শ্বেত রোগ থেকে মুক্তি সম্ভব!

০৬ ডিসেম্বর, ২০২০

শ্বেত রোগ বা শ্বেতি যার মেডিক্যালের ভাষায় ভিটিলিগো বলা হয়। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, রোগ হিসেবে এটি সাধারণ এবং আক্রান্তদের স্বাভাবিক কাজেও অসুবিধা হয় না। কিন্তু চামড়ার রং পরিবর্তনে চেহারাটাই যেহেতু পাল্টে যায়, তাই স্বাভাবিক জীবনের চলনে কোথাও যেন ছন্দপতন ঘটে।  

এর একটি বড় কারণ, রোগটি সম্পর্কে চারপাশের মানুষের ভুল ধারণা। এটি বংশগত বা ছোঁয়াচে নয়। অনেকেই ভাবেন, এ রোগ থেকে মুক্তি সম্ভব নয়। আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে শরীরের যে কোনও জায়গার শ্বেতি দূর করা যায়। প্রয়োজন শুধু সময় ও ধৈর্য। শিশুদের মধ্যে ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে শ্বেতি সেরে যায়। বাচ্চাদের শরীরের চামড়ার ৮০ শতাংশের কম অংশে রোগটি হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দু’আড়াই বছরের মধ্যে তা সেরে যায়। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যথাযথ চিকিৎসায় বছর পাঁচেকের মধ্যে ৪০-৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে শ্বেতি সেরে যায়। খুব কম ক্ষেত্রেই রোগটি পুনরায় ফিরে আসতে দেখা গিয়েছে। 

রোগের লক্ষণ ও কারণ

এটি এক ধরনের অটো ইমিউন ডিজিজ। প্রথম দিকে শরীরের নানা অংশে এক বা একাধিক ছোট দাগ হতে দেখা যায়। চামড়ার রং সাদা ও মসৃণ হয়ে যাওয়া ছাড়া, এ রোগের আর কোনও লক্ষণ নেই। রোগটি আঙুলের ডগা বা ঠোঁটের কাছ থেকে শুরু হলে এবং ত্বকের যে সব অংশে লোম থাকে না, সেখানে হলে, সারতে অনেক সময় লাগে। তবে শ্বেতি হতে পারে শরীরের যে কোনও অংশে। ঠোঁট, মুখ ও পিঠে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বাচ্চাদের আবার মুখ, চোখের পাশ, আঙুলের ডগায় ও ঠোঁটে বেশি হয়।  

রোগটির কারণ প্রসঙ্গে কোলকাতার ত্বকবিশেষজ্ঞ ডা. সন্দীপন ধর বললেন, ‘‘আমাদের ত্বকের রং তৈরি করতে সাহায্য করে মেলানোসাইট কোষে থাকা মেলানিন নামে এক ধরনের রঞ্জক পদার্থ। অনেক সময়ে শারীরিক সমস্যার কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ শক্তি বা অ্যান্টিবডি ত্বকের রং তৈরি করা এই কোষগুলিকে শত্রু মনে করে ধ্বংস করতে থাকে। এবং ত্বক তার স্বাভাবিক রং হারাতে থাকে। এরই ফল শ্বেতি হয়। এতে শুধু ত্বকই নয়, অনেক সময়ে চুল এবং লোমও সাদা হয়ে যায়। প্রভাব পড়ে চোখের মণির উপরে। মনে রাখা জরুরি, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় শ্বেতি হয় না। বাইরে বের হওয়া হওয়ার সময়ে ক্যামোফ্লাজ ক্রিম লাগানোর পরামর্শ দিই, যাতে রোগীকে অস্বস্তিতে পড়তে না হয়।’’ 

শ্বেতি সাধারণত দু’রকমের হয়, র‌্যাপিডলি স্প্রেডিং ভিটিলিগো (রোগ দ্রুত ছড়ায়) এবং ইনসিডিয়াস ভিটিলিগো (ধীর গতিতে ছড়ায়)। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে দু’-চার বছর অন্তর একটি করে প্যাচ দেখা যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগ দেরিতে ছড়ায়। উডস ল্যাম্প চেকিং করে বোঝা যায়, সাদা দাগটি আদৌ শ্বেতি কি না। 

সাবধানতা  
বিভিন্ন ধরনের মেকআপে থাকা রাসায়নিক পদার্থ দীর্ঘ সময় ধরে ত্বকের সংস্পর্শে এলে, তা থেকেও ভিটিলিগো হতে পারে। একে কেমিক্যাল লিউকোডার্মা বলে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, আক্রান্ত ব্যক্তির গায়ের রং খুব ফর্সা হওয়ার কারণে রোগ ধরা পড়েনি। তাই শরীরের কোথাও সাদা দাগ দেখলে ডার্মাটোলজিস্টের পরামর্শ নিন। তবে ভিটিলিগো আক্রান্ত ব্যক্তি কখনওই খুব চেপে বেল্ট পরবেন না বা দড়ি বাঁধবেন না। গরম জিনিস হাতে ধরবেন না। রান্না করার সময়েও সাবধানে থাকতে হবে। ফোসকা পড়লে সেখানকার রং ফিরে নাও আসতে পারে। পুরুষদের মুখে শ্বেতি ধরা পড়লে, সেই অংশে দাড়ি কাটা উচিত নয়। কারণ দাড়ি কাটতে গিয়ে কোনও ক্ষত সৃষ্টি হলে সেখান থেকে শ্বেতি সারা দেহে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই সেখানে ট্রিম করে নিতে হবে। এ রোগ হলে হাতে নখ রাখা চলবে না। ফেসিয়াল বা অন্য বিউটি ট্রিটমেন্টও করানো চলবে না। রোদে বের হওয়ার আগে সানস্ক্রিন লাগানো ও  সানগ্লাস পরা জরুরী।
 
চিকিৎসা
ওষুধ ও অস্ত্রোপচার দু’ভাবেই এ রোগের চিকিৎসা হতে পারে। ডা. ধর বললেন, ‘‘ত্বকের স্বাভাবিক রং ফিরিয়ে আনতে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ও ক্রিম দেওয়া হয়। কিছু ক্ষেত্রে ফোটোকেমোথেরাপিও করানো হয় বা আক্রান্ত অংশে ওষুধ লাগিয়ে রোদে দাঁড়িয়ে অতিবেগনি রশ্মিও নিতে বলা হয়। ওষুধ খাওয়ার পরেও যদি রোগটি ঠোঁট ও আঙুলের ডগায় ছড়িয়ে যায়, তখন স্কিন গ্রাফ্টিং করা হয়।’’

গ্রাফ্টিং তিন ভাবে করা হয়। অটোলোগাস স্কিন গ্রাফ্টিংয়ে থাই থেকে চামড়া তুলে এনে বসানো হয়। তবে যেখান থেকে চামড়া তোলা হল এবং যেখানে তা প্রতিস্থাপন করা হল, এই দু’জায়গায় সংক্রমণের ভয় থাকে। আর একটি পদ্ধতিতে, ত্বকের স্বাভাবিক রং যেখানে আছে, সেখানে ব্লিস্টার্স তৈরি করে, তার উপরের অংশ কেটে আক্রান্ত চামড়ায় লাগানো হয়। একে বলা হয় স্কিন গ্রাফ্টস উইথ ব্লিস্টার্স। আর একটি পদ্ধতি হল অটোলোগাস মেলানোসাইট ট্রান্সপ্লান্ট। যদিও এটি এখনও পরীক্ষানিরীক্ষার স্তরে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কৃত্রিম ভাবে মেলানোসাইট তৈরি করে প্রতিস্থাপন করা হয়।  

কখন সমাধান সম্ভব নয়?  
• প্রথম থেকে ঠিক মতো চিকিৎসা না করালে। কিছু দিন হয়তো এক রকম চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করলেন, তার পর আর এক রকম— সে ক্ষেত্রে রোগটি এমন জায়গায় চলে যায় যে, কিছু করার থাকে না। 

• রোগটি দ্রুত শরীরের নানা অংশে ছড়িয়ে পড়লে সারানো মুশকিল । 

• ভিটিলিগোর সঙ্গে কারও যদি থাইরয়েড, ডায়াবিটিস, অ্যাজমা, এগজিমা বা অন্য অটোইমিউন ডিজিজ থাকে, যা শ্বেতির চিকিৎসাকে প্রভাবিত করতে পারে, তা হলে রোগটি সারানো সহজ নয়।  

ডা. ধরের কথায়, ‘‘ভিটিলিগো সম্পর্কে মেডিক্যাল টার্মে বলা হয়, ইট ইজ ফিজিক্যালি বিনাইন বাট সাইকোলজিক্যালি ম্যালিগন্যান্ট ডিজিজ। মানসিক ভাবে এটি ক্যানসারের মতোই। কিছু ক্ষেত্রে মানসিক সমস্যা এত বেড়ে যায় যে, ডার্মাটোলজিস্টের পাশাপাশি রোগীকে মনোবিদের সঙ্গে পরামর্শ করতেও বলা হয়।’’

তাই এ রোগে আক্রান্তকে মানসিক ভাবে বল জোগানোটা খুব জরুরি। তাঁকে দূরে ঠেলে না দিয়ে রোগটিকে জয় করার সাহস জোগান। মানসিক শক্তি পেলে অসুখের মোকাবিলাও সহজ হবে। সূত্র: আনন্দবাজার