প্রসঙ্গ: বিশ্ব শিক্ষক দিবস

প্রসঙ্গ: বিশ্ব শিক্ষক দিবস

আবু জাফর

৫ অক্টোবর, বিশ্ব শিক্ষক দিবস। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত, আর উন্নতির মূল কারিগর হল শিক্ষকগণ। যারা তাদের জীবনীশক্তীর সমস্ত শক্তি দিয়ে, আদর-ভালোবাসা দিয়ে তিলে তিলে গড়ে তুলেন এক একটি শিক্ষার্থীকে। যাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কেউ হয়ে যায় জগত বিখ্যাত বিজ্ঞানী কেউবা প্রকৌশলী। এই দুনিয়ায় যে যাই হয়েছেন বা হবেন তাদের পিছনে প্রতক্ষ্য বা পরোক্ষভাবে এক বা একাধিক শিক্ষকের অবদান অনস্বীকার্য। তবে আমাদের এ দেশেতে শিক্ষকদের তেমন মূল্যায়ন করা হয় না। চার-ছক্কা মেরে আমাদের মুশফিক-সাবিক ভাইয়েরা যে বাহবা পান তার কানাকড়ি ও পান না গনিত অলিম্পিয়াডের ৬ জন বিজয়ীর বা তাদের শিক্ষকগণ। ক্রিকেট যেমন সবার সামনে দেশের মান উজ্জ্বল করে, সারা বছর খেটেখুটে ৬ জন পদক পাওয়ানো সেই শিক্ষক মহোদয় গন কে বাহবা দূরে থাক অনেকে চিনবেনই না। আর এতেই আমরা শিক্ষাহীন এক মেরুদণ্ড বিহীন জাতিতে পরিনত হচ্ছি। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলে গেছেন "যে দেশে গুনীর কদর নাই সে দেশে গুনী জমে না"।

ইউরোপ-আমেরিকা চীন-কোরিয়াতে শিক্ষকদের যথেষ্ট মূল্যায়ন করা হয়। আর তার ফলাফল তারা হাতেনাতেই পান। বড় ডাক্তার-প্রকৌশলী তারা তাদের দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে গিয়েও সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। অনেকে আবার উপযুক্ত সম্মান না পাওয়ায় পাওয়া পাড়ি দিচ্ছেন বিদেশে। তেমন একটা উদাহরন হল মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার অজপাড়াগায়ের মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি এখন অস্ট্রেলিয়ার মারডক ইউনিভার্সিটির সাসটেইনেবল অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড গভর্ন্যান্সের সহযোগী অধ্যাপক। তাঁর শিক্ষকতার ধরন এবং কর্মস্থলের উপযোগী পাঠদান পদ্ধতির জন্য ২০১৬, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে মারডক বিজনেস স্কুলের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হয়েছেন। গবেষণায় অবদান রাখার জন্য ২০১৮ সালে পেয়েছেন রিসার্চ এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড। এবার পেয়েছেন "পিভিসি অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সিলেন্স ইন টিচিং অ্যান্ড লার্নিং ২০২০"।মোয়েজ্জেমের ভাষায় "শিক্ষকদের শিক্ষক সত্তাকেই সবচেয়ে বড় অর্জন মনে করতে হবে"। তিনি বলেন, ‘একজন শিক্ষক মানুষের জীবন বদলে দিতে পারেন, পৃথিবী বদলে দিতে পারেন। আর তার শ্রেষ্ঠ প্রমান তিনি নিজেই। আর এমন শত মোয়াজ্জেম বাংলাদেশের আনাচেকানাচে পড়ে আছে কোন স্বীকৃত ছাড়াই।

ব্রিটেন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ইকোনোমকি এবং সোশ্যাল রিসার্চ ৩৫টি দেশে ৩৫,০০০ মানুষের ওপর এক গবেষণা চালিয়ে যে "শিক্ষক মর্যাদা সূচক" প্রকাশ করেছে, তাতে এই চিত্র বেরিয়ে এসেছে যে, শিক্ষক হিসাবে ক্লাসরুমে সম্মান এবং মর্যাদা পান চীনের শিক্ষকগণ । তারপরেই আছে মালয়েশিয়া বা তাইওয়ানের শিক্ষকগণ। তবে শিক্ষক হিসাবে মর্যাদা পাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে কম যে সব দেশে তার মধ্যে রয়েছে ব্রাজিল, ইসরায়েল এবং ইটালি। চীনের ৮১ শতাংশ শিক্ষার্থী বিশ্বাস করে শিক্ষকদের সম্মান করতে হবে, যেখানে আন্তর্জাতিকভাবে এই গড় ৩৫ শতাংশ। তাই চীনও আন্তর্জাতিকভাবে যে সব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা হয়, সেখানে চীনের ছাত্র-ছাত্রীরাই সবচেয়ে ভালো করছে। এমনকি কয়েকদিন পূর্বে অনুষ্ঠিত গনিত অলিম্পিয়াডের চ্যম্পিয়নও চীনের। গবেষনার উঠে আসে তাদের ভালো করার অন্যতম কারণ হচ্ছে, মর্যাদা রয়েছে বলে ভালো শিক্ষক পাওয়া এবং ধরে রাখাও সহজ হয় এসব দেশ। এখন চীন, ভারত বা গানার পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের শিক্ষক হতে উৎসাহিত করে।

অন্যদিকে বাংলাদেশের পরিগুলো চান না তাদের সন্তানগন শিক্ষক হোক। ভার্কি ফাউন্ডেশনর প্রতিষ্ঠাতা সানি ভার্কি বলেন, "একটি প্রচলিত বিশ্বাস প্রমাণিত যে সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা বেশি, সেখানে শিক্ষার্থীরা ভালো শিক্ষা পায়।" বাংলাদেশে শিক্ষকদের সম্মান দেওয়া দূরের কথা তাদের অধিকারটুকু আমরা দিতে নারাজ।

আমরা এমন এক সমাজে বাস করি যেখানে পুলিশের লাথির চেয়েও নিন্দনীয় হয়েছে যেকোনো শিক্ষকের বেত। অথচ একজন ছাত্রের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে এই শিক্ষকের বেতই। আজকাল বেত মারা দূরের কথা, কঠোরভাবে মৌখিক শাসন করারই সাহস পান না শিক্ষকদের পাত্তা না দেয়া,সালাম না দেয়া এখন একটা আর্ট হয়ে গেছে। এখন বহু পেশারই মর্যাদা কমেছে তবে সবচেয়ে কমেছে সম্ভবত শিক্ষকদের মর্যাদা।

আমরা ভুলতে পারবনা ২০১২ সালের ১৫ মে বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দিতে গিয়ে শাহবাগে পুলিশের বেধড়ক পিটুনিতে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছিলেন বহু শিক্ষক। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে মারা গিয়েছিলেন লাঞ্ছিত একজন শিক্ষক, যিনি একাত্তরে এ দেশকেই স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ করেছেন। কয়েকবছর আগে গৌরীপুরে একজন শিক্ষককে দিগম্বর করে ফেলা হয়েছিল, সিলেটে কয়েকজন স্বনামধন্য শিক্ষকের গায়ে হাত তোলা হয়েছিল, বরিশাল বিএম কলেজে দায়িত্ব নিতে আসা একজন বর্ষীয়ান শিক্ষককে কিল-ঘুষি-লাথি মেরে বের করে দেওয়া হয়েছিল। । নারায়ণগঞ্জে একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে, শত শত লোকের সামনে কান ধরে ওঠবস করেছিলেন স্থানীয় সাংসদ। আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা একজন শিক্ষকের তাদের রাজনৈতিক-ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন শিক্ষক। এখন শিক্ষক কে সম্মান দেয়া অতীব জরুরী নয়তো আমরা জন্য অপেক্ষা করছে শিক্ষাবিহীন মেরুদণ্ডহীন এক দেশ।

আবু জাফর

 শিক্ষার্থী,

বাংলা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ।