গণতান্ত্রিক সরকারের মূলশক্তি জনগণ

গণতান্ত্রিক সরকারের মূলশক্তি জনগণ

জিসান তাসফিক

জিসান তাসফিক


‘গণতন্ত্র’ আমাদের সমাজে অতিপরিচিত একটি শব্দ। শব্দটি আমাদের খুবই প্রিয় কারণ এই শব্দের মাঝে আমরা আমাদের স্বাধীনতা খুজে পাই এবং পাই মত প্রকাশের অধিকারও। গণতান্ত্রিক সরকারের মূল শক্তি জনগণই। কিন্তু এগুলো কতটুকু সত্য আর বাস্তবতা? বাস্তবে কি আসলে গণতন্ত্র আছে নাকি এটি শুধুমাত্র আমাদের জন্য ব্যবহারিত শব্দ ?

গণতন্ত্রের ( Democracy ) উৎপত্তি: প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ক্লিসথেনিসের নতুন ধরনের সরকার চালু হয় এবং সেই সঙ্গে বিশ্বের প্রথম গণতন্ত্র সৃষ্টি হয় গ্রিসের ছোট একটি শহর-রাষ্ট্র এথেন্স (উইকিপিডিয়া)। ১৫ জুন ১২১৫ সালে সামন্তদের ( ভূস্বামী বা ব্যারন নামেও পরিচিত) ইংল্যান্ড এর রাজা জন এই চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হন। যার নাম ম্যাগনাকার্টা। এই চুক্তির উপর ভিত্তি করেই পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূত্রপাত ও আইনের শাসনের ভিত্তি রচিত হয়। বলা হয়ে থাকে এটি শাসনতন্ত্রের বাইবেল এবং ইংল্যান্ডের প্রথম শাসনতন্ত্র। 

তবে আধুনিক গণতন্ত্রের জনক জন লক। তিনিই প্রথম সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা বলেছেন। যেখানে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হবে এবং জনপ্রতিনিধিরা সরকার পরিচালনা করবে। এর পূর্বে পৃথিবীতে সরকার ব্যবস্থা ছিল রাজতন্ত্র। সেখানে জনগণের মতামতের কোনো মূল্য ছিল না। কিন্তু গণতন্ত্রে জনগণের মতামতের মূল্যায়ন সবথেকে বেশি হয় এবং  এই জন্য গণতন্ত্র নিয়ে বিখ্যাত সংঙ্গা দিয়েছেন সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকন তা হল Democracy is a government of the people, by the people and for the people, অর্থাৎ গণতন্ত্র হল জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের শাসন।
 
কোনো দেশে গণতন্ত্র আছে তা বোঝা যাবে ঐ দেশের সংবিধান ও সরকার ব্যবস্থা দেখে। সংবিধান একটি রাষ্ট্র চালানোর মূল নিয়মকানুন আর সেই সংবিধান ও এর অনুগত আইন অনুযায়ী ঐ রাষ্ট্রের সরকারব্যবস্থা চালিত হয়। পৃথিবীতে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা দুই ধরনের আছে রাষ্ট্রপতি শাসিত (USA) আর একটি মন্ত্রীপরিষদ শাসিত (ব্রিটেন)।
তবে উভয় সরকারই জনপ্রতিনিধি পরিষদের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। আর এই জনপ্রতিনিধি পরিষদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই কক্ষ বিশিষ্ট একটি কংগ্রেস আর অন্যটি সিনেট। তবে আমাদের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের এক কক্ষ বিশিষ্ট যার নাম জাতীয় সংসদ।  তিনশো পঞ্চাশ আসন বিশিষ্ট। তিনশত আসনের সংসদ সদস্যগণ সরাসরি জনগনের ভোটে নির্বাচিত হন এবং এই নির্বাচনের জন্য আছে আলাদা সাংবিধানিক সংস্থা যার নাম বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন।
 
বাংলাদেশের সংবিধান সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক সংবিধান। বাংলাদেশের সরকার কিভাবে চলবে তা সংসদ সদস্যদের মতামত ও ভোটের মাধ্যমে হয়। সংখ্যা গরিষ্ঠতার ভিত্তিতে তা আইন হিসেবে পাশ হয় জাতীয় সংসদে । এরপরে বাংলাদেশের নির্বাহী বিভাগ তা বাস্তবায়ন করে এবং বাস্তবায়নে ত্রুটিবিচ্যুতি হলে বিচার বিভাগে তার বিচারকার্য হয়। শুধুমাত্র এতে গণতন্ত্র আসে না এর সাথেও  আমাদের দেখতে হয় সরকার জনগনের জন্য তাদের দায়িত্ব কতটুকু বাস্তবায়ন করছে?

আমাদের দেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকারের কথা বলা আছে যেগুলো সাংবিধানিক অধিকার। সংবিধানের ২৬ থেকে ৪৪ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত একথা বলা আছে। এই সকল অধিকার বাস্তবায়ন করা সরকার দায়িত্ব আর কর্তব্য। সংসদ নির্বাচনের পূর্বে জনপ্রতিনিধিগণ জনগনের সাথে অঙ্গীকার করে তারপরে ভোটে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। এগুলো বাস্তবায়ন করে অন্যথায় পরবর্তীকালে নির্বাচনে জনগনের ভোট হারিয়ে হেরে যায়। আসলে এখানে জনগনের প্রকৃত ক্ষমতা আসে। 
এছাড়া একটি সরকার ব্যবস্থা চলে আপামর জনগনের প্রদত্ত রাজস্ব আয়ের উপর। গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় জনগন যেমন সরকার তৈরি করে তেমনি বিভিন্ন ভাবে রাজস্ব দিয়ে উক্ত সরকার পরিচালনা করে। 

গণতন্ত্রের তত্ত্বীয় আর ব্যবহারিক বিষয় এক নয়। পাঠ্যপুস্তকে লেখা আর বাস্তবতা ভিন্ন। পৃথিবীতে গণতন্ত্র একদিনের আর সহজে আসেনি। পূর্বে রাজতন্ত্র ছিল, পরবর্তীকালে রাষ্ট্রের জনগন অত্যাচারী রাজাদের শোষিত থেকে মুক্তির জন্য গণতান্ত্রির সরকার ব্যবস্থায় আসে। গণতন্ত্র এসেই যে জনগনের দুঃখকষ্টদূর করে দিয়েছে তা কিন্তু না। পূর্বের অবস্থা থেকে অনেক ভালো অবস্থায় এসেছে। 

আমাদের দেশের কয়েকশ বছর পূর্বে রাজতন্ত্র ছিল। ইংরেজিদের কাছে ১৭৫৭ সালে হেরে তারপরে ইংরেজি শাসনে চলে যায়। ঠিক একশ বছর পরে ভারত শাসন আইন হয়ে গণতান্ত্রিক ধারা শুরু হয়। কিন্তু ইংরেজরাতো আমাদের কাছে ভিনদেশি। পরবর্তীতে আর নানা আন্দোলন ও ত্যাগের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হয়। কিন্তু এরপরেও আমাদের দেশে গণতন্ত্র আসে নি। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর জন্য গণতান্ত্রিক সরকার আসে নি। বরং বাঙালি দমানোর জন্য সামরিক শাসন এসেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। এর পরে প্রথম যে সংববিধান তৈরি হয় সেটিই ছিল বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের লিখিত দলিল বা প্রমাণ। তারপরে আবার এই দেশের জনগন শাসকদের কাছে ধাক্কা খেয়েছে। গণতন্ত্র হারিয়েছে আবার আন্দোলনের মাধ্যমে উদ্ধার করেছে। বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতাকামী  তাই গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা এই দেশে অত্যন্ত প্রিয়।

আমাদের দেশের মানুষ এখনও সচেতন নয়। বাংলাদেশের সাংবিধানিক ভাবে অনুচ্ছেদ ১৭ তে বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক শিক্ষার কথা বলা আছে। যে পর্যন্ত শিক্ষাগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে তাতে করে ১৮ বছর বয়সী যে কেউ নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার বিবেক বুদ্ধি আসে।

কিন্তু এমনও হয় যে অনেকে ভোট দেয় না। ভোট না দিলে গণতন্ত্র আসে না আর গণতান্ত্রিক সরকার অচল হয়ে যায়। যা প্রকৃতপক্ষে আমাদেরই ক্ষতির কারণ। আর শুধুমাত্র ভোট দিয়ে সরকার তৈরি করে দিলে জনগনের দায়িত্ব শেষ হয় না। জনগনকেও সরকারকে সাহায্য ও সহযোগিতা করতে হয়। সেটা ব্যক্তিগত ভাবে কিংবা সম্মিলিতভাবে।
জনগনকে যেমন ভোট দিতে হয় তেমনি রাজস্ব দিতে হয় তেমনই সরকারের কাজগুলো দেখা উচিত সহযোগিতা করা উচিত নিজের মতামত প্রকাশ করা উচিত। আমার বিশ্বাস এভাবেই একদিন পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ গণতন্ত্র চর্চা আমাদের এই বাংলাদেশে হবে। 

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।