খেয়ালী নজরুল

খেয়ালী নজরুল

কাজী নজরুল ইসলাম

খালেদ ইকবাল-

কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) বাংলাদেশের জাতীয় কবি। অসম্ভব খেয়ালী ও দূরন্ত স্বভাবের ছিলেন তিনি। তাঁর স্বভাবের বর্ণনা পাওয়া যায় ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়। আপনভোলা এই কবি কারো আমন্ত্রন ফিরিয়ে দিতেন না। সেকারনে অনেক সময় একজনের নিমন্ত্রন রক্ষা করতে অন্যেরটা ভুলে যেতেন। 

১৯৩০ সালের দিকে বহরমপুরে এক যুব-সম্মেলনে তাঁর উপস্থিতি নিয়ে ঘটে এমনিই এক ঘটনা। সম্মেলনের আয়োজক ছিলেন বহরমপুরেরই কবি বিজয়লাল চ্যাটার্জি। কবি নজরুল সেই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করবেন বলে ঠিক হয়েছে। সকাল সাতটায় সাংবাদিক মোহাম্মাদ মোদ্দাবের ও  বিজয়লাল, কবির মধুরার লেনের বাড়ীতে হাজির হলেন। কবিকে সঙ্গে নিয়ে বহরামপুরে রওনা হবেন। আগে থেকেই এই বন্দোবস্ত করা ছিল। কবি তাদের হাঁকডাকে বিছানা ছেড়ে উঠলেন, তৈরীও হতে লাগলেন। তারাও তাড়া দিতে লাগলেন যাতে তাড়াতাড়ি রওনা দেওয়া যায়। কারণ কবিকে বের না করা পর্যন্ত বিশ্বাস নেই। যদি অন্য কেউ এসে পড়ে, আর কবি তার সঙ্গে জমে যান, তাহলে তাদের সব অনুষ্ঠান পণ্ড হয়ে যাবে। কবি দোতলা থেকে চিৎকার করতে করতে নেমে এলেন, চল চল বড্ড দেরি হয়ে গ্যাছে, ট্রেন পাবো-তো, যেন কত দায়িত্বশীল ব্যাক্তি! বিজয়লাল কবির পোটলাপুটলি ট্যাক্সিতে চাপাচ্ছেন, এমন সময় পাতলা দোহারা চেহরার এক ভদ্রলোক বগলদাবায় একটা ছোট পুটলি নিয়ে হাজির হলেন। 

কবি হাইপাই করে চিৎকার করে তাকে জড়িয়ে ধরে পরম অন্তরঙ্গতায় অর্ভ্যতনা জানালেন। কবি বিজয়লাল এবার যেন বেশ বিরক্ত হয়ে উঠলেন। মোদ্দাবেরের কানে কানে বললেন, বিপদের কালো মেঘ উঠেছে রে! আর রক্ষা নেই। মোদ্দাবের তখন লোকটিকে চিনতেন না। বিজয় বললেন, উনি ঢাকার একজন অধ্যাপক। নামকরা দাবাড়ে। দেখছিস না ব্গোলে দাবার যন্ত্রপাতি। 

কবি ঢাকাই অধ্যাপককে বাড়িতে থাকতে বলে আমাদের সঙ্গে রওনা হতে যাচ্ছেন, কিন্ত অতিথী ছাড়বার পাত্র নন। তিনি কবির একখানি হাত ধরে অনুনয় করলেন, তিনি মাত্র একদান খেলতে চান।

কবি অগত্যা বসে গেলেন। বিজয়লাল ও মোদ্দাবের প্রমদ গুনলেন। কবি তাদের অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, তোমরা ট্রেনে চলে যাও। আমি ১১ টার ট্রেনে রওনা হয়ে ঠিক সময়েই সভায় পৌছে যাবো। এমনভাবে কথাগুলো বললেন যে, তারা বিশ্বাস না করে পারলেন না। 

বিজয়লালের কিন্তু মুখ কালো হয়ে গেল। ট্রেনের টিকেটটা কবির হাতে দিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা শিয়ালদা স্টেশনে উপস্তিত হলেন। দু’জনে বহরমপুর স্টেশনে নেমে দেখেন সে এক এলাহী কাণ্ডকারখানা। কবি নজরুল আসবেন বলে যেন সারা মুল্লকের লোক ভেঙ্গে পড়েছে বহরমপুর শহরে। কত নেতা ও উপনেতারা কবিকে অভ্যর্থনা জানাবার জন স্টেশনে হাজির। কিন্তু কবি কোথায়? বিজয়লাল ট্রেন থেকে নেমে জানিয়ে দিলেন যে, কবি পরের ট্রেনে আসছেন। কথাটা শুনে জনতা বিরক্ত হলেও আশাহত হয়নি। সভাস্থলের জনসুমুদ্র দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত অসীম র্ধৈয্যের সঙ্গে অপেক্ষা করছে। পরের ট্রেন আসার সময় হল। বহুলোকের সঙ্গে বিজয়রাল ও মোদাব্বের স্টেশনে গেলেন। ট্রেন এল, কিন্তু কোথায় কবি? 

ট্রেনের কামরা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কবির পাত্তা পাওয়া গেল না। মোদ্দাবেরের গলা শুকিয়ে কাঠ, বিজয়লাল প্লাটফরমের মেঝেতে ধপ করে বসে পড়লেন। নৈরাশ্যের ধাক্কা একটু সামলিয়ে নিয়ে বিজয়লাল স্থানীয় নেতা ও কর্মীদের নিকট সব অবস্থা বর্ণনা করে মোদাব্বেরকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতাগামী ট্রেনে উঠে পড়লেন।   

গাড়ি চলতে শুরু করলে পর বিজয়লালের মুখ দিয়ে কথা ফুটলো, ইস! প্রান নিয়ে ফিরতে পেরেছি এই ঢের। সভাস্থলে থাকলে আমার মাথাটা আর কাধের উপর থাকতো না। একটু দম নিয়ে তিনি  বললেন, যাই কলকাতায় আগে, তারপর দেখবো, কাজীর এক দিন না আমার একদিন।

রাত প্রায় সাড়ে এগারটায় দুজনের ট্যাস্কি কবির দরজায় থামলো। ঘরের মধ্যে ঢুকতেই কানে এল বাজখাই আওয়্জা: এবার তোমার রাজা সামলাও বন্ধু, এই-এ। 

বিজয়লাল ও মোদ্দাবেরকে দেখে কবির চীৎকার উল্লাস থেমে গেল। বিজয়লালের চোখের পানে তাকিয়ে কবি যেন সন্ত্রস্ত হলেন। তারপর ছাদ ফাটানো হাসিতে ফেটে পড়ে বিজয়লালকে জড়িয়ে ধরে বললেন, কিছু মনে করিসনে ভাই, বড্ড বিপদে পড়েছিলাম। ও তিন তিন বার আমার কিস্তিমাত করে দিয়েছে। আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়েছিলাম আজ।

এমন সময় কবিপ প্রমীলা নজরুল ঘরে ঢুকে হাসতে হাসতে বললেন, আজ ওঁরা খেতে পর্যন্ত ওঠেনি । তারপর তোমাদের ভাগ্যে কিছু জুটেছে নাকি? 

-কি জুটবে? বিজয়লাল জিঙ্গাসা করে। 

-কেন, জনতার প্রহার।    

 - না, সে সুযোগ দেইনি, পালিয়ে বেঁচেছি।

বিজয়লাল এরপর অনেককাল আর বহরমপুরমুখো হননি।