ইসলামে প্রবীণদের অধিকার ও মর্যাদা

ইসলামে প্রবীণদের অধিকার ও মর্যাদা

ফাইল ছবি

সমাজ ও সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু হলো পরিবার। সাধারনত পরিবারে তিন শ্রেণীর সদস্য থাকেন। প্রথম হলো- স্বামী – স্ত্রী, দ্বিতীয়ত হলো- সন্তান-সন্ততি এবং তৃতীয়ত হলো- বৃদ্ধ পিতা-মাতা। পরিবারের এসব বৃদ্ধ বা প্রবীণ সদস্যগণ তাদের ভরন –পোষণ ও সেবা- শুশ্রুষার জন্য কারো না কারো ওপর বিশেষ করে সন্তানদের ওপর নির্ভশীল থাকেন। এই প্রবীণরা হলো বর্তমান আধুনিক সভ্যতার নির্মম শিকার । বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে প্রবীণ সমস্যা যতটা প্রকট তার থেকেও বেশী উন্নত দেশে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তারা প্রবীণ জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা ও কল্যাণে বহুলাংশে ব্যার্থ হয়েছে। প্রবীণদের সেখানে আশ্রয় জুটে বৃদ্ধ নিবাসে, যেখানে আপনজন ও সন্তানদের সান্নিধ্যের অভাব তাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা মারাত্মকভাবে বিনষ্ট করে। এসব পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে তাদেরকে যেন আপনজন ও সমাজ ভুলে না যায় সেজন্য জাতিসংঘ ১৯৯০ সাল থেকে বছরের একটি দিন পহেলা অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস ঘোষণা করেছে।

প্রবীণদের কল্যাণে আন্তর্জাতিক এ আয়োজন ও নানাবিধ সামাজিক উদ্যোগ তাদের পরিপূর্ণ নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে পারেনি। এ পরিস্থিতিতে ইসলাম প্রবীণদের যে সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার দিয়েছে তা মানুষের সামনে যথাযথভাবে  তুলে হলে এবং তা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হলেই কেবল এ সমস্যার  সঠিক সমাধান হতে পারে।

 

ইসলামে বয়োবৃদ্ধ পিতা-মাতার সেবা –যত্ন করা ও তাদের অনুগত থাকা সন্তানদের অপরিহার্য  কর্তব্য :

মহান আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় বান্দা মহানবী (স:) কে মদীনায় হিজরতের এক বছর পূর্বে মক্কার জীবনে উর্দ্ধজগত (মেরাজ) ভ্রমন করিয়ে  ছিলেন। সংঘটিত সেই শবে মেরাজে রাষ্ট্র পরিচালনার ১৪ দফা মূলনীতি প্রদান করেণ। মহান আল্লাহ বলেন, আপনার প্রতিপালক নির্দেশ দিচ্ছেন যে (১ম দফা), তোমরা কেবল তাঁরই ইবাদত করবে। (২য় দফা) পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। তোমাদের কাছে যদি তাদের কোনো একজন অথবা উভয়ই বৃদ্ধাবস্থায় পৌঁছে তাহলে তুমি তাদের ‘উহ্’ পর্যন্ত বলবে না, তাদের ধমক দেবে না বা অবজ্ঞা করবে না তাঁদের সঙ্গে আদবের সাথে কথা বলবে। বিনয় ও নম্রতার বাহু তাদের জন্য সম্প্রসারিত করবে। আর এ দোয়া করতে থাকবে-

‘হে আমার প্রভু! আমার পিতা-মাতা শৈশবে যে মায়া-মমতায় আমাকে লালন-পালন করেছেন, তুমিও তাদের প্রতি সেরূপ করুনা বর্ষণ করো।।’ (সূরা বনি ইসরাঈল, ১৭: ২৩- ২৪)।

সমাজের মূলভিত্তি হলো পরিবার। এ পরিবারে সবচেয়ে সম্মান ও মর্যাদার আসনটি হলো পিতা-মাতার। তাই বান্দার জন্য আল্লাহ তায়ালার আনুগত্যের পর পিতা মাতার আনুগত্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং আল্লাহ তায়ালার কৃতজ্ঞ হওয়ার ন্যায় পিতা মাতার কৃতজ্ঞ হওয়া অপরিহার্য । হযরত আলী (রা.) হতে বর্ণিত এক হাদিসে রাসুল (স.) বলেন, পীড়া দানের ক্ষেত্রে ‘উহ’ বলার চাইতে কম কোন স্তর থাকলে তাও অবশ্যই উল্লেখ করা হত। পিতা-মাতার সঙ্গে ধমক দিয়ে কথা বলা নিষেধ। তাদের সাথে সম্প্রীতি ও ভালবাসার সাথে নরম স্বরে কথা বলতে হবে। তাদের সামনে নিজেকে সবসময় অক্ষম ও হেয় করে পেশ করতে হবে। বয়োবৃদ্ধ পিতা-মাতার সেবা –যত্নের যে অসাধারণ উপমা আল্লাহ দিয়েছেন সেরূপ কোন উদাহারণ কোন সাহিত্য, দর্শণ ও ইতিহাসে একেবারেই বিরল।

 

পিতা-মাতার আনুগত্যের সীমানা

পিতা-মাতার আনুগত্যের সীমানা মহান আল্লাহ হৃদয়গ্রাহী ভাষায় বলে দিয়েছেন। । মহান আল্লাহ বলেন - আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহারের জন্য জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট স্বীকার করে গর্ভধারণ করেছে। আর তাকে বুকের দুধ ছাড়াতে লেগেছে পুরো দুই বছর । অতেএব আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। কারণ  আমার কাছেই তোমাদের ফিরে আসতে হবে। পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়কে শরীক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই। তাহলে  তুমি তাদের কথা  মানবে না । তবে এরপরও তাদের সাথে সব সময় সুন্দর ব্যবহার করবে, তাদের খেদমত করবে এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সহাবস্থান করবে। যারা বিশুদ্ধচিত্তে আমার পথে চলে শুধু তাদেরকেই অনুসরণ করবে। তোমাদের সবাইকে শেষ পর্যন্ত আমার কাছেই ফিরে আসতে হবে। (সূরা লোকমান, ৩১: ১৪-১৫)।

 

প্রবীণদের শ্রদ্ধা ও সম্মান করা এবং ছোটদের স্নেহ করা ইসলামি নৈতিকতার অন্যতম বিধান:

হজরত আবু মুসা আল আশআরি (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই বৃদ্ধ মুসলিমকে সম্মান করা, কোরআনের ধারক-বাহক ও ন্যায়পরায়ণ শাসকের প্রতি সম্মান দেখানো মহান আল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অন্তর্ভুক্ত। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮৪৩)

রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে আমাদের ছোটদের দয়া করে না ও আমাদের বড়দের হক আদায় করে না, সে আমাদের (দলভুক্ত) নয়। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৪৩)

আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর (রা.) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টির মধ্যে এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টির মধ্যে নিহিত ।  (তিরমিযী, হাদীস: ১৮৯৯; মিশকাত, হাদীস: ৪৯২৭) । হযরত আবুদ্দারদা (রা.) হতে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি শামে তার নিকটে এসে বলল, আমার মা, অন্য বর্ণনায় আমার পিতা বা মাতা (রাবীর সন্দেহ) আমাকে বারবার তাকীদ দিয়ে বিয়ে করালেন। এখন তিনি আমাকে আমার স্ত্রীকে তালাক দানের নির্দেশ দিচ্ছেন। এমতাবস্থায় আমি কি করব? জবাবে আবুদ্দারদা বলেন, আমি তোমার স্ত্রীকে ছাড়তেও বলব না, রাখতেও বলব না। আমি কেবল অতটুকু বলব, যতটুকু আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নিকট থেকে শুনেছি। তিনি বলেছেন, পিতা হলেন জান্নাতের মধ্যম দরজা। এক্ষণে তুমি চাইলে তা রেখে দিতে পার অথবা বিনষ্ট করতে পার। (শারহুস সুন্নাহ, হাদীস: ৩৪২১; আহমাদ, হাদীস: ২৭৫৫১; তিরমিযী, হাদীস: ১৯০০)

 

ইসলামে প্রবীণ সমস্যার সর্বোত্তম সমাধান রয়েছে:

ইসলাম জ্ঞানীকে তার জ্ঞানের জন্য আর প্রবীণকে তার বয়সের জন্য শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে সেখায়। ইসলামের শিক্ষা হলো- সন্তানের অসহায়ত্বের সময় যেভাবে পিতা-মাতা তাকে স্নেহভরে সযত্নে প্রতিপালন করবে, পিতা-মাতার অসহায়ত্ব তথা বৃদ্ধাবস্থায়ও তাদেরকে সেভাবে লালন-পালনের সকল দায়-দায়িত্ব সন্তান গ্রহণ করতে হবে।। এ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করা অমানবিক এবং ঈমান ও ইসলাম বিবর্জিত কাজ। এমন গর্হিত  কাজ যারা করে তারা ক্ষমা লাভের যোগ্য নয়। যুহায়র ইবনু হারব (রহ,) ..... আবু হুরাইরাহ্ (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তার নাক ধুলায় মলিন হোক (৩ বার) সাহাবিরা বলেন হে আল্লাহর রাসুল ! সেই হতভাগ্য ব্যক্তিটি কে? রাসুল (স:)বললেন, সে হলো ঐ ব্যক্তি, যে তার পিতা –মাতা উভয়কে অথবা একজনকে পেল অথচ তাদের সেবা করে জান্নাত হাসীল করতে পারলো না। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬২৮০, ইসলামিক সেন্টার ৬৩২৯) এ অবহেলার জন্য সন্তানদের পরকালে যেমন কঠিন শাস্তি জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে আর তেমনি দুনিয়াতেও বার্ধক্যাবস্থায় তার চরম পরিণতি ভোগ করা লাগতে পারে। একদা হুযুর (স.) বললেন, আমি যখন মিম্বরের তৃতীয় সিঁড়িতে পা রেখেছি তখন জিব্রাইল (আ:) এসে বললেন, যে ব্যক্তি পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাবস্থায় পেয়ে তাদের সেবা করে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না, সে ধ্বংস হউক!তখন আমি বললাম আমিন (সুনানে তিরমিজী: ৩৫৪৫)

ইসলামী আইন অনুযায়ী পিতা-মাতার ওপর সন্তানের ভরন- পোষণ যেমন বাধ্যতামূলক তেমনি সন্তানের ওপরও পিতা-মাতার ভরন-পোষণ দেওয়া বাধ্যতামূলক। কুরআন –সুন্নার আলোকে সন্তানের উপর পিতা-মাতার ১৪টি অধিকার রয়েছে। তার মধ্যে ৭টি জীবিত কালে। যথা- তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা, ভালবাসা প্রকাশ করা, তাদের সেবা-যত্ন করা, বিনয়ের সাথে আনুগত্য করা, তাদের সুখ-শান্তির চিন্তা করা, প্রয়োজন পূরন করা ও তাদের সাথে মাঝে মাঝে দেখা- সাক্ষাৎ করা। আর ৭টি মৃত্যুর পর। যথা- তাদের জন্য মাগফিরাতের দোয়া করা, তাদের ঋণ পরিশোধ করা, তাদের বৈধ অসিয়ত পূরণ করা, তাদের রেখে যাওয়া আমানত হেফাজত করা, তাদের বন্ধু ও স্বজনদের সম্মান করা, তাদের বন্ধু ও স্বজনদের সহযোগীতা করা এবং মাঝে মাঝে তাদের কবর জিয়ারত করা।

 

পরিবার হলো রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রতমরূপ যেখানে প্রবীণদের মর্যাদা সবার উপরে:

পরিবার হলো সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রাথমিক ধাপ। পরিবার যত আনুগত্যশীল, সহনশীল ও পরস্পরে শ্রদ্ধাশীল হবে, সমাজ ও রাষ্ট্র তত সুন্দর ও শান্তিময় হবে। পরিবার যত উচ্ছৃংখলতা ও অনাচার থাকবে , সমাজেও তত অনিষ্টতা ও বিশৃংখল থাকবে। ইসলামী রীতি অনুযায়ী পিতা হবেন পরিবার প্রধান এবং মাতা  হবেন গৃহকত্রী। প্রয়োজন মতো পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের পরামর্শ নিয়ে তারা পরিবার পরিচালনা করবেন। কেননা আল্লাহ বলেন, জরুরি বিষয়ে তুমি তাদের সঙ্গে পরামর্শ কর। অতঃপর যখন সংকল্পবদ্ধ হবে, তখন আল্লাহর ওপর ভরসা কর।’ ( আল ইমরান ,৩:১৫৯)।

ইসলাম পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন ও সর্বস্তরের প্রবীণদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, তাদের অসহায়ত্বের সময় সেবাযত্ন করার নির্দেশ  দিয়েছে। ইসলামের এ নির্দেশনা মেনে চললে প্রবীণ নিবাসে প্রবীণদের দুর্দশাপূর্ণ জীবনযাপন করার প্রয়োজন হয় না। একজন সুস্থ বিবেকসম্পন্ন ও মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন মানুষ তার বৃদ্ধা পিতা-মাতাকে এবং তার আত্মীয়-পরিজনকে অবহেলা  ও উপেক্ষা করতে পারে না।


অতএব, একটি  সুখী ও ‍সুন্দর পরিবার গঠনে প্রবীণদের অবদান অনস্বীকার্য । প্রবীণরা নবীন ও শিশুদের মূল্যবোধ, সদাচরন ও নীতি-নৈতিকতা পথ-প্রদর্শক। স্বামী-স্ত্রীর ভুল বুঝাবুঝি দুর করে, এমনকি বিচ্ছেদ ঠেকায়। তারা সমাজের অভিবাবক, সংস্কারক এবং আদর্শিক মডেল । কোন মুসলিম সমাজে প্রবীণরা বোঝা নয় বা সমস্যাও নয় । তাই আমাদের ঈমানী , সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধের দাবী হচ্ছে -প্রবীণদের  সম্মান প্রদর্শন করা এবং তাদের সকল শারীরিক ও মানসিক প্রয়োজনসমূহ পরম আন্তরিকতারসাথে পূরণ করা ।