স্তন ক্যান্সারের অপারেশন পরবর্তী ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা

স্তন ক্যান্সারের অপারেশন পরবর্তী ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা

মেহেরুন নেসা


সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও স্তন ক্যান্সারের রোগীর সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। ক্যান্সারকে অক্ষমতার একটি বড় কারণ হিসেবে ইতিমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে। স্তন ক্যান্সার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েদেরই হয়। পুরুষদেরও হয়, তবে তা বেশ বিরল। মহিলাদের মধ্যে প্রতি ৮জনের ১ জন স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে এবং ক্যান্সার আক্রান্ত মৃত্যুর প্রতি ৩৩ জনে ১ জন স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর মারা যায়। তাই স্তন ক্যান্সারকে মহিলাদের ক্যান্সার আক্রান্ত মৃত্যুর ২য় কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়। ২০১৮ সালে প্রায় ২.১ মিলিয়ন মহিলা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। পুরুষদের মধ্যে ক্যান্সার আক্রান্তদের প্রায় ১% স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় এবং ক্যান্সার সংক্রান্ত মৃত্যুর ০.২% মৃত্যু হয় স্তন ক্যান্সারে।

বাংলাদেশের অধিকাংশ মহিলাদের শেষ ধাপে স্তন ক্যান্সার শনাক্ত হয়। যদি প্রাথমিক পর্যায়ে তা শনাক্ত করা সম্ভব হয়, তবে প্রায় ৯৮% মহিলা স্তন ক্যান্সারের মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাবে।

মহিলাদের স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা হিসেবে বেশ কিছু অপারেশনের প্রয়োজন হয়। তার মধ্যে স্তন বায়োপসি, লিম্ফোক্টোমি, মাস্টেক্টোমি,লিম্ফ নোড অপসারণএবং স্তন পুনর্গঠন অন্যতম।এসব অপারেসনের প্রত্যেকটির কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে, যেমন- ব্যথা, জয়েন্ট শক্ত হয়ে যাওয়া, লিম্ফইডিমা বা ফুলে যাওয়া ইত্যাদি। এসব সমস্যার কারণে কাঁধ ও হাতের মাধ্যমে প্রতিদিনের কাজকর্ম যেমন- কাপড় পরা, গোসল করা, চুল আছরানো ইত্যাদি করতে অনেক কষ্ট হয়। তা ছাড়া ব্যথা ও জয়েন্ট শক্ত হবার কা্রণে আশে-পাশের মাংসপেশিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে এবং মাংসপেশির নড়ারচড়া অনেক কমে যায়। ‘

অপারেশনের পর খুব কম রোগীই আছে যারা অপারেশন পরবর্তী  চিকিৎসার জন্য ফিজিওথেরাপিষ্টের কাছে যায়। কিন্তু স্তন ক্যান্সারের অপারেশনের পর থেকে রেডিও থেরাপি নেওয়ার আগ পর্যন্ত ফিজিওথেরাপি অত্যাবশ্যক চিকিৎসা। স্তন ক্যান্সার অপারেশনের জন্য যে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয় সেগুলো কমিয়ে সংশ্লিষ্ট অঙ্গকে ফিট করে রেডিও থেরাপির জন্য প্রস্তুত করাই ফিজিওথেরাপির কাজ।

ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার উদ্দেশ্যঃ ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে অপারেশনের জায়গায় ব্যথা কমানো, ঘাড়, বুক, হাত ও কাঁধের জয়েন্টগুলোকে জড়তা মুক্ত করা, রেঞ্জ অব মোশন বাড়ানো, অবস্বাদ দূর করা, শ্বসন তন্ত্র ও হৃদযন্ত্রের ফিটনেস বাড়ানো এবং শরীরের পজিশন ঠিক রাখা হয়। এ সব কাজ বিভিন্ন ধরনের ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা কৌশলের সমন্বয়ে করা হয়। যেমন-

ক।চেষ্ট ফিজিওথেরাপিঃ  স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত মহিলাদের শ্বসন তন্ত্র ও হৃদপিণ্ডর কার্যক্ষমতা বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের ব্রিদিং ব্যয়াম যেমন- স্পাইরোমেট্রিক ব্যয়াম, ডিপ ব্রিদিং  ব্যয়াম খুবই কার্যকরী। এসব ব্যয়ামের মাধ্যমে শ্বসনতন্ত্রের জটিলতা অনেকাংশে কমানো সম্ভব।

খ।মাইয়োফেসিয়াল রিলিজঃ স্তন ক্যান্সার অপারেশনের পরে অপারেসনের আশেপাশের জায়গা যেমন- বুকের প্রাচীর, কাঁধ ও হাতের মাংসপেশি শক্ত হয়ে যাওয়া, অল্পতেই প্রচণ্ড ব্যথা ইত্যাদি সমস্যা তৈরি হয়। মাইয়োফেসিয়াল রিলিজ ও সফট টিস্যু মবিলাইজেশনের মাধ্যমে একজন ফিজিওথেরাপিস্ট এ ধরণের কষ্ট কমাতে সাহায্য করে।



গ।লিম্ফেটিক ড্রেনেজ ম্যাসাজঃ  এটি এক ধরনের বিশেষ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা পদ্ধতি যার মাধ্যমে  অপারেশন সংশ্লিষ্ট ও আশেপাশের জায়গা যেমন- হাত, কাঁধ ইত্যাদি ফুলে যাওয়া কমানো হয় এবং সংশ্লিষ্ট অঙ্গগুলোর নাড়াচাড়া বৃদ্ধি করা হয়।

ঘ।স্ট্রেচিং ও বলকারক ব্যয়ামঃ  অপারেশনের ফলে অনেক সময় মাংসপেশি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং দৈর্ঘ্যে ছোট হয়ে যায়। একজন ফিজিওথেরাপিষ্ট রোগীর ফিটনেস লেভেল অনুসারে বিভিন্ন ধরনের স্ট্রেচিং ও বলকারক ব্যয়ামের গাইডলাইন দিয়ে থাকেন। এই ধরনের ব্যয়াম অবশ্যই অপারেশনের ৪-৬ সপ্তাহ পর শুরু করতে হবে এবং প্রথম দিকে মাঝারি মাত্রা ও পরে আস্তে আস্তে মাত্রা বাড়াতে হবে। কখনোই এ ধরনের ব্যয়াম ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া করা উচিৎ নয়। এতে করে অবস্থা আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। 

১) সরু লাঠি ব্যয়ামঃ ম্যাটের উপর হাঁটু ভাঁজ করে সোজা হয়ে শুয়ে পড়ুন। এবার একটি লম্বা সরু লাঠি দুই হাত দিয়ে মুঠ করে পেট বরাবর ধরুন। এবার লাঠিটি উপরে উঠিয়ে যত টুকু সম্ভব মাথা বরাবর নেওয়ার চেষ্টা করুন। ৫ সেকেন্ড থামুন। এবার লাঠিটি আবার পেট বরাবর নিন। এভাবে ৫-৭ বার করুন। এই ব্যয়ামের ফলে কাধের সামনের দিকের চলাচলের ক্ষমতা বাড়বে।

২) এলবো উইঙ্গিংঃ ম্যাটের উপর হাঁটু ভাঁজ করে সোজা চিত হয়ে শুয়ে পড়ুন। এবার হাত দুটো ঘাড়ের পিছনে রেখে কনুই দুটি সিলিং বরাবর নিয়ে আসুন। ৫ সেকেন্ড ধরে রাখুন। ছেড়ে দিন। এভাবে ৫-৭ বার করুন। 
৩) সোল্ডার স্ট্রেচঃ দেয়ালের কাছে সোজা হয়ে দাড়ান ( দেয়াল থেকে পায়ের আঙ্গুলের দূরত্ব ৮-১০ইঞ্চি)   দুই হাত দেয়ালে রাখুন। এবার ২ হাতের আঙুল দিয়ে দেয়াল ঘেষে আস্তে আস্তে যতটূকূ সম্ভব হাত উপরে উঠান। এই অবস্থায় দেয়ালে ধাক্কা দিন। এবার হাত দুটো আস্তে আস্তে নিচে নামান। এভাবে ৫-৭ বার করুন।

ব্যয়ামের সময় যদি কোনো সমস্যা হয়, তাহলে অবশ্যই আপনার ফিজিওথেরাপিস্টকে তা জানাতে হবে।

মেহেরুন নেসা : ফিজিওথেরাপি ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।