আপনার প্রতিবেশী

আপনার প্রতিবেশী

প্রতিবেশীর সাথে ভালো ব্যবহার করাকে ইসলাম বেশি গুরুত্ব ও প্রাধান্য দিয়ে থাকে


প্রতিবেশীরা সদাচরণ ও সহৃদয় ব্যবহার পাওয়ার অধিকার রাখেন। এ কথাটা সুপ্রতিষ্ঠিত। সব ধর্মই এ বিষয়ে উৎসাহ দিয়ে থাকে। আর এটা বিশ্বের সব সমাজে স্বীকৃত। সম্ভবত অত্যধিক বস্তুবাদী ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী কিছু সমাজ এ দিক দিয়ে ব্যতিক্রম।
যা-ই হোক, প্রতিবেশীর সাথে ভালো ব্যবহার করাকে ইসলাম বেশি গুরুত্ব ও প্রাধান্য দিয়ে থাকে। আল-কুরআন স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে, প্রতিবেশী আত্মীয় হোক বা না হোক, দয়া ও সহানুভূতি তাদের প্রাপ্য।
‘কেবল আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাঁর সাথে কাউকে শরিক করো না। তোমার মাতা-পিতা, নিকটাত্মীয়, ইয়াতিম, দুস্থ, যে পড়শি তোমার নিকটবর্তী আর যে পড়শি অপরিচিত, তোমার পার্শ্ববর্তী বন্ধু, মুসাফির এবং তোমার ডান হাতের আওতাধীন যারা, তাদের প্রতি সদয় হও। যারা উদ্ধত ও অহঙ্কারী, তাদের আল্লাহ ভালোবাসেন না (সূরা আন নিসা আয়াত-৩৬)।
প্রতিবেশীদের দেখাশোনা করতে রাসূলুল্লাহ সা: তাঁর সাহাবি এবং সব যুগের সব মুসলিমের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, প্রতিবেশীর যখনই সাহায্যের প্রয়োজন হবে তখনই সাহায্য করার জন্য তৈরি থাকতেÑ এমনকি যদি সে প্রতিবেশীও সাহায্য চায়, যার আচরণ মোটেও সুপ্রতিবেশীসুলভ নয়।
আল্লাহতায়ালার সর্বশেষ রাসূল হিসেবে হজরত মুহাম্মদ সা: মক্কায় চরম প্রতিকূল পরিবেশে ১৩ বছর বাস করেছিলেন। তাঁর প্রতিবেশীদের কয়েকজন তাঁকে কষ্ট দেয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। তারা এমন সব অপকৌশল অবলম্বন করেছে, যেগুলো দ্বারা সর্বাধিক ধৈর্যশীল মানুষও হয়রানি ও অপমানের শিকার হতে বাধ্য ছিলেন।
তবুও নবী করীম সা: ভালো কিছু ছাড়া অন্যভাবে এমন মন্দ আচরণের জবাব দেননি। প্রতিবেশীরা বার বার তাঁর ঘরের দরজায় ময়লা-আবর্জনা ছুড়ে মারলে বিরক্ত হয়ে তিনি বড়জোর যা করেছিলেন, তা হলোÑ এই প্রশ্ন : ‘এটা প্রতিবেশীর কেমন আচরণ?’
যখন রাসূল মুহাম্মদ সা: মদিনায় হিজরত করলেন, তিনি তাঁর অনুসারীদের মাঝে বন্ধন জোরদার করতে চাইলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইসলামি জনগোষ্ঠী শক্তি ও সংখ্যায় দিন দিন বেড়ে চলেছিল। প্রতিবেশীসুলভ সর্বোত্তম সম্পর্ক বজায় রাখতে তিনি আহ্বান জানালেন তাঁর অনুসারীদের প্রতি। প্রতিবেশীর জন্য সহানুভূতিকে তিনি গণ্য করতেন দৃঢ় ঈমানের একটি নিদর্শন হিসেবে।
এ প্রেক্ষাপটেই বলা যায়, যদি কেউ তার প্রতিবেশীর দারিদ্র্য সম্পর্কে সচেতন থেকেও তাকে সাহায্য করে না, তাকে প্রকৃত ঈমানদার বলা যায় না। হজরত মুহাম্মদ সা: বলেছেন, প্রতিবেশীদের প্রতি দয়ার্দ্র হতে জিবরাঈল আ: আমাকে অব্যাহতভাবে এত তাগিদ দিয়ে যাচ্ছিল যে, আমি ভাবতে শুরু করলামÑ সে আমাকে বলবে, আপনার সম্পত্তিতেও তাদের অধিকার রয়েছে (মুসলিম)।
রাসূলুল্লাহ সা: আরো বলেছেন, যে কেউ আল্লাহর প্রতি এবং শেষ বিচারের দিনের ব্যাপারে ঈমান রাখে, সে অবশ্যই যেন তার প্রতিবেশীর মনে আঘাত না দেয় (বুখারী)।
এটা বলার দরকার পড়ে না যে, একজন প্রতিবেশী যত ঘনিষ্ঠ হবেন, আমাদের সহমর্মিতা তার প্রাপ্য তত বেশি। হজরত আয়েশা রা: রাসূল মুহাম্মদ সা:কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর নবী! আমার আছেন দু’জন প্রতিবেশী। তাঁদের মধ্যে কাকে আমি উপহার দেবো?’ তিনি জবাব দিলেন, তোমার ঘরের সাথেই যার ঘর, তাকে (বুখারী)।
আসলেই নিকটতম প্রতিবেশীরা খুবই অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়লে  তাদের এমনকি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের ওপর অগ্রাধিকার দেয়া যায়। রাসূলুল্লাহ সা:-এর প্রিয় কন্যা হজরত ফাতিমা রা: এবং তাঁর স্বামী হজরত আলী রা: তাঁদের একজন চাকর দিতে তাঁকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কয়েকজন ক্রীতদাস রাসূল সা:-এর কাছে আনা হয়েছিল। তখনই এই অনুরোধ করা হয়। কিন্তু তিনি এতে রাজি হননি। কারণ, মসজিদের পাশের বাসিন্দারা ক্ষুধার কষ্ট পাচ্ছিলেন এসব গরিব মানুষ মদিনায় ছিলেন বহিরাগত। তারা এখানে এসেছিলেন নিঃসম্বল অবস্থায়; আর সহজে কাজও পাচ্ছিলেন না। তারা মসজিদের পাশে অবস্থান করছিলেন। রাসূল সা: তাদের দেখাশোনা করতেন। 
তারা পরিচিত ছিলেন ‘আস সুফ্ফাহ’ নামে। তাদের সংখ্যায় কমবেশি হতো। কারণ, তাদের কয়েকজন কাজ পেয়ে মদিনায় একটি বাড়িতে গিয়ে থাকতে লাগলেন। অপর দিকে নবাগতরা মুসলিম জনগোষ্ঠীতে যোগ দিলেন এবং একই সাথে সুফ্ফাহর সংখ্যা বাড়িয়ে দিলেন। যখন হজরত মুহাম্মদ সা: কোনো খাদ্যসামগ্রী পেতেন উপঢৌকন হিসেবে, তিনি এর থেকে কিছুটা খেয়ে বাকি সবটুকু তাদের জন্য পাঠিয়ে দিতেন। আর এমন উপঢৌকন যদি হতো দানের বিষয়, তা হলে মহানবী সা:-এর পুরোটাই আস সুফ্ফাহর কাছে পাঠাতেন। কেননা, একজন নবী হিসেবে তাঁর নিজের কিংবা তাঁর পরিবারের জন্য দান গ্রহণ করা বৈধ ছিল না। 
রাসূলুল্লাহ সা:-এর অন্যতম সাহাবি হজরত আবু হুরাইরাহ রা: সুফ্ফাহর একজন। তিনি বলেছেন, সেই আল্লাহর কসম যিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, মাঝে মাঝে আমি এত বেশি ক্ষুধার্ত থাকতাম যে, পেটটা মেঝের দিকে দিয়ে শুয়ে পড়তাম কিংবা পেটে পাথর বেঁধে রাখতাম, যাতে ক্ষুধার যন্ত্রণা থেকে বাঁচা যায়। এক দিন আমি বসা ছিলাম পথের ধারে। সে পথ দিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে দেখে মুচকি হাসলেন। আমার চাহনি দেখে তিনি বুঝতে পারলেন, তখন কেমন অনুভব করছিলাম। তিনি আমাকে ডাকলেন। বললাম, হে আল্লাহর রাসূল সা:, আমি আপনার খেদমতে প্রস্তুত। তিনি আমাকে বললেন তাঁকে অনুসরণ করে পিছু পিছু যেতে। তিনি নিজের ঘরে না পৌঁছা পর্যন্ত তাঁকে অনুসরণ করেছিলাম। এর পর আমাকে ঘরে ঢোকালেন। তিনি দেখতে পেলেন, একটি কাপে কিছু দুধ আছে। জিজ্ঞেস করলেন, এই দুধ কোথা থেকে এসেছে। জানানো হলো, এক ব্যক্তি উপঢৌকনস্বরূপ এটা দিয়েছেন। রাসূল সা: আমাকে বললেন, ‘আস্ সুফফাহ’র লোকজনের কাছে যাও এবং তাদের এখানে আসতে দাওয়াত দাও। একে তো আমি বিরক্ত হলাম ভাবলাম : এই সামান্য দুধে আস্ সুফফাহর এতগুলো মানুষের কী হবে? আমি একা খেলে তা আমার শক্তি ফিরে পাওয়ার মতো পর্যাপ্ত হতো। কিন্তু এখন যদি তারা আসেন, সবাইকে এই দুধ পরিবেশন করতে হবে। ছোট কাপটিতে তখন আর কী দুধ বাকি থাকবে আমার জন্য? তবুও আমার উপায় ছিল না আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূল সা:-এর আদেশ না মেনে। আমি সুফফাহর কাছে গেলাম এবং আমন্ত্রণ জানালাম। তারা আসলেন, রাসূল সা: তাদের ঘরে ঢোকালেন। তারা বসলেন। রাসূল সা: আমাকে বললেন, ‘এই দুধ নাও, আর এটা তাদের দাও পান করার জন্য।’ আমি দুধের কাপটি তুলে নিলাম। সেটা দিলাম একজনকে। তিনি তার চাহিদা পূরণ করে খেয়ে কাপটি আমাকে ফেরত দিলেন। আমি এবার দিলাম তার পরের ব্যক্তিকে। তিনিও যথারীতি দুধ পান করে নিলেন। এভাবে চলতে থাকে,  যতক্ষণ না সবাই তৃপ্তির সাথে দুধ পান করলেন। এর পর রাসূল সা:-এর কাছে গেলাম। তিনি কাপটি নিয়ে তাঁর হাতের ওপর রাখলেন; আমার দিকে তাকালেন আর হাসলেন। বললেন, ‘আবু হুরাইরাহ! কেবল তুমি ও আমি বাকি আছি।’ আমি বললাম, ‘এটাই ঠিক, আল্লাহর রাসূল সা: বললেন, ‘পান করো।’ তা-ই করলাম। তিনি আবার বললেন, ‘পান করো।’ আমিও করলাম। তিনি দুধ পান করার জন্য আমাকে বলতে থাকেন, যে পর্যন্ত না আমি বললাম : তাঁর কসম যিনি আপনাকে পাঠিয়েছেন সত্যের বাণীসহকারে। আমি আর দুধ পান করতে পারছি না। রাসূল সা: বললেন, ‘আমাকে একটু দাও।’ তাঁকে কাপ দিলাম। তিনি আল্লাহর প্রশংসা করে বললেন, ‘বিসমিল্লাহ’ তার পর অবশিষ্ট দুধ পান করে নিলেন (বুখারী)।
মহানবী সা: বহুবার খুব সামান্য খাদ্য বা পানীয়  বিপুলসংখ্যক মানুষের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন। এ ঘটনা সেগুলোর একটি মাত্র। মুসলমানরা বিশ্বাস করে, তাঁর এই অতুলনীয় গুণের কারণে আল্লাহতায়ালা খাদ্য ও পানীয় বরকত দিয়েছেন। ফলে তা সবার জন্য যথেষ্ট বলে প্রমাণিত হয়েছে। 


লেখক : আল ফুরকান হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক। ইংল্যান্ডের লেইস্টারের মার্কফিল্ড ইনস্টিটিউট অব হায়ার এডুকেশনের শিক্ষক। বিবিসিতে কয়েক বছর কাজ করার পর বিখ্যাত আরবি পত্রিকা আশ শারক আল আওসাতে কর্মরত ছিলেন। ইংরেজি দৈনিক আরব নিউজের নিয়মিত কলামিস্ট। প্রখ্যাত মনীষী শহীদ সাইয়েদ কুতুবের তাফসির ‘ফি যিলালিল কুরআন’-এর কয়েক খণ্ডের ইংরেজি অনুবাদক ও গ্রন্থকার।