রাসূল (সা.) এর দাওয়াতী জীবন : মুসলিম উম্মাহর করণীয়

রাসূল (সা.) এর দাওয়াতী জীবন : মুসলিম উম্মাহর করণীয়

ফাইল ছবি

শিশুকাল থেকেই  মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন একজন ব্যতিক্রম বালক। কথা-বার্তা, চাল-চলন, আচার-ব্যবহারে তিনি উত্তম আদর্শবান হিসেবে গড়ে উঠেছিলেন। ছোট বেলায় তাঁর দাদা বড় বড় মজলিসে মুহাম্মদ (সা.) কে নিজ চাদরের উপর বসাতেন। আরবের কুরাইশ নেতাদের সামনে তাঁকে সাইয়েদ বা নেতা বলে ডাকতেন। (ইব্ন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া) এ ছাড়া যখন তিনি হালিমা সাদিয়ার ঘরে লালির-পালিত হচ্ছিলেন তখন তিনি অন্যান্য বালকদের মত কথা না বলে শুদ্ধ আরবি ভাষায় কথা বলতেন। ইসলাম আগমনের পূর্বে আরেব যে র্শিক ও মূর্তি পূজার প্রচলন ছিল, সে সময়েও রাসূল (সা.) তাওহীদের প্রতি বিশ্বাসের ক্ষেত্রে দৃঢ়তা অবলম্বন করেন। তিনি কখনো কোন মূর্তির সামনে মাথানত করেননি, মূর্তির নামে পশু যবেহ করেননি এবং যবেহকৃত পশুর গোশতও তিনি কোনদিন ভক্ষণ করেননি। আল্লাহ রাব্বুল আ‘লামীন তাঁকে এসব কাজ থেকে হিফাজত করেছেন।

হযরত মুহাম্মদ (সা.) ৪০ বছর বয়সে নবুওয়াত লাভ করেন। হযরত জিবরাঈল (আ.) নবী করীম (সা.) কে নবুওয়াতের সুসংবাদ প্রদান করেন। হেরাগুহায় থাকা কালীন একদিন জিবরাইল (আ.) এসে বললেন, اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ  خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ  اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ  الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ  عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ  “পড়–ন আপনার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্তপিন্ড থেকে। পড়–ন, আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানতো না।” (সূরা আল-আলাক-১-৫)
এরপর রাসূল (সা.) ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ফিরে গেলেন। খাদীজাকে ডেকে বললেন, আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও, আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও। তিনি খাদীজার নিকট পুরো ঘটনা বর্ণনা করলেন এবং নিজের জীবন নিয়ে আশঙ্কার কথা বললেন। খাদীজা (রা.) তাকে সান্তনা দিয়ে বললেন, كَلَّا وَاللَّهِ مَا يُخْزِيكَ اللَّهُ أَبَدًا إِنَّكَ لَتَصِلُ الرَّحِمَ وَتَحْمِلُ الْكَلَّ وَتَكْسِبُ الْمَعْدُومَ وَتَقْرِي الضَّيْفَ وَتُعِينُ عَلَى نَوَائِبِ الْحَقِّ   “না, তা কখনও হতে পারে না। আল্লাহর কসম! তিনি আপনাকে লাঞ্চিত, অপমানিত করবেন না। আপনি আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ়কারী, গরীব-দুঃখীর সাহায্য-সহযোগিতাকারী, অতিথীপরায়ন ও মানুষের বিপদে-আপদে সাহায্যকারী।” (সহীহ আল-বুখারী) এর পরে সূরা আল-মুদ্দাচ্ছিরের প্রাথমিক আয়াতগুলো অবতীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে রাসূল (সা.) দাওয়াতী কাজ শুরু করেন। নিম্নে রাসূল (সা.) এর দাওয়াতী কাজের একটা চিত্র তুলে ধরা হলোঃ

রাসূল (সা.) এর দা‘ওয়াতী কাজকে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়। (ক) ইসলামী দা‘ওয়াতের প্রস্তুতি ও দা‘ওয়াতের সূচনা, (খ) গোপনে ইসলামের দা‘ওয়াত, (গ) প্রকাশ্যে ইসলামের দা‘ওয়াত। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

(ক) ইসলামী দা‘ওয়াতের প্রস্তুতি ও দা‘ওয়াতের সূচনা :
নৈতিকতার প্রশিক্ষণ ও চারিত্র গঠন :
আল্লাহ রাব্বুল আ‘লামীন প্রথম থেকেই রাসূল (সা.) কে দা‘ওয়াতের উপযোগী করে গড়ে তুলতে উত্তম চরিত্র গঠনের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। রাসূল (সা.) এ সম্পর্কে বলেন,  أدَّبَنيِْ رَبِّيْ فَأَحْسَنَ تأَدِيْبِيْ “আল্লাহ আমাকে উত্তম শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছেন।” (সা’বিল আদ-দা‘ওয়াহ) আল-কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী বোঝা যায়, তিনি চরিত্রের সর্বোত্তম স্থানে পৌঁছেছিলেন। আল্লাহ বলেন, وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ “আপনি সর্বোচ্চ চরিত্রের অধিকারী।”(সূরা আল-কলম-৪) এভাবে আল্লাহ তাঁকে দৈহিক, মানুসিক, আধ্যাত্মিক ও নৈতিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরী করেন। নবুওয়াতের পূর্বে মক্কার কোন অশ্লীল কাজে তিনি কোনদিন অংশগ্রহণ করেননি।

জ্ঞান অন্নেষণের নির্দেশ :
ওহী নাযিলের পূর্বে তিনি আল্লাহর নৈকট্যলাভ ও আনুগত্য করার জন্য কঠোর চেষ্টা করতেন। আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী তিনি নিজেকে প্রস্তুত করেছেন। তিনি যখন মায়া-মমতা, ভালবাসা, বীরত্ব, ধৈর্য, কষ্ট ও পরিশ্রমসহ সকল গুণের অধিকারী হয়েছিলেন, তখন আল্লাহ তাঁর নিকট প্রথম ওহী নাযিল করে বললেন, اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ   “পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা আল-আলাক-১-২) এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (সা.) কে পড়া ও জ্ঞান শিক্ষার প্রতি আহবান করেছেন। এ ওহীর কারণে তাঁর মনের জড়তা দূর হয় এবং এর মাধ্যমে তিনি মানসিক শক্তি অর্জন করেন।

রাত্রি জাগরণের নির্দেশ :
আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (সা.) কে দা‘ওয়াতী কাজের উপযোগী করে গড়ে তুলতে রাত্রি জাগরণের নির্দেশ দিয়েছেন। আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, يَا أَيُّهَا الْمُزَّمِّلُ  قُمِ اللَّيْلَ إِلَّا قَلِيلًا  نِصْفَهُ أَوِ انْقُصْ مِنْهُ قَلِيلًا  أَوْ زِدْ عَلَيْهِ وَرَتِّلِ الْقُرْآَنَ تَرْتِيلًا  إِنَّا سَنُلْقِي عَلَيْكَ قَوْلًا ثَقِيلًا  “হে চাদর আবৃত! রাতে সালাতে দাঁড়াও কিছু অংশ ছাড়া। রাতের অর্ধেক কিংবা তার চেয়ে কিছুটা কম। অথবা তার চেয়ে একটু বাড়াও। আর স্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে কুরআন আবৃত্তি কর। নিশ্চয় আমি তোমার প্রতি এক অতিভারী বাণী নাযিল করছি।” (সূরা মুজ্জাম্মিল- ১-৫)
এ আয়াতে রাতের কিছু অংশে জাগ্রত হয়ে আল্লাহর ইবাদত করতে ও কুরআন অধ্যয়ন করতে বলা হয়েছে। এটা এ জন্য যে, আপনাকে দা‘ওয়াতের যে বিরাট কাজে নিয়োগ করা হয়েছে তার জন্য আল্লাহর সহযোগিতা কামনা করুন। আর এ রাত্রি জাগরণের ফলে আত্মা হবে পবিত্র, শক্তিশালী এবং আপনার শরীর হয়ে উঠবে পরিশ্রম উপযোগী। আর আপনি আল্লাহর নিকট থেকে সব ধরণের পুরস্কার লাভ করতে পারবেন। (রসূল (সা.) এর দা‘ওয়াতের পদ্ধতি ও মাধ্যম )

ইসলামী দা‘ওয়াতের সূচনা :
রাসূল (সা.) পূর্ণ এক বছর রাতের পুরো অংশ অথবা আংশিক ইবাদাতে কাটাতে লাগলেন। এমনি এক সময়ে আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (সা.) এর উপর ওহী অবতীর্ণ করে বলেন, يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ (১) قُمْ فَأَنْذِرْ (২) وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ (৩) وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ (৪) وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ (৫) وَلَا تَمْنُنْ تَسْتَكْثِرُ (৬) وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ (৭) “হে বস্ত্রাবৃত! উঠ, অতঃপর সতর্ক কর। আর তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর। আর তোমার পোশাকÑপরিচ্ছদ পবিত্র কর। আর অপবিত্রতা বর্জন কর। আর অধিক পাওয়ার আশায় দান করো না। আর তোমার রবের জন্যই ধৈর্যধারণ কর।” (সূরা আল-মুদ্দাচ্ছির-১-৭)
উপরোক্ত আয়াত অবতীর্ণের মাধ্যমে রাসূল (সা.) কে দা‘ওয়াতী কাজ করার নির্দেশ প্রদান করা হলো এবং সাথে সাথে ইসলামী সমাজ বিনির্মানের জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করার কথাও বলে দেওয়া হলো। তাহলো (ক) মন ও হৃদয়কে পবিত্র করা, (খ) অপবিত্রতা বর্জন করা, (গ) প্রতিদান পাওয়ার আশায় কাউকে কিছু দান না করা, (ঙ) সকল কাজ একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে করা, (চ) দা‘ওয়াতী ক্ষেত্রে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও কাছে সাহায্য না চাওয়া এবং এ কাজে সর্বোত্তম ধৈর্যের নীতি অবলম্বন করা। রাসূল (সা.) এই দাওয়াতী মিশন থেকে মুসলিম উম্মাহ ও দায়ী ইলাল্লাহদের জন্য শিক্ষা হচ্ছে, পৃথিবী যতদিন থাকবে ততদিন উপরোক্ত পদ্ধতিতে ইসলামী দাওয়াতের কাজ করে যেতে হবে।

(খ) ইসলামী দা‘ওয়াতের দ্বিতীয় পর্যায় :
গোপনে ইসলামের দা‘ওয়াত :
আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে রাসূল (সা.) ইসলামী দা‘ওয়াতের কাজ শুরু করলেন। তিনি সর্ব প্রথম সবচেয়ে নিকট আত্মীয়দের কাছে দা‘ওয়াত দেওয়ার টার্গেট নির্ধারণ করলেন। সে মোতাবেক প্রথমে তিনি তাঁর স্ত্রী খাদিজা (রা.) কে দা‘ওয়াত দেন, তিনি এ দা‘ওয়াত কবুল করে সর্ব প্রথম মুসলমান হলেন।

এরপর রাসূল (সা.) তাঁর নিকটতম ব্যক্তিদের মধ্যে আলী (রা.) ও স্বীয় গোলাম যায়েদ বিন হারেছাকে দা‘ওয়াত দেন। তখন আলীর বয়স ছিল দশ ও যায়েদের বয়স ছিল পনের বছর। এভাবে রাসূল (সা.) প্রথমে পরিবারের মাঝে দা‘ওয়াতী কাজ করেন।
এরপর রাসূল (সা.) সিদ্ধান্ত নিলেন, জাহেলী সমাজে যারা চরিত্রবান এবং তাঁর সবচেয়ে নিকটতম বন্ধু তাঁকে দা‘ওয়াত দিবেন। আবু বকর (রা.) ছিলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। তিনি তাঁকে দা‘ওয়াত দিলেন। আবু বকর (রা.) দা‘ওয়াত কবুল করলেন এবং বললেন, আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোক, আপনি সত্যবাদী। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, ‘আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল।’
আবু বকর (রা.) ইসলাম কবুল করার পর বললেন, আমার কাছে এমন এক ব্যক্তির সন্ধান আছে যে ইসলামের এই দাওয়াত গ্রহণ করবে। রাসূল (সা.) বললেন, আমাকে তার কাছে নিয়ে চলো। আবু বকর (রা.) আরকাম ইবনে আরকামের বাড়ীতে নিয়ে গেলেন। তাকে বলা হলো, “হে আরকাম ইবনে আরকাম বল আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই।” আরকাম ইবনে আরকাম জবাবে বললেন,اَشْهَدُ اَنْ لاَ اِلَهَ اِلاَّ اللهَ وَ اَشْهَدُ اَنَّ مُحَمَّدً عَبْدُهُ وَ رَسُوْلُهُ صَدَّقْتَ ياَ مُحَمَّدْ بْنِ عَبْدُ ألله  “হে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ (সা.) আপনি সত্য বলেছেন। আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং আরো স্বাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল।”

 

নবী করীম (সা.) বলেন, “আবু বকর ছিলেন তৎকালীন সমাজে একজন গণ্যমান্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তি।” ঈমান আনার পর তিনি সমাজের এমন কিছু ব্যক্তিবর্গকে দা‘ওয়াতের জন্য বেছে নেন যাদের উপর তার দৃঢ় আস্থা ও বিশ্বাস ছিল। যখন তিনি তাদেরকে দা‘ওয়াত দেন তারা সকলে সে দা‘ওয়াত গ্রহণ করেন। (রসূল (সা.) এর দা‘ওয়াতের পদ্ধতি ও মাধ্যম)
রাসূল (সা.) তিন বছর গোপনে দাওয়াতী কাজ করলেন। এভাবে গোপন দা‘ওয়াতে যারা ইসলাম কবুল করেন তাদের সংখ্যা ছিল ৬০ জন। যার মধ্যে ১২জন মহিলা এবং ১৪জন গোলাম ছিল। (তারিখ আদ-দা‘ওয়াহ আল-ইসলামিয়্যাহ)  

 

(গ) ইসলামী দা‘ওয়াতের তৃতীয় পর্যায় :
প্রকাশ্যে ইসলামের দা‘ওয়াত :
গোপনে ৩ বছর দা‘ওয়াতে সর্বমোট ৬০জন ইসলাম গ্রহণ করে। এভাবে রাসূল (সা.) দিপ্ত কদমে দা‘ওয়াতী কাজ করে যাচ্ছিলেন। এমন সময় আল্লাহ তা‘আলা প্রকাশ্যে দা‘ওয়াত দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ “সুতরাং তোমাকে যে আদেশ দেয়া হয়েছে, তা ব্যাপকভাবে প্রকাশ্যে প্রচার কর এবং মুশরিকদের পরোয়া করো না।” (সূরা আল-হিজর-৯৪)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ  وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ  فَإِنْ عَصَوْكَ فَقُلْ إِنِّي بَرِيءٌ مِمَّا تَعْمَلُونَ “আর তুমি তোমার নিকটাত্মীয়দেরকে সতর্ক কর। আর মু’মিনদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করে, তাদের প্রতি তুমি তোমার বাহুকে অবনত কর। তারপর যদি তারা তোমার অবাধ্য হয়, তাহলে বল, তোমরা যা কর, নিশ্চয় আমি তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।” (সূরা আশ-শূ’আরা- ২১৪-২১৬)

এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর রাসূল (সা.) প্রকাশ্যে তাঁর দা‘ওয়াতী কাজ শুরু করেন। হযরত আলী (রা.) বলেন, এ সময় রাসূল (সা.) আমাকে ডাকলেন এবং বললেন, আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন ভয় প্রদর্শনের জন্য। অতঃপর আমি তা থেকে চুপ থাকি। তারপর জিবরাঈল আসলেন এবং বললেন, হে মুহাম্মদ! তোমাকে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তুমি যদি তা পালন না কর তাহলে তোমাকে শাস্তি দেওয়া হবে। (দালায়েল ওয়ান-নবুওয়াহ )
আল-কুরআনেও এভাবে কঠিনভাষায় রাসূল (সা.) কে দাওয়াতী কাজের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন,
وَإِنْ كَانَ كَبُرَ عَلَيْكَ إِعْرَاضُهُمْ فَإِنِ اسْتَطَعْتَ أَنْ تَبْتَغِيَ نَفَقًا فِي الْأَرْضِ أَوْ سُلَّمًا فِي السَّمَاءِ فَتَأْتِيَهُمْ بِآيَةٍ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَجَمَعَهُمْ عَلَى الْهُدَى فَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْجَاهِلِينَ
“আর যদি তাদের উপেক্ষা তোমার উপর কঠিন মনে হয়, তাহলে যদি তুমি পার যমীনে কোন সুড়ঙ্গ অথবা আসমানে কোন সিঁড়ি অনুসন্ধান করতে, অতঃপর তাদের কাছে কোন নিদর্শন নিয়ে আসতে (তবে কর)। যদি আল্লাহ চাইতেন তিনি অবশ্যই তাদেরকে হিদায়াতের উপর একত্র করতেন। সুতরাং তুমি কখনো মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।” (সূরা আল-আনআম-৩৫) রাসূল (সা.) প্রকাশ্যে দাওয়াতী কাজে নিম্নোক্ত পদ্ধতি অপলম্বন করেন।

 

ভোজ সভার আয়োজন করে দা‘ওয়াতী কাজ :
ইসলামের দা‘ওয়াত প্রদানের জন্য রাসূল (সা.) হযরত আলী (রা.) কে ভোজ সভার আয়োজন করতে বললেন। হযরত আলী (রা.) বলেন, আমি রাসূল (সা.) এর কথা মত ভোজের আয়োজন করলাম এবং সকলকে একত্রিত করলাম। তারা ছিল মোট ৪০ জন। তাদের মধ্যে রাসূল (সা.) এর চাচা আবু তালিব, হামযা, আব্বাস, আবু লাহাব, ও অন্যান্যরা ছিলেন। হযরত আলী (রা.) খাবার পরিবেশন করলেন। তারপর রাসূল (সা.) বললেন, হে আব্দুল মুত্তালিবের বংশধর, আমি আপনাদের জন্য ইহকাল ও পরকালের এমন কল্যাণ নিয়ে আগমন করেছি, যা আরবের কোন ব্যক্তি তার স্বজাতির জন্য কোনদিন আনয়ন করেনি। আমি আপনাদেরকে সে কল্যাণের দিকে আহবান জানাচ্ছি। সত্যের এ আহবানে কে সাথী হবেন আসুন। পথ প্রদর্শক তার সঙ্গীদের সাথে কখনো মিথ্যা বলে না। আল্লাহর শপথ, যদি সকল লোক মিথ্যা কথা বলে আমি আপনাদের নিকট মিথ্যা বলব না। যদি সকল লোক ধোঁকা দেয় আমি আপনাদের ধোঁকা দিব না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং আমি বিশেষভাবে আপনাদের ও সকল মানুষের নিকট আল্লাহর রাসূল হিসেবে মনোনীত। আল্লাহর শপথ যেভাবে তোমরা নিদ্রা যাও সেভাবে মৃত্যুবরণ করবে। যেভাবে তোমরা নিদ্রা থেকে উঠ সেভাবে কবর থেকে জাগ্রত হবে। তোমরা যে কাজই করো না কেন আল্লাহর কাছে তার হিসাব দিতে হবে। ভাল কাজের জন্য ভাল পুরস্কার মন্দ কাজের জন্য মন্দ পুরস্কার পাবে। মনে রেখ, বেহেশত চিরস্থায়ী দোযখও চিরস্থায়ী। আল্লাহর শপথ, হে আব্দুল মুত্তালিবের বংশধর! আমি তোমাদের নিকট যে উত্তম জিনিস নিয়ে এসেছি, আমার জানা মতে জাতির মধ্যে কোন যুবক তা নিয়ে আসেনি। আমি দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ নিয়ে এসেছি। তাঁর কথা শুনে সকলে একটু নরম সুরে কথা বললো। কিন্তু আবু লাহাব বললো, চলো সে আমাদেরকে ধ্বংস করে দিবে। (আদ-দা‘ওয়াহ আল-ইসলামিয়্যাহ ফি আহদে আল-মক্কী )

 

সাফা পাহাড়ে একত্রিত করে দা‘ওয়াত প্রদান :
একদিন রাসূল (সা.) সকাল বেলা সাফা পাহাড়ের চূড়ায় দাড়িয়ে উচ্চস্বরে বললেন, يَا صَبَاحَاهْ  ‘হে প্রভাত কালের বিপদ!’ এ কথা বলে তিনি মক্কার প্রতিটি গোত্রের নাম ধরে ডাকতে লাগলেন। রাসূল (সা.) এর আওয়াজ শুনে সকল বংশের লোকেরা ঘর থেকে বের হয়ে আসল। যে নিজে আসতে পারে নাই সে খবরের জন্য অন্যকে পাঠালো। সকলে উপস্থিত হলে রাসূল (সা.) বললেন, أَرَأَيْتُمْ لَوْ أَخْبَرْتُكُمْ أَنَّ الْعَدُوَّ يُصَبِّحُكُمْ أَوْ يُمَسِّيكُمْ أَمَا كُنْتُمْ تُصَدِّقُونِي قَالُوا بَلَى قَالَ فَإِنِّي نَذِيرٌ لَكُمْ بَيْنَ يَدَيْ عَذَابٍ شَدِيدٍ  “আমি যদি বলি যে, এ পাহাড়ের অপর পাশে এক বিরাট শত্রুবাহিনী রয়েছে তারা তোমাদের উপর এখনই আক্রমন করবে। তাহলে কি তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করবে? সকলে জবাব দিল, আমাদের জানা মতে তুমি কখনো মিথ্যা কথা বলনি। তখন রাসূল (সা.) বললেন, আল্লাহর আযাব আসার পূর্বে আমি তোমাদের সাবধান করে দিচ্ছি. তোমরা সে আযাব থেকে বাঁচার চেষ্টা কর।” (সহীহ আল-বুখারী)
এ কথা শুনে রাসূল (সা.) এর চাচা আবু লাহাব ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠলো, تَبًّا لَكَ أَلِهَذَا جَمَعْتَنَا “তোমার সর্বনাশ হোক, এ জন্যই কি আমাদেরকে একত্রিত করেছ?” এর পরই আল্লাহ তা‘আলা সূরা লাহাব অবতীর্ণ করে বলেন, تَبَّتْ يَدَا أَبِي لَهَبٍ وَتَبَّ  مَا أَغْنَى عَنْهُ مَالُهُ وَمَا كَسَبَ  سَيَصْلَى نَارًا ذَاتَ لَهَبٍ  وَامْرَأَتُهُ “ধ্বংস হোক আবূ লাহাবের দু’হাত এবং সে নিজেও ধ্বংস হোক। তার ধন-সম্পদ এবং যা সে অর্জন করেছে তা তার কাজে আসবে না। অচিরেই সে দগ্ধ হবে লেলিহান আগুনে। আর তার স্ত্রীও যে ইন্ধন বহনকারী।” (সূরা লাহাব, আয়াত- ১-৪) আবু লাহাব শেষ পর্যন্ত মারাত্মক প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করে। (ইব্ন হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী )

 

চাচা আবু তালিবকে ইসলামের দা‘ওয়াত প্রদান :
রাসূল (সা.) এর পর চাচা আবু তালিবকে ইসলামের দা‘ওয়াত দেন। আবু তালিব যখন রাসূল (সা.) কে জিজ্ঞেস করলেন, হে মুহাম্মদ! তুমি কি দ্বীন পালন করছ? রাসূল (সা.) জবাব দিলেন, চাচা এটা আল্লাহর, তাঁর ফিরিশতার, তাঁর রাসূল ও ইবরাহীমের দ্বীন। আল্লাহ আমাকে রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছেন। হে চাচা, আপনি আমাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন। সুতরাং আমি মনে করি, এ দ্বীন প্রথমে আপনাকে গ্রহণ করা উচিত। তখন আবু তালিব বললেন, হে ভাতিজা আমি কখনো বাপ-দাদাদের ধর্ম ত্যাগ করতে পারব না। তবে তোমাকে কেউ কষ্ট দিবে সেটা সহ্য করব না। (ইবনে হিশাম, সীরাতুন-নবুবীয়া) এভাবে রাসূল (সা.) শত বাধা-বিপত্তিকে উপেক্ষা করে আল্লাহর দ্বীনের দা‘ওয়াতী কাজ অব্যাহত রাখেন। তিনি রাত-দিন গোপনে-প্রকাশ্যে ইসলামী দা‘ওয়াতের কাজে লিপ্ত থাকতেন।

 

(ঘ) মক্কার পাশ্ববর্তী এলাকায় ইসলামের দা‘ওয়াত :
হজ্জের মৌসুমে ইসলামের দা‘ওয়াত :
মক্কার কা’বা ঘর বিশ্বের মানুষের কাছে যুগ যুগ ধরে অত্যন্ত সম্মানিত হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আ.) এর অনুসারী হিসেবে পৃথিবীর সকল এলাকা থেকে মক্কার এ ঘর তাওয়াফ করতে আসত। ইসলামের আগমনের পূর্বেও এ ঘর ছিল ধর্মীয় ও সাহিত্য উৎসবের কেন্দ্রবৃন্দ। হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর যুগেও মক্কার উকায, মাজনা, জিমেযায উৎসবে যে কবিতার আসর বসতো সেখানে রাসূল (সা.) ইসলামের দা‘ওয়াত দিতেন। তিনি প্রত্যেক গোত্রের লোকদেরকে আহবান করে বলতেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ قُولُوا لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ تُفْلِحُوا “হে মানুষ সকল বলো, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই তাহলে তোমরা সফলকাম হবে।” (মুসনাদ আহমদ ইব্ন হাম্বল )  
রাসূল (সা.) যখন বিভিন্ন গোত্র ও বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বলতেন, আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর ইবাদাত করতে বলেছেন এবং তাঁর সাথে কারো শরীক করতে নিষেধ করেছেন। তখন আবু লাহাব এসে বলতো, হে মানুষ এ ব্যক্তি তোমাদেরকে তোমাদের পিতৃপুরুষদের ধর্মমত ত্যাগ করতে বলছে। (রসূল (সা.) এর দা‘ওয়াতের পদ্ধতি ও মাধ্যম )
রাসূল (সা.) মিনা, আকাবাসহ মক্কার সকল স্থানে সমাগত লোকদের মাঝে গমন করে ইসলামের দা‘ওয়াত প্রদান করেন। হজ্জের মওসুমে রাসূল (সা.) এর সাথে হযরত আবু বকর (রা.), হযরত আলী (রা.) ও তাঁর চাচা আব্বাস (রা.) উপস্থিত থাকতেন। তারা রাসূল (সা.) এর দা‘ওয়াতের সময় বিভিন্ন বংশের লোকদের সাথে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিতেন। এ সময় মক্কার যুবকগণ সমাগত গোত্রের লোকদের নিকট গিয়ে বলতো, তোমরা এ লোকের কোন কথা গ্রহণ করবে না। সে আমাদের পিতৃপুরুষদের ধর্মের বিরোধিতা করছে। সে আসলে একজন গণক। তার কাজ আমাদের মধ্যে পিতা-পুত্রে বিরোধ ও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করা। (ইবনে হিশাম, সীরাতুন-নবুবীয়া )

তায়েফে ইসলামের দা‘ওয়াত :
মক্কায় দা‘ওয়াতী কাজে আশানুরূপ ফল না পেয়ে রাসূল (সা.) তায়েফ গমন করেন। সেখানে তিনি বনু সাকীফ গোত্রের নেতৃস্থানীয় তিন ভাইকে দা‘ওয়াত দেন। তারা হলো, আব্দে ইয়ালীন, মাদউদ এবং হাবীব। তারা রাসূল (সা.) এর দা‘ওয়াত প্রত্যাখ্যান করলো এবং তায়েফের যুবক, গোলাম ও দুষ্ট লোকদেরকে মুহাম্মদ (সা.) এর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিলো। তারা নানা ভাষায় গালা-গালি করতে করতে তাঁর পিছু পিছু ছুটলো। রাস্তার দু’পাশ থেকে পাথর নিয়ে মারতে মারতে ক্ষত-বিক্ষত করলো। রাসূল (সা.) এর পবিত্র চরণযুগল থেকে রক্ত প্রবাহিত হতে লাগলো। তিনি বসে পড়লে তাঁর দু’বাহু ধরে আবার উঠিয়ে দেয়া হত। শেষ পর্যন্ত রাসূল (সা.) তায়েফ থেকে তিন মাইল দূরে পথের পাশে একটি খেজুর বাগানে আশ্রয় নেন। যে বাগানের মালিক ছিল উতবা ও সাইবা। তারা উভয়ে তখন বাগানে অবস্থান করছিল। রাসূল (সা.) এর এ অবস্থা দেখে তাদের ক্রীতদাস আদ্দাসকে ডেকে কিছু আঙ্গুর নিয়ে রাসূল (সা.) এর কাছে পাঠালেন। তিনি আঙ্গুর হাতে নিয়ে বিসমিল্লাহ বলে খেতে শুরু করেন। (ইবনে হিশাম, সীরাতুন-নবুবীয়া ) আদ্দাস আশ্চার্য হয়ে বললো, খাওয়ার সময় এ দেশের মানুষ তো এ ধরণের বাক্য পড়ে না। রাসূল (সা.) বললেন, তুমি কোন দেশের লোক? তোমার দ্বীন কি? আদ্দাস বললো, আমি খৃষ্টান, নিনুনী দেশে আমার বাড়ী। রাসূল (সা.) বললেন, তুমি ইউনূচ পয়গম্বর এর দেশের মানুষ। আদ্দাস বললো, আপনি কিভাবে জানেন? রাসূল (সা.) বললেন, তিনিও নবী ছিলেন, আমিও নবী। আমরা ভাই ভাই। এ কথা শুনে আদ্দাস রাসূল (সা.) এর হস্তদয় চুম্বুন করতে লাগলেন এবং তিনি ইসলাম কবুল করলেন। (ইবনে হিশাম, সীরাতুন-নবুবীয়া ) রাসূল (সা.) এর এ অবস্থা দেখে দু’জন ফিরিশ্তা এসে বললো, হে মুহাম্মদ! আপনার অনুমতি পেলে তায়েফের বড় দু’টি পাহাড় চাপা দিয়ে এদেরকে ধ্বংস করে দিবো। কিন্তু রাসূল (সা.) বললেন, না তারা বেঁচে থাকুক। হয়ত এমন এক সময় আসবে তাদেরই বংশ থেকে আল্লাহ এমন সন্তান জন্ম দিবেন, যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। (ইব্ন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া )

(ঙ) বহির্বিশ্বে ইসলামের দা‘ওয়াত :
হাবশায় হিজরতের মাধ্যমে ইসলামের দা‘ওয়াত :
হযরত জাফর ইব্ন আবি তালিবের নেতৃত্বে হাবশায় হিজরতের ফলে ইসলামের সুমহান বাণী মক্কার বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। হাবশা হিজরতের ফলে নাজ্জাশী হযরত জা’ফর ইবনে আবি তালিবের মুখে পবিত্র কুরআনের বাণী শুনে ইসলাম গ্রহণ করেন। এবং তিনি রাসূল (সা.) এর সাহাবীদেরকে সাহায্য-সহযোগিতার ঘোষণা দেন এবং দা‘ওয়াতী কাজে সহযোগিতা করেন। বাদশা নাজ্জাশী আল-কুরআনের বাণী শুনে বলেন, হে মুসলামানগণ! তোমাদের প্রতি ও তোমাদের নবীর প্রতি ধন্যবাদ। মুহাম্মদ একজন সত্যবাদী নবী সে কথা আমি ইঞ্জিলে পড়েছি। আল্লাহর শপথ যদি আমার উপর রাজ্য শাসনের ভার অর্পিত না হতো তাহলে আমি শেষ নবীর খেদমতে উপস্থিত হয়ে তাঁর পাদুকায় মাথা রেখে জীবনকে ধন্য করতাম। নিজ হাতে পাত্র নিয়ে তাঁকে অযু করাতাম। তাঁর পদসেবায় একমাত্র মুক্তির পথ। (ড. আহমদ সালাভী, আর-রিক আল-মাওকিফুল ইসলাম ফিহি ) বাদশা নাজ্জাশীর ইসলাম গ্রহণ ও মুসলমানদেরকে নিরাপদে বসবাস করার সুযোগ প্রদানের কারণে হযরত জা’ফর (রা.) হাবশাতে ইসলামী দা‘ওয়াতের জন্য প্রচার কেন্দ্র স্থাপন করেন। (ড. আহম্মদ ফুয়াদ সাইয়েদ, তারিখ আদ-দা‘ওয়াহ আল-ইসলামিয়া আহদে রাসূল )
বাদশা নাজ্জাশীর ইসলাম গ্রহণের সংবাদ মদীনায় পৌঁছার পর সেখানকার আওস ও খাজরাজ গোত্রদ্বয় মক্কাতে এসে হজ্জের মৌসুমে রাসূল (সা.) এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে মদীনাতে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। যা রাসূল (সা.) এর মদীনা হিজরতের পথ সুগম করে। হাবশায় ইসলামের আগমন ও নাজ্জাশীর ইসলাম গ্রহণের সংবাদ দ্রুত সিরিয়াতেও পৌঁছে যায়। সেখানেও বহু সংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহণ করে। (রসূল (সা.) এর দা‘ওয়াতের পদ্ধতি ও মাধ্যম )

পত্রের মাধ্যমে ইসলামের দা‘ওয়াত :
বহিঃবিশে^ ইসলামের দাওয়াত সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে রাসূল (সা.) এবার পত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় দাওয়াত দেওয়ার পরিকল্পনা করলেন। সর্বপ্রথম তিনি ‘বাইজাইন্টাইন সম্রাজ্যের’ শাসনকর্তা হিরাক্লিয়াস এর নিকট দাহিয়া কালবী (রা.) কে দিয়ে পত্র লিখে পাঠান। পত্রের ভাষা ছিল এরূপ : بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ مِنْ مُحَمَّدٍ عَبْدِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ إِلَى هِرَقْلَ عَظِيمِ الرُّومِ سَلَامٌ عَلَى مَنْ اتَّبَعَ الْهُدَى أَمَّا بَعْدُ فَإِنِّي أَدْعُوكَ بِدِعَايَةِ الْإِسْلَامِ أَسْلِمْ تَسْلَمْ وَأَسْلِمْ يُؤْتِكَ اللَّهُ أَجْرَكَ مَرَّتَيْنِ فَإِنْ تَوَلَّيْتَ فَعَلَيْكَ إِثْمُ الْأَرِيسِيِّينَ وَ{ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَى كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا اللَّهَ وَلَا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُولُوا اشْهَدُوا بِأَنَّا مُسْلِمُونَ } “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আল্লাহর বান্দাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) এর পক্ষ থেকে রোমের প্রধান হিরাক্লিয়াসের নিকটে হিদায়েতের অনুস্মরণকারীদের প্রতি সালাম। অতঃপর আপনাকে ইসলামের দিকে আহবান করছি। ইসলাম গ্রহণ করে সর্ব প্রকার অকল্যাণ থেকে মুক্ত থাকুন, আল্লাহ আপনাকে দ্বিগুণ পুরস্কার দিবেন। (ঈসা (আ.) ও মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতি ঈমান আনার কারণে), যদি আপনি এতে সম্মত হন তাহলে আপনার প্রজাদের পাপের জন্য আপনি দায়ী থাকবেন, কেননা সাধারণ জনগণ তাড়াতাড়ি ইসলাম গ্রহণ করে। হে কিতাবীগণ, তোমরা এমন কথার দিকে আস, যেটি আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সমান যে, আমরা একমাত্র আল্ল¬াহ ছাড়া কারো ইবাদাত না করি। আর তার সাথে কোন কিছুকে শরীক না করি এবং আমাদের কেউ কাউকে আল্ল¬াহ ছাড়া রব হিসাবে গ্রহণ না করি। তারপর যদি তারা বিমুখ হয় তবে বল, তোমরা সাক্ষী থাক যে, নিশ্চয় আমরা মুসলিম।” (সহীহ আল-বুখারী )

পত্র পাওয়ার পর হিরাক্লিয়াস এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য আরবের কোন লোককে দরবারে আনার জন্য বললেন। ঘটানাক্রমে এ সময় ইসলামের প্রধান শত্রু আবু সুফিয়ানকে পাওয়া গেল। তাকে সম্রাটের দরবারে ডেকে আনা হলো এবং কিছু প্রশ্ন করা হলো। সম্রাট আবুসুফিয়ানের নিকট থেকে সকল বিষয় অবগত হয়ে বললেন, হে আবু সুফিয়ান তুমি যা বলেছ তা যদি সত্য হয়, তাহলে তিনি সত্য সত্যই আল্লাহর নবী, এতে কোন সন্দেহ নেই। আমার বিশ্বাস আমার পদতলস্থ ভূভাগ শীঘ্রই তাঁর করতলগত হবে। একজন রাসূল আগমন করবেন এ সম্পর্কে আমি অবগত ছিলাম। কিন্তু তিনি যে আরবে অবির্ভূত হবেন, এ কথা আমি জানতাম না। আমার যদি সুযোগ হত তাহলে নিশ্চয়ই আমি তাঁর খেদমতে উপস্থিত হতাম এবং তাঁর পবিত্র পদযুগল ধৌত করে নিজেকে ধন্য করতাম। (মুহাম্মদ গাজ্জালী, ফিকহুস-সীরা )

অতঃপর রাসূল (সা.) পারস্য সম্রাটের নিকট আবদুল্লাহ ইব্ন হুযায়ফার মাধ্যমে ইসলামের দা‘ওয়াত দিয়ে পত্র প্রেরণ করেন এবং হুযায়ফাকে বললেন, তুমি বাহরায়নের শাসনকর্তা মুনযিরের হাতে পত্রখানা দিয়ে তাকে কিসরার নিকট পৌঁছে দিতে বলবে। পারস্য সম্রাট পত্র পড়ে বললো, আমার নিকট এভাবে কে পত্র লিখেছে? শুরুতে আল্লাহর নাম, তারপর প্রেরকের নাম, তারপর সম্রাটের নাম। এ কতবড় অপমান! এ অপমান সহ্য করা যায় না। এ কথা বলে তিনি পত্রখানা ছিড়ে টুকরা টুকরা করে ফেলে।

এরপর রাসূল (সা.) মিসরের রাজা মুকাওকিসের নিকট বিশিষ্ট সাহাবী হাতিব ইব্ন আবি বালতায়া এর মাধ্যমে দা‘ওয়াত সম্বলিত পত্র প্রেরণ করেন। পত্র পাওয়ার পর মুকাওকিস প্রকাশ্যভাবে ইসলাম গ্রহণ না করলেও তিনি রাসূল (সা.) এর নবুওয়াত স্বীকার করে নেন এবং খুশি হয়ে মারিয়া ও সীরীন নামে দু’জন কুমারীকে হাদীয়া হিসেবে প্রেরণ করেন। এছাড়া বাদশা উপঢৌকনস্বরূপ পাঁচটি কিবতি পোশাক ও এক হাজার দীনার প্রেরণ করেন।

আবিসিনিয়ার বাদশা নাজ্জাশী জা’ফর ইব্ন আবি তালিবের নিকট থেকে পূর্বেই ইসলামের দা‘ওয়াত পান এবং রাসূল (সা.) এর নবুওয়াতকে মেনে নেন। ৬ষ্ঠ হিজরীতে রাসূল (সা.) রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আমর ইব্ন উমাইয়া আদ-দারীমী (রা.) কে বাদশা নাজ্জাশীর দরবারে দূত হিসেবে পত্রের মাধ্যমে ইসলামের দা‘ওয়াত নামা প্রেরণ করেন। নাজ্জাশী পত্রখানা পড়ে প্রকাশ্যে ইসলামের ঘোষণা দেন এবং আমর ইব্ন উমাইয়ার নিকট চিঠির উত্তর দেন।
এছাড়া হযরত মুহাম্মদ (সা.) নাযরানবাসীদের নিকট, ইয়ামামার বাদশা এর নিকট, বাহরায়েনের সম্রাট এবং ওমানের সম্রাট এর নিকট দা‘ওয়াত সম্বলিত পত্র প্রেরণ করেন, যা ইসলামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে।

পরিশেষে বলা যায়, রাসূল (সা.) ছিলেন এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দা‘য়ী ইলাল্লাহ। তিনি তাঁর জীবনের প্রতিটা মুহুর্ত ব্যয় করেছেন ইসলামী দা‘ওয়াতের প্রচার-প্রসার তথা ইসলামের সুমহান আদর্শ মানুষের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। আমরাও একজন মুসলিম ও রাসূল (সা.) এর ওয়ারিশ হিসেবে ইসলামের সুমহান আদর্শের দাওয়াত পৌছে দেওয়ার জন্য রাসূল (সা.) কর্তৃক প্রণীত উপরোক্ত পদ্ধতি ও কৌশল অবলম্বন করতে পারি তাহলে আমরাও দাওয়াতী কাজে ব্যাপক সফলাত পাব এবং আখেরাতেও উত্তম প্রতিদান পাব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমারেদ তৌফিক দান করুন। আমীন।