মহামারিকালে ঈদ-উল-আযহা

মহামারিকালে ঈদ-উল-আযহা

ফাইল ছবি

ড. মীর মনজুর মাহমুদ

গোটা দুনিয়ার মত আমাদের দেশও আজ বিপন্ন। মহামারি কোভিড-১৯ এর বিপর্যস্ত পরিস্থিতির মধ্যে সম্প্রতি বয়ে যাওয়া  আম্ফান এবং বর্তমানে বন্যা কবলিত দেশের দুই তৃতীয়াংশ মানুষ। এহেন পরিস্থিতিতেই আমাদের মাঝে আসছে পবিত্র ঈদ-উল-আযহা। এখন কি সম্ভব অথবা সঙ্গত ঈদেও আনন্দ পালন করা? এ প্রশ্নের সরল জবাব না। প্রকৃতপক্ষে, ইসলামের ঈদ মানে কেবল আনন্দ বুঝালেই কেবল তা সঠিক ছিল। কিন্তু ইসলামের এ মহান ধর্মীয়-সামাজিক উৎসবটি হলো একান্তভাবে আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া জ্ঞাপন করা, সুকঠিন হলেও তাঁর আদেশের কাছে নিঃশর্ত আনুগত্য প্রকাশ করা, আল্লাহর নৈকট্যলাভের চেষ্টা করা এবং প্রতিবেশি ও স্বজনসহ পিছিয়ে পড়া মানুষের দায়বদ্ধতা মেনে নেয়ার এক বাস্তবসম্মত কর্মসূচি। কুরবানীর ঈদ মুসলিমদেরকে ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে অধিকতর মানবিক হতে শেখায়। ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হতে শেখায়, ঊদারতা, সৌজন্য, পরপোকারি হতে শেখায়। এক নির্মল ও সার্বজনীন আনন্দধারা জীবনের একঘেয়েমি কাটিয়ে নতুনভাবে স্বপ্ন দেখতে শেখায়। এমনি আরো অনেক লক্ষ্যই রয়েছে ইসলামের এই মহান ইবাদাতের পেছনে। সুতরাং বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়ানোর প্রেরণা যেন আরো বৃদ্ধি পায়- সেই লক্ষ্যেই হোক এবারের ঈদ-উল-আযহা উদযাপন।   

একঘেয়েমি কাটিয়ে জীবনকে বৈচিত্রময়, আনন্দঘন ও অর্থবহ করতে এ ধারাবাহিকতার মধ্যে কিছূ ব্যতিক্রম প্রয়োজন হয়। আর সে বিষয়টিকে সামনে রেখেই ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় দু‘টি দিনকে ঈদ হিসাবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ইসলাম ফিতরাত বা স্বভাব ধর্ম হওয়ায় মানুষের জীবনের এই দিকটিকেও উপেক্ষা করেনি; বরং গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছে। ঈদ-উল-আযহা মুসলিম জীবনে এমনি একটি অন্যতম দিন। দেশ-কাল-পাত্রভেদে মুসলিম সমাজে এই দিনটি ধর্মীয়-সামাজিক উৎসবের দিন হিসাবে সূচনাকাল হতে অদ্যাবধি পালিত হয়ে আসছে। মূলত এটি একটি আত্ম-ত্যাগের উৎসব, নির্মল সামষ্টিক আনন্দ লাভ আর একে অন্যের সহমর্মী হওয়ার অপূর্ব সুযোগ, নিজ নিজ দায়িত্ব কর্তব্য পালন ও অধিকার প্রাপ্তির এক সার্বজনীন ব্যবস্থা। অন্যান্য জীবনাদর্শ হতে ইসলামের স্বাতন্ত্রতার এটি একটি অন্যতম দিক। ইসলাম এ উৎসবকে ঘিরে আনন্দকে শুধু তার অনুসারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেনি; বরং মুসলিম সমাজের অমুসলিম সদস্যদেরকেও শরীক করেছে। এখানে কেবল আনন্দ ভাগাভাগিই করা হয়নি, দেয়া হয়েছে সমাজের অসহায় ও দরিদ্রজনের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়ারও শাশ্বত ও চিরন্তন নির্দেশনা। সাথে সাথে এ দিনটি কাছের ও দূরের মুসলিম উম্মাহর সদস্যগণের মধ্যে একতা ও সংহতি প্রকাশের সেতুবন্ধক হিসাবে কাজ করে। প্রকারান্তরে এই উৎসব যেন মুসলিম উম্মাহকে তার অতীত ও ভবিষ্যতের সদস্যগণের মধ্যে এক যোগসূত্র এনে দিয়েছে। সে অর্থে এটি একটি সার্বজনীন ও কালোত্তীর্ণ উৎসবের রূপ লাভ করেছে। কালপরিক্রময়ায় দিনটি উদযাপনে স্থানভেদে সামান্যতম মৌলিক কোন পার্থক্য সৃষ্টি হয়নি, উদ্দেশ্য লক্ষ্য এক অভিন্ন রয়েছে- যা বাস্তবসম্মতও বটে।

ঈদ-উল-আযহার পরিচয়ঃ মুসলিম জীবনে অতি পরিচিত একটি ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব ঈদ-উল-আযহা। মুসলিম উম্মাহর দৈনন্দিন জীবনে সৃষ্ট পারস্পরিক ছোট-খাট ভুল, কলহ-বিবাদ ও অনৈক্য দূর করে এ আনন্দ উৎসব তাদের মাঝে ঐক্য ও সংহতি প্রকাশের একটি অন্যতম মাধ্যম। আমাদের দেশে এই ঈদকে কুরবাণীর ঈদ বা বকরা ঈদও বলা হয়। আরবীতে عيد الكبير বা বড় ঈদও বলা হয়। অন্যান্য মুসলিম দেশে এর কিছু স্থানীয় নাম রয়েছে।  আর عيد الأضحى এ দু‘টি আরবী শব্দ। عيد শব্দটির অর্থ পুনরাগমন, যা আমাদের মাঝে ঘুরে ঘুরে আসে। এখানে উৎসব অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। الأضحى কুরবানী। সুতরাং ঈদ-উল-আযহা অর্থ ত্যাগ ও কুরবানীর উৎসব-যা আমাদের মাঝে প্রতি বছর নির্ধারিত দিনে বা সময়ে ঘুরে ঘুরে আসে। মুসলিম উম্মাহ হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈল আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মহান ত্যাগ ও কুরবানীর নিদর্শন হিসাবে প্রতিবছর যিলহাজ্জ মাসের ১০ তারিখে হালাল পশু যবেহ ও দু‘রাকাত ওয়াজিব সালাত একত্রে আদায়ের মাধ্যমে যে আনন্দ উৎসব পালন করে থাকে, তাকেই ঈদ-উল-আযহা হিসাবে আমরা জানি। তাছাড়া হাদীসে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর বক্তব্যের আলোকে প্রত্যেক জুম‘আর দিনকেও ঈদ বলা হয়। রাসূলূল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে বাৎসরিক ঈদ হিসাবে দু‘টি দিন দিয়েছেন; ঈদ-উল-ফিতরের দিন এবং ঈদ-উল-আযহার দিন।  এ দিনে নির্মল আনন্দলাভের জন্য সুস্থ বিনোদনের অনুমতি রয়েছে। বস্তুত মুসলিম জাতির পিতা সাইয়্যেদুনা ইবরাহীম আ. আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশে একমাত্র পুত্রকে কুরবানী করার মতো যে মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, সে সুন্নাত যথাযথ মর্যদায় পালনার্থেই এই কুরবানীর ঈদ। কুরবানীকে আরবী ভাষায় ‘ঊযহিয়্যা’ বলা হয়। এর অর্থ ঐ পশু যা কুরবানীর দিন যবেহ করা হয়।

শরী‘আতের পরিভাষায়, আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টিলাভের নিমিত্তে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট পশু যবেহ করাকে কুরবানী বলা হয়। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কুরবানী কবিতায় এ ঈদ সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন, “ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদবোধন------।”

ঈদ-উল-আযহার প্রেক্ষাপট: ইসলামী শরী‘আর প্রতিটি নির্দেশের পিছনে মহান আল্লাহ মানুষের জন্য অপরিসীম কল্যাণ নিহিত রেখেছেন। সেটি কখনও ব্যক্তির জন্য অথবা ব্যক্তি ও সমষ্টি উভয়ের জন্য-এর ব্যাপ্তি দুনিয়া ও আখিরাতের সময়কাল পর্যন্ত। এ সকল কল্যাণের সবটুকু মানুষ তার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে সব সময় উপলব্ধি করতে পারে না। ইসলামী জীবন ব্যবস্থার ঠিক তেমনি একটি নির্দেশনা এই ঈদ-উল-আযহা। এটি ইসলামের ইতিহাসের একটি সুপ্রাচীন স্মৃতিবিজড়িত ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব, একটি অনন্য ইবাদত পালনের দিন। এই দিনের ইতিহাস সুবিদিত। প্রসঙ্গক্রমে সংক্ষেপে বলা যায়, হাজ্জ ও ঈদুল আযহার কুরবানী সাইয়্যেদুনা ইবরাহীম আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ত্যাগ ও কুরবানীর অনুসরণ। আজ হতে প্রায় ৪ হাজার বছর পূর্বে বর্তমান ইরাকের ‘উর’ নামক স্থানে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তৎকালীন সমাজ ও রাষ্ট্র এবং তাঁর পিতা ও পরিবার মূর্তিপূজাসহ সবধরনের শিরকে সরাসরি লিপ্ত থাকার পরও তিনি আল্লাহর নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে তাওহীদের সুমহান বাণী প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। সকলের বিরোধিতা, জীবননাশের হুমকি ও চরম প্রতিবন্ধকতার মুখে একপর্যায়ে  তিনি ফিলিস্তিনে হিজরাত করতে বাধ্য হন। আল্লাহর নবী ইবরাহীম আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিঃসন্তান দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করার পর বার্ধক্যে এসে, যখন তাঁর বয়স ৮৬ বা ৯০ বছরের কোটায়, তখন তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরার গর্ভে এক পুত্র সন্তান লাভ করেন। তাঁর এই প্রথম সন্তানের নাম রাখেন ইসমাঈল আলাইহি ওয়া সাল্লাম। অতঃপর বৃদ্ধ বয়সের এই সন্তানকে আল্লাহর নির্দেশে কুরবানী করতে উদ্যত হন। এ বিষয়ে কুরআন কারীমে বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে। আল্লাহ বলেন, “অতঃপর যখন তার ছেলে তার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলো তখন ইবরাহীম বলল, হে প্রিয় বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে আমি যবেহ করছি, অতএব দেখ তোমার কি অভিমত? পুত্রটি বলল, হে আমার পিতা, আপনাকে যে আদেশ করা হয়েছে, তা আপনি করুন। ইন শা আল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। অতঃপর যখন তারা উভয়েই আত্মসমর্পন করল এবং ইবরাহীম তার পুত্রকে কাত করে শুইয়ে দিল, তখন আমি তাকে আহবান করে বললাম, হে ইবরাহীম! তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ- এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয় এটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আর আমি তাকে মুক্ত করলাম এক মহান যবেহর বিনিময়ে।”

আমরা আগেই আলোচনা করেছি যে, এই দিনটি একদিকে যেমন একটি নির্মল আনন্দঘন, অপরদিকে তা একে অন্যের প্রতি দায়িত্ববোধ জাগরুক, আপন মহিমায় ভাস্বর। এই দু‘টি ধারা মিলেই এটি পবিত্ররূপ লাভ করেছে। রাসূলূল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় হিজরাতের পর মদীনাবাসিকে উৎসব পালনের নির্দেশনা প্রদানকালে। এর পর থেকেই এই দু‘টি উৎসব অদ্যাবধি মুসলিম দেশ ও সমাজে পালিত হয়ে আসছে। এই দিনটিকে ঘিরে আচরিত আচরণের ইতিহাস সুপ্রাচীন, ঐতিহ্যমন্ডিত ও মহিমান্বিত; অনাগতকালের সমগ্র মানবজাতির জন্য তা শিক্ষাপ্রদ ও কল্যাণকর; মুসলিম উম্মাহর মাঝে ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টির নিয়ামক। কিন্তু বাস্তব অবস্থা মুসলিম উম্মাহ আজ শতধাবিভক্ত। এই দু‘টি উৎসব প্রতি বছর আসে এবং চলে যায়। কথা ছিল এ থেকে তারা ত্যাগ ও কুরবাণীর মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হবে, মানবতার কল্যাণ কাজে নিজেদেরকে ব্যাপৃত করবে, পরস্পর ঐক্য ও সংহতির পথে সুদৃঢ় হবে। বাস্তব অবস্থা কী তা আমরা সকলেই অবহিত। আমরা অর্থে কেনা বা পালিত পশু জবেহ করে কুরবানী দিতে শিখেছি; কিন্তু মনের পশুটিকে জীবনে একটি বারও কুরবানী দিতে শিখিনি। সে কারণে কুরবানী করার প্রকৃত উপকার ব্যক্তি জীবনে দেখতে পাচ্ছি না। আর ইসলামের এ সুমহান শিক্ষা হতে দূরে অবস্থানের কারণেই তাদের আজকে এ পরিণতি। সুতরাং নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এই উম্মাহর মুক্তি ও কল্যাণ যে শিক্ষার মাধ্যমে এসেছিল; আমাদেরকে আবার সে দিকেই ফিরে যেতে হবে। সে বিশ্বাস ও শিক্ষাকে ধারণ করলেই আবার হৃত গৌরব ফিরে আসবে- ইতিহাস আমাদেরকে সে শিক্ষাই দেয়।   

আমাদের সমাজচিত্র: আবহমানকাল থেকে আমাদের দেশের মুসলিম সমাজে একই গতানুগতিকতায় পবিত্র ঈদ-উল-আযহা পালিত হয়ে আসছে। আমি এখানে গতানুগতিকতা বলতে দীনের বিশুদ্ধ নির্দেশনাকে পরিহারের কথা বলছি না; বরং এই নির্দেশনার বাইরেও কিছু বিদ‘আত ও দীন বহির্ভূত স্থানিক বা লোকজ আচরণকে বুঝাতে চেয়েছি- যা ইসলাম সম্মত নয়। এর প্রধান কারণ  ইসলামকে আমরা কুরআন ও হাদীস থেকে অধ্যয়ন বা জেনে বুঝে গ্রহণ করিনি। ভাগ্যবান মানুষ হিসাবে জন্মসূত্রে আমরা মুসলিম। স্বল্পশিক্ষিত মসজিদের ইমাম, অসচেতন আলিম, অনির্ভরযোগ্য ইসলামী গ্রন্থ থেকে সাধারণ শিক্ষিত মুসলমানেরা ইসলাম সম্পর্কে যা জেনেছে তার মধ্যে রয়ে গেছে অনেক বিভ্রান্তি। ফলে নানা রকম বিদ‘আতও প্রসার লাভ করেছে। যেমন, সামর্থবান ব্যক্তি কুরবানী নিজের পক্ষে আদায় না করে মৃত ব্যক্তির নামে দেয়া, পীর বা অন্যের নামে আদায় করা, পীরের দরবারে কুরবানী আদায়ের মধ্যে অতিরিক্ত ফজিলত চিন্তা-বিশ্বাস করা, কুরবানীর পশুর হাড় বা রক্তে কাপড় ভিজিয়ে রেখে তা রোগ মহামারীর হাত বাঁচার উপায় হিসাবে মনে করা, কুরবানীর পশুর মাথা যবেহকারীর জন্য নিদিষ্ট করা (মোল্লার জন্য কল্লা- অবশ্য এ প্রথাটি এখন বিলুপ্তির পথে), কুরবানীর পশু যবেহকালীন দাতার নাম ও তার পিতার নাম বিশেষভাবে উচ্চারণ করাকে বাধ্যতামূলক মনে করা, কুরবানীর গোশত বিতরনের ক্ষেত্রে দীনের প্রকৃত নির্দেশনা সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকা ইত্যাদি। তবে আমাদের সমাজের মুসলিম জীবনে এই দিনটি উদযাপনে গুরুত্ব ও উৎসাহবোধের সামান্যতম ঘাটতি কখনও দেখা দেয়নি। ইসলামী জীবনবিধান হতে নির্দেশিত এই উৎসব যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করলেও এর নির্দেশনাগুলোকে যাচাই করে দেখার সুযোগ আমরা খুব কমই পেয়েছে।

দীন সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং দীর্ঘদিন রাজনৈতিকভাবে পরাধীন জীবন যাপন করাটাও একটি বড় কারণ। তবে আশার দিক এটিই যে, আমাদের দেশের ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখকগণ বাংলাভাষায় গবেষণা কর্মসহ মূল্যবান গ্রন্থ রচনা ও অনুবাদের কাজ হাতে নিয়েছেন। তাঁদের কাজকে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে এসেছে, সরকারি ব্যবস্থাপনায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, বেসরকারিভাবে দেশের বেশকিছু প্রকাশনা সংস্থা বাংলা ভাষায় কুরআন-এর সরলানুবাদ, তাফসীর, হাদীস, ফিকহের মূল্যবান গ্রন্থসহ ইসলামী গ্রন্থ প্রকাশনায় প্রশংসাযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। এছাড়া প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া সরাসরি মূল্যবান ইসলামী অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা করে জাতিকে একদিকে যেমন কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করছে; সাথে সাথে নিজেদেরকে দীন প্রচারের কাজে নিয়োজিত করে আখিরাতের মহান সফলতালাভের পথকে সুগম করছে। একজন সাধারণ মুসলিম  হিসোবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকে উৎসাহিত করা নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করি।

আমাদের করণীয়: ইবাদত সম্পর্কে ইসলামের প্রথম নির্দেশনা হলো, রাসূলূল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে কাজ, যেভাবে, যখন করতে বলেছেন বা নিজে করেছেন, সে কাজকে হুবহু সেভাবেই করা। ইসলাম তার প্রতিটি নির্দেশকে অত্যন্ত স্পষ্ট এবং সহজ-সরলভাবে বর্ণনা দিয়েছে। ইসলামী জীবন বিধানে ইবাদতগুলোকে সরাসরি আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে- এখানে কোন মাধ্যমকে সামান্যতম অনুমোদন দেয়া হয়নি। আর মু‘আমালাত ও মু‘আশারাত-এর দিকগুলো বান্দাদের পারস্পরিক বলা হলেও এক্ষেত্রে যথাযথ দায়িত্ব কর্তব্য পালনের পুরস্কার এবং গাফলতি ও ব্যর্থতার হিসাব নিকাশ আল্লাহ তা‘আলা নিজ হাতে রেখেছেন। অর্থাৎ বিষয়গুলো জবাবদিহিমুক্ত নয়; বরং রয়েছে সুকঠিন দায়বদ্ধতা। ঈদ-উল-আযহার মত ধর্মীয়-সামাজিক আনন্দঘন উৎসব পালনকেন্দ্রিক সকল দায়িত্ব কর্তব্য পালন ও অধিকার নিশ্চিতকরণের বিষয়টি মোটেই গুরুত্বহীন নয়। আমাদের জাতীয় কবি তাঁর “বকরীদ” কবিতায় লিখেছেন, “তাহাদেরি শুধু আছে অধিকার ঈদগাহে ময়দানে, তাহারাই শুধু বকরীদ করে জান মাল কুরবানে”।

সামার্থবানদের জন্য ঈদুল আযহার অন্যতম প্রধান ইবাদত পশু কুরবানী করা। রাসূলূল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যার সাধ্য ছিল কুরবানী দেয়ার কিন্তু কুরবানী দিল না, সে যেন আমার ঈদগাহে উপস্থিত না হয়।”  “তিনি সাধারণত যখন কুরবানী দেয়ার ইচ্ছা করতেন তখন দুটি বিশাল বড় আকারের সুন্দর খাসী বা কাটান দেয়া পুরুষ ভেড়া ক্রয় করতেন। তাঁর উম্মাতের মধ্যে যারা তাওহীদের বা তাঁর রিসালাতের সাক্ষ্য দিয়েছে তাদের পক্ষ থেকে একটি কুরবানী করতেন এবং অন্যটি মুহাম্ম দ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানী করতেন।”  ত্রুটিহীন স্বাস্থ্যবান, সুন্দর ও ভাল পশু কুরবানী দেয়ার ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন। এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য হাদীসের সংশ্লিষ্ট অধ্যায় ও ফিকহার গ্রন্থগুলো জেনে নিতে পারি।

বর্তমান সময়ে এই উৎসবকে ঘিরে আমাদের কয়েকটি করণীয় নিম্নে তুলে ধরা হলোঃ

  • প্রতিবছর আগত ঈদ-উল-আযহাকে নিছক একটি উৎসব দিবস মনে না করে এর প্রকৃত শিক্ষা ও তাৎপর্য জানতে চেষ্টা করা এবং সে আলোকে জীবন গঠনে সচেষ্ট হওয়া
  • ইসলামী শরী‘আতের এই বিধানকে সরাসরি পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ হতে জানতে চেষ্টা করা এবং সে অনুযায়ী কাজ করা
  • সামর্থবানদের জন্য সমাজের দরিদ্র ও অসহায় লোকদের ঈদের আনন্দে শরীক করার বিষয়টিকে আরো অধিকতর বাস্তবসম্মতভাবে গুরুত্ব প্রদান করা
  • এই দিনকে ঘিরে সারা বছরের জন্যই অসহায় ও বঞ্চিতজনদের পাশে সামর্থবানদের দাঁড়ানোর মানসিকতা সৃষ্টির প্রয়াস চালানো
  • এই দিনে কুরবানীর গোশতকে গরীব ও অসহায়জনদের মাঝে আরো সুষ্ঠুভাবে বিতরণ করার আরো বাস্তবসম্মত উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
  • মহামারির কারণে শহরে কুরবানী দেয়া কঠিন হলে নিজের এলাকা বা সুবিধাজনক স্থানে তা আদায়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
  • সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঈদের সালাত ও কুরবানী আদায় ও বিতরণ করতে হবে।
  • বিপন্ন পরিবেশে মানুষের প্রয়োজন বেশি থাকায় এবারের কুরবানীর গোস্ত গরীবদের মাঝে অধিক পরিমাণে দেয়ার চিন্তা করতে হবে।
  • এবারের ঈদ ও কুরবানীতে আনন্দের চেয়ে দাবদ্ধতাকে প্রাধান্য দিতে হবে ইত্যাদি।

পরিশেষে বলা যায়, ঈদ-উল-আযহা আমাদের জীবনে আনন্দ উৎসবের সাথে সাথে ধর্মীয় অনুভূতি ও  দায়িত্ববোধ জাগরিত করে। সামষ্টিক জীবনে একে অন্যের প্রতি দায়িত্বশীল ও সহমর্মী হতে শেখায়। প্রাত্যহিক জীবনের একঘেয়েমী আর অবসাদ দূর করে নতুনভাবে উজ্জীবিত করে, প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পাওয়ার অপূর্ব সুযোগ এনে দেয়। আমাদের সমাজে এই দু‘টি উৎসবকে ঘিরে যে কর্মচাঞ্চল্য ও প্রথার সৃষ্টি হয়েছে, তা আমাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক উন্নয়ন, ধরে রাখা ও নিবিড় করার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বর্তমান সময়ের কর্মব্যস্ত মানুষেরা নানা ব্যস্ততাকে উপেক্ষা করে এ উৎসবে নিজ নিজ নাড়ীর টানে যেভাবে স্বজনদের কাছে ফিরে যায়, তার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মুসলিম সমাজেও খুঁজে পাওয়া কষ্ট- কালে কালে এটি আমাদের গৌরবময় ধর্মীয়-সামাজিক কৃষ্টিতে পরিণত হয়েছে। তবে এবারের বিষয়টি অবশ্যই ভিন্নতার দাবী রাখে। শুধু দেশে এই ছোট্ট গন্ডিতে নয়, এই বিশ্বায়নের যুগেও পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমাদের দেশের মানুষেরা এ দিনে স্বজনদের কাছে আসতে সামর্থের মধ্যে চেষ্টা করে থাকে। বিশেষ করে ঈদ-উল-আযহা আমাদেরকে সামাজিক দায়িত্ব পালনের সুযোগ অপেক্ষাকৃত বেশি করে এনে দেয়। তাই মুসলিম উম্মাহর জীবনে ঈদুল ফিতর ও আযহা তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।