২৭ এপ্রিল, ২০২২
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে প্রতিবেশী ভারতের সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। যদিও সাবেক কূটনীতিক ও বিশ্লেষকরা বলছেন প্রকাশ্যে এ ধরণের মন্তব্যই দেশের জন্য 'অসম্মানজনক' এবং ভারত বা তৃতীয় কোন দেশের এ বিষয়ে কিছু করারও নেই বলে মনে করেন তারা।
বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা কীভাবে প্রত্যাহার হতে পারে সেটি যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষই স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে এবং সে কারণেই ভারত বা অন্য কারও এতে কোন কিছু করার সুযোগই নেই।একই ধরণের মন্তব্য করে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলছেন যে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক দিয়েই এ সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে।
প্রসঙ্গত, গত বছর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে 'গুরুতর মানবাধিকার লংঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার' অভিযোগে বাংলাদেশের বিশেষ পুলিশ র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং এর সাতজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র।
এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বারবার অনুরোধ করা হলেও ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের নতুন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস গত সপ্তাহেই বলেছেন যে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার সুস্পষ্ট পদক্ষেপ ছাড়া র্যাবের প্রতি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার তার দেশের পক্ষে সম্ভব নয়।
নিষেধাজ্ঞা যে কারণে দেয়া হয়েছিলো
গত ডিসেম্বরে নিষেধাজ্ঞার খবর জানিয়ে তখন মার্কিন অর্থ দফতর বলেছিলো যে তাদের ফরেন অ্যাসেটস কনট্রোল অফিস (ওএফএসি) বিভিন্ন দেশের মোট দশটি প্রতিষ্ঠান ও পনের জন ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে - যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নিপীড়নের সাথে সংশ্লিষ্ট।এই তালিকাভুক্তদের অন্যতম হলেন বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর বর্তমান প্রধান বেনজির আহমেদ ছাড়াও র্যাব ও এর ছয়জন কর্মকর্তা।
বিজ্ঞপ্তিটিতে বলা হয়, বাংলাদেশের বেসরকারি সংগঠনগুলো অভিযোগ করেছে যে র্যাব এবং অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ২০০৯ সাল থেকে প্রায় ৬০০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ৬০০-রও বেশি লোকের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, এবং নির্যাতনের জন্য দায়ী।কিছু রিপোর্টে আভাস পাওয়া যায় যে এসব ঘটনায় বিরোধীদলীয় সদস্য, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের টার্গেট করা হয়েছে - বলা হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
সরকার যা বলেছে
মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে তুমুল শোরগোলের মধ্যে গত ২৬শে জানুয়ারি জাতীয় সংসদে বিবৃতি দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন।
ওই বিবৃতিতে এই নিষেধাজ্ঞার জন্য বারটি এনজিওকে দায়ী করেন তিনি। তার মতে, "১২টি আন্তর্জাতিক এনজিও জাতিসংঘের পিসকিপিংয়ের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেলকে একটি চিঠি লিখেছে। তারা চিঠিতে বিভিন্ন ধরনের প্রপাগান্ডা ও স্পেকুলেশন তুলে ধরে বলেছেন, র্যাব বিভিন্ন রকম হিউম্যান রাইটস ভঙ্গ করছে"।
তিনি বলেন , "সঠিক তথ্য পৌঁছাতে পারলে যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয়ই র্যাবের ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে। তবে তার জন্য কিছু সময় লাগবে"।র্যাবের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে সরকার কাজ করছে বলেও সংসদকে অবহিত করেন মিস্টার মোমেন। তবে এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনকে চিঠি দিয়ে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে অনুরোধ করেছিলেন তিনি।
এরপর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে মিস্টার মোমেনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দল যুক্তরাষ্ট্র যায় এবং সেখানে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠকেও প্রসঙ্গটি উঠে আসে।এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক 'বেগবান'করতে একটি লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ দেয়ার কথা জানান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।তিনি জানান, বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল ধারণা ও বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার বন্ধ করার লক্ষ্যে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।'
যদিও বিশ্লেষকরা সবসময়ই বলে আসছেন যে এ বিষয়টির সাথে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক ইস্যু জড়িত আছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাব ও এর কর্মকর্তাদের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেবার ইস্যুটিকে বাংলাদেশের উপর আমেরিকার একটি 'চাপ সৃষ্টি'র কৌশল।
ভারতের সমর্থন চাওয়ার কথা জানালেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মঙ্গলবার সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান যে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য বাংলাদেশ ভারতের সমর্থন চেয়েছে।
তিনি বলেন, "যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর, আমরা তাদের (ভারতের) সাহায্য চেয়েছিলাম। তারা আমাদের প্রতি খুব আন্তরিক। তারা (ভারতীয় পক্ষ) বলেছে তারা এ বিষয়ে আলোচনা করবে"।তিনি বলেন, আমেরিকায় ৪৫ লাখ ভারতীয় বাস করে এবং তারা খুবই প্রভাবশালী।প্রসঙ্গত আগামী ২৮শে এপ্রিল একদিনের সফরে ঢাকায় আসছেন ভারত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শংকর।
কিন্তু ভারতের কী কিছু করার আছে?
সাবেক কূটনীতিক ও বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই দেশ দুটি একযোগে কাজও করছে।
তাছাড়া নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে মার্কিন কর্মকর্তারা ঢাকা ও ওয়াশিংটনে বারবার বলেছে যে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার জটিল প্রক্রিয়া। এটি চাইলে কী করতে হবে সেটিও তারা পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছে।এ অবস্থায় তৃতীয় দেশের এখানে কিছু করণীয় আছে বলে তারা মনে করেন না।
"অদ্ভূত" ও "সম্মানজনক নয়"
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলছেন এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ভারতের কাছে সহযোগিতা চাওয়াটাই অদ্ভূত মনে হয়েছে তার কাছে।তিনি বলছেন যে আমেরিকানরা তো আগেই বলেছে যে তারা এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ দেখতে চায়, সেখানে ভারত বা অন্য কোন দেশ আর কী করতে পারে।
"বাংলাদেশের সাথে তো যুক্তরাষ্ট্রর পরোক্ষ সম্পর্ক না যে অন্য দেশকে মধ্যস্থতা করতে হবে। যেমন ধরুন যুক্তরাষ্ট্রের কোন স্বার্থ ইরানে থাকলে হয়তো তারা তৃতীয় দেশের মাধ্যমে ইরানের সাথে কথা বলে - কারণ দেশটির সাথে তাদের স্বাভাবিক সম্পর্ক নেই। কিন্তু বাংলাদেশের তো যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অ্যাকটিভ সম্পর্ক আছে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।মিস্টার হোসেন বলেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য ভারতের সাথে সহযোগিতা চাইতে হবে কেন আর তারাই বা কিভাবে সহযোগিতা করবে সেটা বোঝা কঠিন।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির অবশ্য বলছেন, অনেক দেশ অনেক সময় কূটনীতির বাইরেও অনানুষ্ঠানিক ভাবে অনেকের সহযোগিতা নেয় কিন্তু সেটা সাধারণত প্রকাশ্যে আসে না।"এখানে আনুষ্ঠানিক কূটনীতিতে ভারতের কাছ থেকে এ ধরণের সহযোগিতা চাওয়ার প্রয়োজন ছিলো না। এটা সম্মানজনকও না। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র কুটনীতির মাধ্যমেই এর সমাধান খুঁজে পেতে পারে"।
সূত্র : বিবিসি