দুর্গাপূজার পরে পশ্চিমবঙ্গে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা

দুর্গাপূজার পরে পশ্চিমবঙ্গে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা

অন্যান্য বছর যেভাবে পুজোর কেনাকাটা করেন মানুষ, অবস্থা এবারও অনেকটা এরকমই

হিন্দু বাঙালির সবথেকে বড় উৎসব দুর্গাপুজোর সময়ে পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক হারে করোনা সংক্রমণ বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।যদিও রাজ্য সরকার পুজোর উদ্যোক্তাদের বেশ কিছু সাবধানতা অবলম্বন করার নির্দেশ দিয়েছে, কিন্তু উৎসবের আমেজে রাস্তায় বেরিয়ে পড়া সাধারণ মানুষকে দূরত্ব বিধি সহ নানা নিয়ম কতটা মানানো যাবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে সব মহলেই।কদিন ধরেই সামাজিক মাধ্যমে একটি ছবি ঘুরছে, যেখানে কলকাতার একটি নামী জুতোর দোকানে প্রচুর মানুষের ভিড় দেখা যাচ্ছে।

শুধু ওই একটি দোকানে নয়, পুজোর আগে নতুন জামাকাপড় কেনার জন্য উত্তর কলকাতা থেকে দক্ষিণ কলকাতা- সব শপিং মল আর বাজারেই থিক থিক করছে মানুষ।সামাজিক দূরত্ব বিধি মানা তো হচ্ছেই না, বরং অনেকেই মাস্ক ছাড়াই ওইসব বাজারে ঘুরছেন।

কলকাতার বাসিন্দা এক গৃহবধূ রাতুলা চ্যাটার্জী বলছিলেন, "আমি পুজোর শপিং করতে বেরইনি। কিন্তু রাস্তায় যাওয়া আসার সময়ে যা দেখছি, তাতে ভয়ই হচ্ছে। নিউ মার্কেট থেকে শুরু করে গড়িয়াহাট - সব জায়গাতেই ব্যাপক ভিড়। আর মাস্ক নেই বহু মানুষের মুখেই।"যে হারে পুজোর বাজার করতে বেরচ্ছেন মানুষ, তা দেখে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ধারণা পুজোর দিনগুলোতেও দলে দলে মানুষ বেরিয়ে পড়বেন। আর তা থেকে বহু মানুষ করোনা সংক্রমিত হবেন।

"আসলে লকডাউনের গোড়ার দিকে মানুষের মনে যে ভয়টা ছিল, সেটা এখন অনেকটাই কেটে গেছে। সবার মধ্যেই একটা ডোন্ট কেয়ার মনোভাব। আমার বন্ধুরাই তো পুজোর মধ্যে সবাই একসঙ্গে ঘোরার প্ল্যান করছে। আমি যাব না বলে দিয়েছি," জানাচ্ছেন মিসেস চ্যাটার্জী।

'প্যানডেমিক ফেটিগ'

চিকিৎসকরা এই মনোভাবটাকে বলছেন 'প্যানডেমিক ফেটিগ' বা মহামারির অবসাদ।কলকাতার নামী চিকিৎসক ডা. কুণাল সরকার বলছিলেন, "দীর্ঘদিন ধরে একটা মহামারির পরিবেশে কাটাতে কাটাতে এরকম একটা ফ্যাটিগ (অবসাদ) আসে। তার ফলে যেটা হবে, সাবধানতায় ঘাটতি হবে, বহু মানুষ পুজো প্যান্ডেলে প্রবেশের জন্য লাইন দেবেন - গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে, জোরে কথা বলতে হবে, কারণ মাইক বাজবে - আর তা থেকেই এরোসল ছড়াবে। আমরা হয়তো মুখে রঙবেরঙের মাস্ক পরে থাকব, কিন্তু একই সঙ্গে সংক্রমিতও হয়ে যাব।"

তিনি আরও বলছিলেন, যারা পুজোর উদ্যোক্তা বা পুরোহিত, তারাও যে আক্রান্ত নন, তারও তো নিশ্চয়তা নেই। তাদের থেকেও সংক্রমণ ছড়াতে পারে।

"এই ধরনের ঘটনাকে ডাক্তারি পরিভাষায় 'সুপার-স্প্রেডার' বলা হয়। কলকাতার মতো ঘনবসতিপূর্ণ একটা শহরে গোটা দশেক সুপার-স্প্রেডারের ঘটনা হলে পরিস্থিতি যা দাঁড়াবে, তা থেকে মা দুর্গা তার দশ হাত দিয়েও রক্ষা করতে পারবেন বলে মনে হয় না," বলছিলেন ডা. সরকার।দুর্গাপুজোর বাকি আর সপ্তাহ দুয়েক। কিন্তু ইতিমধ্যেই পুজোর প্রস্তুতি চলছে জোরকদমে।

বেশিরভাগ উদ্যোক্তাই অন্যান্য বারের তুলনায় অনেক ছোট করে পুজো করার পরিকল্পনা নিয়েছেন। অনেক বড় পুজোই এবার প্রতিমার আকারও ছোট করে দিচ্ছে।আবার সরকারও বেশ কিছু নিয়ম বেঁধে দিয়েছে।

পুজোর ভিড় নিয়ন্ত্রণ করা এবং মণ্ডপে ঢোকার আগে মাস্ক পরা এবং হাত স্যানিটাইজ করার মতো বেশ কিছু নিয়ম করেছে রাজ্য সরকার। আবার মণ্ডপগুলিও খোলামেলা রাখার কথা বলা হয়েছে। উদ্যোক্তারা বলছেন সেই সব নিয়ম তারা মানবেন, কিন্তু রাস্তায় যে লাখ লাখ মানুষ বেরিয়ে পড়বেন পুজোর দিনগুলোতে, তা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে বা তাদের কীভাবে নিরাপদে রাখা সম্ভব হবে?

অন্য রাজ্যের অভিজ্ঞতা থেকে আশংকা

কলকাতার সার্বজনীন পুজো কমিটিগুলির সংগঠন ফোরাম ফর দুর্গাপুজোর সাধারণ সম্পাদক শাশ্বত বসু বলছেন তারা চেষ্টা করবেন তাদের মত করে, কিন্তু মানুষকেও নিজেদের নিরাপদ রাখার দায়িত্ব নিজেদের নিতে হবে।

"লকডাউনের মধ্যেও তো দেখেছি দুটো ঝিঙে বা তিনটে ডিম কিনতে লোকে রোজ বেরিয়েছে। মানুষের মধ্যে অসচেতন মনোভাব তো আছেই। সরকার তো বারবার সাবধান করছে, কিন্তু মানুষ কি শুনছে? তাই পুজোর মণ্ডপ, তার আশপাশের এলাকায় আমরা ঠিকমতো মাস্ক পরতে বাধ্য করব, থার্মাল স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে আর স্যানিটাইজারও থাকবে। কিন্তু তার বাইরে বাকি শহরের দায়িত্ব পুজোর উদ্যোক্তাদের কীভাবে নেওয়া সম্ভব?" বলছেন মি. বসু।

"এবার সব পুজোই আলোর চাকচিক্য অনেকটা কম করে দিয়েছে। যাতে সন্ধ্যা বা রাতের বেলায় মানুষ আলোর কাজ দেখতে বেশি না বেরন। দিন আর রাতে যাতে দর্শকদের সংখ্যাটা সমানভাবে ছড়িয়ে দেয়া যায়, তার জন্যই এটা করা।"

মহারাষ্ট্রের বড় ধর্মীয় পুজো গণেশ উৎসব বা গুজরাতের নবরাত্রিতে গরবা নাচের উৎসব - এ সবই বন্ধ করে দিয়েছে ওই সব রাজ্যের সরকার। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, আসাম সহ আরও বেশ কিছু রাজ্য সরকারও বিধিনিষেধ আরোপ করেছে দুর্গাপুজোর ওপরে।এর আগে কেরালার বড় উৎসব ওনামে ছাড় দেওয়ার পরেই দেখা গেছে সে রাজ্যে করোনা সংক্রমিতের সংখ্যা একলাফে ৭৫০ % বেড়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গে যে সেরকম কিছু হবে না -- তার নিশ্চয়তা নেই বলেই মনে করেন চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

'দুর্গাপুজোর উৎসব এবার বাড়িতেই করা উচিত ছিল'

ইন্ডিয়ান পাবলিক হেল্থ এসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. সঙ্ঘমিত্রা ঘোষের প্রশ্ন ''একবছর যদি পুজোর আনন্দ না করা হতো, খুব ক্ষতি কি হত? সুস্থ থাকলে তো আগামী বছরও সেটা করা যাবে।''

তার কথায়, "করোনা প্রতিরোধ করার যে তিনটি সাধারণ নিয়ম - মাস্ক পরা, বারেবারে হাত ধোয়া আর দূরত্ব বজায় রাখা - এগুলো কি পুজোর বাজার করার সময়ে বা পুজোর সময়ে কেউ মেনে চলবেন? মনে তো হয় না।"

"সরকারই বা কেন যে এবছর দুর্গাপুজোয় এত উৎসাহ দিচ্ছে বুঝতে পারছি না। একবছর না হয় নতুন জুতো নতুন জামা না-ই কিনতাম, এবছর না হয় বাড়িতে বসেই পুজোর আনন্দ উপভোগ করতাম। বেঁচে থাকলে তো আগামী বছরও এগুলো করা যাবে," বলছিলেন ডা. ঘোষ।

শাশ্বত বসু অবশ্য বলছিলেন, "এবছর পুজোটা করার একটা উদ্দেশ্য হচ্ছে যে কয়েক লক্ষ মানুষ (আয়ের জন্য) এই দুর্গাপুজোর ওপরেই অনেকটা নির্ভর করেন - যেমন প্রতিমাশিল্পী, ডেকরেটারের কর্মী, আলো শিল্পীরা - এদের অবস্থা তো খুবই করুণ হয়ে গেছে। এমনিতেই লকডাউনের জন্য অর্থনীতির দুরাবস্থা - তার ওপরে যদি পুজো থেকে কিছু রোজগার না করতে পারেন এই মানুষরা, তাদের কী অবস্থা হবে!"  সূত্র:বিবিসি