কাশ্মীরের ফিলিস্তিনিকরনের পরিনাম

কাশ্মীরের ফিলিস্তিনিকরনের পরিনাম

ছবি সংগৃহিত।

মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর জায়গাটিকে আখ্যায়িত করেছিলেন পৃথিবীর স্বর্গ বলে। কেউ বলে প্রাচ্যের সুইটজারল্যান্ড। চিনার বন, আপেল বাগান আর তুষার শুভ্র পাহাড়ের কোল ঘেষে লেকের পাড়ে শান্তি প্রিয় মানুষ গুলোর বসবাস। মেহমানদারির জন্য যাদের রয়েছে যুগ যুগ ধরে সুখ্যাতি। প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়া ভুস্বর্গ কাশ্মীরের মানুষগুলো ৭০ বছর ধরে নিপীড়িত ও নির্যাতিত। পাহাড়ি ঝর্না ধারার ডাল লেকের পানির সাথে মিশে গেছে কাশ্মীরের লাখো মানুষের শোনিত ধারা। তাদের একটিই লক্ষ্য আজাদি। এজন্য কম ত্যাগ তিতিক্ষা তাদের সহ্য করতে হচ্ছে না। সর্বশেষ কাগজে কলমে তাদের যে অধিকারটুকু ছিলো তাও হরন করা হলো। 
১৯৪৭ সালের আগ পর্যন্ত কাশ্মীর ছিলো বৃটিশদের নিয়ন্ত্রনে থাকা স্থানীয় রাজা বা নবাবদের দ্বারা পরিচালিত রাজ্য। যাকে বলে ফ্রিঞ্চলি স্টেট। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত রাষ্ট্রের বিভাজনের সময় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট এলাকা গুলোকে নিয়ে পাকিস্তান আর হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ট এলাকা নিয়ে ভারত নামে রাষ্ট্র গঠিত হবে। এই রাজ্যগুলোকে বলা হয় জনআকাঙ্খার ভিত্তিতে তারা যে কোনো রাষ্ট্রে যোগ দিতে পারে। অবিভক্ত ভারতের তিনটি রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীর, জুনাগড় ও হায়দারাবাদের শাসকরা কোনো রাষ্ট্রে যোগ না দিয়ে স্বাধীন থাকতে চেয়েছিলেন। এই তিন রাজ্যের মধ্যে জম্মু কাশ্মীর ছিলো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট কিন্ত রাজা হরিসিং ছিলেন হিন্দু। অপরদিকে হায়দারাবাদ ও জুনাগড় ছিলো হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ট কিন্তু শাসক ছিলেন মুসলিম নিজামরা। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্টতার কথা বলে হায়দারবাদ ও জুনাগড় ভারত দখল করে। 
এ সময় কাশ্মীরের পুঞ্চ অঞ্চলে বিদ্রোহ দেখা দেয়। পাশ্ববর্তী পাকিস্তানের স্থানীয় উপজাতিরা কাশ্মীরে প্রবেশ করে। পরিস্থিতি সামলাতে কাশ্মীরের প্রভাবশালী রাজনীতিক শেখ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহর সম্মতিতে রাজা হরি সিং ভারতীয় সেনাবাহিনী সাহায্য চান। দুজন একমত হন যে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর জনগনের সম্মতিতে রাজ্যর ভাগ্য নির্ধারিত হবে। অপরদিকে ভারত জাতিসংঘে অভিযোগ করে পাকিস্তান বহিরাগত উপজাতিদের সমর্থন দিচ্ছে। জাতিসংঘ ম্যান্ডেট দেয়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আসলে সেখানে গনভোটের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে কাম্মীর পাকিস্তান না ভারতের সাথে থাকবে। 
ভারতীয় নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্টার পর কাশ্মীরে গনপরিষদ গঠন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী হন শেখ আব্দুল্লাহ। এ সময় সিদ্ধান্ত হয় পররাষ্ট্র সম্পর্কিত বিষয়াদি, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ বাদে অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে কাশ্মীর স্বাধীন থাকবে।
ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ নামে পরিচিত কাশ্মীরের এই বিশেষ মর্যাদায় কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দারাই শুধুমাত্র সেখানে বৈধভাবে জমি কিনতে পারবেন, সরকারি চাকরি করার সুযোগ পাবেন এবং সেখানে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবেন। জম্মু ও কাশ্মীরকে নিজেদের সংবিধান ও একটি আলাদা পতাকার স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়। মোদি সরকার ভারতের সংবিধানের এই ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপ করেছেন। 
কাশ্মীরের মানুষ ১৯৪৭ সাল থেকে স্বাধীনভাবে অথবা পাকিস্তানের সাথে থাকার দাবি করে আসছে। কাশ্মীরের ওপর ভারতের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্টার পর থেকে এই দাবি ভারত সরকার উপেক্ষা করে আসছে। নানা ভাবে কাশ্মীরীদের অধিকার হরন করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৮৯ সাল থেকে কাশ্মীরে সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়। ২ লাখ ২২ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই এলাকায় ১ কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে ৭ লাখ সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে সামরিকায়িত এলাকা হচ্ছে জম্মু ও কাশ্মীর। তিন দশকে মারা গেছে ৭০ হাজার কাশ্মিরী। বিধবা হয়েছে অসংখ্য নারী। যার মধ্যে গুম হওয়া মানুষের সংখ্যাও কম নয়। দখলদারি প্রতিষ্টার জন্য এতো বিপুল সংখ্যক সৈন্য আর কোথাও মোতায়েন করা হয়নি। 
ভারতের সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের এই বিলোপের মাধ্যমে শুধু কাশ্মীরের মানুষের অধিকার হরন করা হয়নি, মানচিত্রও বদলে ফেলা হয়েছে। কাশ্মীর থেকে ভেঙে আলাদা করা হয়েছে লাদাখকে। দুটি আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হচ্ছে জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ। দু’টি জায়গাতেই দু’জন লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিয়োগ করা হবে। এখন জম্মু এবং কাশ্মীর 'ইউনিয়ন টেরিটরি' বা কেন্দ্রীয়ভাবে শাসিত রাজ্য হিসেবে পরিচালিত হবে। লাদাখ কেন্দ্রশাসিত তৃতীয় একটি এলাকা হিসেবে বিবেচিত হবে। 
কাশ্মীরকে বিভক্ত করা এবং কাশ্মীরী জনগনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বিশেষ মর্যাদা হরনের পেছনে বিজেপির সুদুর প্রসারী পরিকল্পনা আছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন কাশ্মীরের জনবিন্যাস বদলে ফেলার জন্য এমন পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
 এখন কাশ্মীরে বহিরাগতদের ব্যাপকভাবে পুর্নবাসন করা হবে। এমনকি স্থানীয়দের উচ্ছেদ করে জমি বরাদ্দ ভবন বা শিল্প কারখানা গড়ে তোলা হবে। বিগত সাধারণ নির্বাচনের আগে বিজেপি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও সংবিধানের ৩৭০ ধারা ও আর্টিকল ৩৫এ বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বিজেপির এক নির্বাচনি পোস্টার ছিল ‘আপকা সাহি ভোট কাশ্মিরমে আপকো প্লট দিলা সাকতা হ্যায়’। হিন্দি ভাষার ওই নির্বাচনি শ্লোগানের অর্থ হল, আপনি যদি ঠিকমতো ভোট দিয়ে জেতান, তাহলে আপনার কাশ্মিরে জমি কেনার স্বপ্নও সফল হবে। 
 সেই ধারা বিলুপ্ত হওয়ার পর এখন ভারতের অন্য অংশের নাগরিকরাও কাশ্মিরে গিয়ে জমি-বাড়ি কিনতে পারবেন। ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল তার এক পরিকল্পনায় কাশ্মিরে হিন্দু পন্ডিতদের জন্য আলাদা কলোনি স্থাপন, শিল্পাঞ্চলের জন্য বাকি ভারত থেকে শিল্প শ্রমিকদের এনে বসতি স্থাপন কিংবা ভারতীয় সেনার সাবেক সদস্যদের এনে জমি দেওয়ার কথা বলেছেন। মুলত কাশ্মীরের স্থানীয় জনগনকে ভুমি থেকে উচ্ছেদের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ভারত। 
ইতোমধ্যে কাশ্মীরকে বিভাজনের মাধ্যমে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট অঞ্চলের পরিচিতি মুছে ফেলা হয়েছে। ধারনা করা হচ্ছে কাশ্মীরে জনমিতি বদলে ফেলার এই পরিকল্পনার ধারনা এসেছে ইসরাইলের কাছ থেকে। কাশ্মীরে স্বাধীনতাকামীদের দমনের জন্য বিভিন্ন সময় ভারত সরকার ইসরাইলের সাহায্য নিয়েছে। মোদি সরকারের সাথে সবচেয়ে ঘনিষ্ট সর্ম্পক এখন ইসরাইলের। আর্ন্তজাতিক বিশ্লেষকরা এমন কথা বলছেন। 
রুশ বংশোদ্ভূত মার্কিন বিশ্লেষক অ্যান্ডু কারিবকো বলছেন, যেমন করে ইসরায়েল ফিলিস্তিনি ভূমিতে অর্ধলক্ষ সেনা-সমাবেশ ঘটিয়েছে, সেখান কারফিউ জারির পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ধারাবাহিকভাবে গ্রেফতার করার পাশাপাশি স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নিয়েছে, গাজাকে পশ্চিমতীর থেকে পৃথক করে আলাদা প্রশাসনিক অঞ্চল বানিয়েছে, কাশ্মিরের ক্ষেত্রেও ভারত তাই করতে চলেছে। তার মতে, পশ্চিমতীরে যেমন করে অবৈধ ইসরায়েলি বসতি স্থাপনের বন্দোবস্ত করা হয়েছে, তেমনি করে কাশ্মিরেও হিন্দুত্ববাদীদের বসতি স্থাপনের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। কারিবকো বলছেন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক স্বীকৃত ওই বিতর্কিত ভূমির জনসংখ্যাগত চরিত্র বদলে দেওয়ার পায়তারা করছে ভারত। কিন্তু ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকার যা উপলদ্ধি করতে পারছে না তা হলো ফিলিস্তিনিদের চেয়েও কাশ্মীরের ইনতিফাদা হবে আরো প্রবল। কারন প্রজন্মের পর প্রজন্ম জন্ম হচ্ছে বিচ্ছিন্নতা নিয়ে। কাশ্মীরীদের বিচ্ছিন্নতাবোধ তাদেরকে স্বাধীনতার আকাংখাকে তীব্র করবে।    
তবে বিজেপি সরকারের এমন পরিকল্পনা ভারতকে বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে পারে। কারন কাশ্মীরের মানুষ আজাদি বা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের পথ থেকে ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে। বরং তা আরো তীব্র রুপ নিতে পারে। এমন আশংকার কথা বলেছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা পি চিদাম্বরম। তিনি বলছেন সরকার যা করেছে, তা দেশ ও গণতন্ত্রের পক্ষে চরম বিপজ্জনক। এই সিদ্ধান্ত দেশকে টুকরো টুকরো করে দেওয়ার প্রথম পদক্ষেপ।  কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি টুইটারে এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত কার্যকরভাবে ভারতকে ঐ রাজ্যের দখলদার বাহিনী হিসেবে প্রমান  করেছে। এছাড়া কাশ্মীর নিয়ে ভারতের এমন সিদ্ধান্ত প্রতিবেশি ছোট দেশগুলোর জন্য উদ্বেগের কারন হয়ে দেখা দিয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে একটি জনগোষ্টীকে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা হয়েছে তাতে ভারতের ওপর আস্থা রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।