্যন্ত   এ ধারা অব্যাহত থাকবে। হ্যাঁ, সেই স্বপ্ন জাগাতেই আল্লাহর মেহমানদের সম্বোধন করে অতি সংক্ষেপে কিছু বলতে চাই।

আমরা জানি হজ্জ বলতে ‘ইচ্ছা’ বা ‘সংকল্প’ করাকে বুঝায়। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় হজ্জের মাসগুলোতে বিশেষ কিছু কার্য সম্পাদনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু স্থানের জিয়ারত করাকে হজ্জ বলে। এটি ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ যা সমর্থবান মুসলমানদের জন্য ফরজ করা হয়েছে। শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য জীবনে একবার হজ্জ পালন করা ফরজ। আল্লাহ বলেন, ‘তাতে রয়েছে স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ, মাকামে ইবরাহীম। আর যে তাতে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ  হয়ে যাবে এবং সামর্থবান মানুষের উপর আল্লাহর জন্য বায়তুল্লাহর হজ্জ করা ফরয। [আল-ইমরান, ০৩: ৯৭]  এখানে শারীরিক ও আর্থিক উভয় দিকই জড়িত। অর্থাৎ এমন কিছু ইবাদত যাতে আর্থিক ইবাদতের সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক পরিশ্রমও জড়িত। একজন হজ্জ পালনকারীর জন্য কষ্ট আর সীমাহীন ধৈয্য সবচেয়ে মূল্যবান পূঁজি আর্থিক ও শারীরিক উভয় প্রকার ইবাদাত হজ্জের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকায় অন্যান্য ইবাদতের তুলনায় এটি ব্যতিক্রম ও ভিন্ন গুরুত্ব বহন করে থাকে। আল্লাহ তাআলা’র নৈকট্যলাভের এটি একটি কার্যকর মাধ্যম।

এবারে আসি প্রবন্ধের শিরোনাম প্রসঙ্গে। আপনি রহমানের মেহমান কীভাবে? একটু ভেবে দেখবেন কি? নবীজি বলেছেন,‘হজ্জ ও উমরাহ্ পালনকারীরা আল্লাহর মেহমান। তারা দু’আ করলে তা কবুল হয়ে যায় এবং গুনাহ্ মাফ চাইলে তা মাফ করে দেয়।’ [ইবনে মাজাহ: ২৮৯২] চিন্তা করে দেখুন তো, আমাদের মত পাপাচারে লিপ্ত অথবা পাপাসক্ত একজন মানুষ, যে কি না কালো গিলাফে মোড়া এই ঘরের যিয়ারতের সিদ্ধান্ত নিল আর নিজেকে শুধরে নেয়ার  সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা করল; তার জন্যই একটি দাওয়াতপত্র বরাদ্দ হয়ে গেল! কুরআন কারীম বলছে মুসলমি জাতির পিতা সাইয়্যেদুনা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম পুত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালামসহ কাবার নির্মাণ কাজ শেষ করলেন, তখন এ ঘরের মালিক নির্দেশ দিয়েছিলেন, এভাবে এবং মানুষের মধ্যে হজ্জের সাধারণ ঘোষণা করে দাও, তারা তোমার নিকট উপস্থতি হবে পদব্রজে ও প্রত্যেকে ক্ষীণকায় উটনীর পিঠে করে যা দূর-দূরান্তের পথ থেকে আসে [আল-হাজ্জ, ২২:২৭] মুসলমানদের জন্য এ দাওয়াত পত্রটি আরো একটি দলিল হয়ে গেল, কে মেজবান আর আপনি কার মেহমান । আপনার প্রথম দায়িত্ব হলো, পত্রটি ভালো করে বুঝে নেয়া যে, মেহমান হিসেবে আচরণ বিধি কি হবে আর আপনার জন্য এই ঘরের মালিক কি কি বরাদ্দ রেখেছেন। এ প্রসঙ্গে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বক্তব্যটি দেখুন, “যে ব্যক্তি শুধু আল্লাহকে খুশি করার জন্য হজ্জ করলো এবং হজ্জকালে যৌন সম্ভোগ ও কোন প্রকার পাপাচারে লিপ্ত হলো না সে যেন মায়ের  গর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হবার দিনের মতোই নিষ্পাপ হয়ে বাড়ি ফিরলো [বুখারী : ১৫২১] শুধু কি তাই? নবীজি আরো বলেছেন, “তোমরা হজ্জ ও উমরা পালন কর। কেননা হজ্জ ও উমরা উভয়টি দারিদ্র্যতা ও পাপরাশিকে দূরীভূত করে যেমনিভাবে রেত স্বর্ণ, রৌপ্য ও লোহার মরিচা দূর করে দেয় । আর মাবরূর হজ্জের বদলা হল জান্নাত। [তিরমিজি: ৮১০] হিসাব খুবই সহজ কিন্তু সিদ্ধান্ত হতে হবে সুস্পষ্ট ও সুদৃঢ়। এ থেকে আরো জানা যায় যে, হজ্জের এই মহান সফর কুসুমার্স্তীণ নয়।

হ্যাঁ, আল্লাহ তায়ালার মেহমানদেরকে বলছি  আপনাদের মত কতজন এ সুযোগ পেয়েছেন, কেন আপনাদেরকে এই আহবান করা হয়েছে কেন এত মর্যাদার ঘোষণা দেয়া হয়েছে কেন এই বৈশ্বিক আয়োজন, ইসলামের বহুমাত্রিক এ ইবাদত নিয়ে চিন্তা করা জরুরি নয় কি? আমরা জানি বিশ্বাসী মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় দু’টি পুরস্কারের ঘোষণা এখানে রয়েছে একটি আল্লাহর নৈকট্যলাভ অন্যটি তাঁর আদেশ অমান্যজনিত ক্ষমা, যাকে শর্তাধীন করা হয়েছে তবে মানুষের হক বিনষ্টের বিষয়টি এর মধ্যে শামিল হবে না। হজ্জকালীন আদেশ ও নিষেধগুলো হজ্জ পরবর্তী সময়য়েও ভুলে না যাওয়া তার অন্যতম শর্ত। একইসাথে আপনার স্মৃতিতে যেন মলিন না হয়- তাওহীদের দৃশ্যমান সর্বোচ্চ নিদর্শন বায়তুল্লাহর তাওয়াফকালীন অনুভূতি মুসলিম জাতির পিতা ও তাঁর পরিবারের মহান ত্যাগের স্মৃতিময় মিনা প্রান্তরের শিক্ষা আরাফা ও মুজদালিফা ময়দানের হৃদয় নিসৃত  মাগফিরাতের আকুতি আর সর্বোপরি হজ্জে মাবরুর লাভের প্রত্যাশা।

ও আল্লাহর মেহমানরা! আল্লাহর ঘরে আসার দাওয়াততো এজন্যই যে আপনি এখান থেকে ফিরে তাওহীদের মুয়াজ্জিন বনে যাবেন, তাওয়াফকালে অঙ্গীকার অনুযায়ী দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ কেবল তাঁর কাছে চাইবেন, সকল প্রকার অশ্লীলতা, ঝগড়া-বিবাদ, সংর্কীর্ণতাকে ভুলে ক্ষমা ও ত্যাগের জীবনাচরণে অভ্যস্ত হবেন। ফিরে এসে সমাজের পঙ্কিলতা যেন আর নতুন করে গায়ে না লাগে সে বিষয়ে সচেতন হবেন। ভাষার বর্ণের মত বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত  জীবন-যাপন নয়, জীবনের অবশিষ্ট  সময় যেন কাটে এক দেহ এক প্রাণের অনুভূতি নিয়ে যেভাবে গোটা দুনিয়ার মুসলিমরা বার বার আল্লাহর ঘরকে তাওয়াফ করেছিলেন।

হে ইহরাম পরিধানকারী ভাই ও বোনেরা! যে লাব্বাইক ধ্বনি নিয়ে কাবার দুয়ারে এসেছিলেন, তারই প্রতিধ্বনি নিয়ে ফিরে যাবেন নিজ পরিবার ও সমাজের আপন অঙ্গনে। তারা যেন আপনাকে ভিন্ন এক পরিবর্তিত মানুষ হিসেবে দেখতে পায়-আকৃতিতে নয়, আচরণ ও ব্যবহারে যাকে তাঁর মহান রব একান্ত দয়ায় ক্ষমা করেছেন, যার আরাফা ও মুজদালিফার চোখের এক ফোঁটা পানিও বৃথা যায়নি শয়তানের প্রতি মিনায় দেখানো ঘৃণা হজ্জ ফেরত জীবনে যেন দস্তিতে রূপ না নেয়, একইরূপে মা হাজেরা ও তাঁর পরিবারের ত্যাগের দৃষ্টান্তও যেন গুরুত্বহীন না হয়, এমনই যত অনুভূতি ও স্বপ্ন সেদিনগুলোতে আপনাকে বারবার অশ্রুসিক্ত করেছিল, তা কি নিমেষেই ভুলে যাবেন? এসবই ছিল মহান রবের ক্ষমা আর নৈকট্যলাভের প্রার্থনার উপকরণ।                

সূরা কুরাইশরে মধ্যে কত স্পষ্টভাবেইনা বলা হয়েছে ‘যারা নিরাপত্তাহীন আর ক্ষুধায় কাতর তারা যেন এ ঘরের মালিকের ইবাদাত করে’। এই ঘরের মালিকের অন্যতম পরিচয় এটি মুসলিম সমাজের আজকের সবচেয়ে বড় সমস্যা-ই এ দু’টি। বর্তমান দুদিয়ার অধিকাংশ গৃহহীন উদ্বাস্তু মানুষগুলোর পরিচয় কী? তারা এই ঘরের মালিকের প্রতি কী যথাযথভাবে ঈমান এনেছে মনে হয়, আমরা এ ঘরের মালিকের আহবানে সাড়া দিতে পারিনি সেজন্য শুধু আফসোস করা বা প্রার্থনা নয়, বরং বাস্তবমুখি পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।  হজ্জ শেষে জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারার মধ্যেই সফলতা নিহিত রয়েছে নতুবা জীবনরূপী পরিষ্কার কাপড়টি আবার ময়লা ও অপবিত্র হওয়ার আশঙ্কা রয়ে যাবে। আমরা ভালো করেই জানি যে ইসলাম আমাদেরকে উপহার দিয়েছে একটি স্বভাবজাত জীবনবোধ, যেখানে রয়েছে অর্থপূর্ণ এক বিশ্বাস ও জ্ঞাননির্ভর কর্মময় জীবনের পথনির্দেশনা। আর সে পথ রেখার একমাত্র রোলমডেল হচ্ছেন, নবী মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাই আসুন! নতুন জীবনের শপথ হোক- দ্বীন শেখো না হয় শেখাও এর বাইরে তৃতীয় কোনো বিকল্প নেই।  আমীন।

ড. মীর মনজুর মাহমুদ