জাপোরিশায় আবারো ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, একজন নিহত, বহু ভবন ক্ষতিগ্রস্ত

১১ অক্টোবর, ২০২২

ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলের জাপোরিশা শহরে মঙ্গলবার নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে। এতে এখনো পর্যন্ত এক জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।দেশটির জরুরি সেবা বিভাগ জানিয়েছে, সরকারি ভবন লক্ষ্য করে কমপক্ষে ১২টি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে।

উদ্ধারকর্মীরা প্রায় ১০০ বর্গমিটার এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়া একটি আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছে।জাপোরিশার আঞ্চলিক গভর্নরের একটি টেলিগ্রাম পোস্ট থেকে জানা যায়, এতে একটি স্কুলও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।মস্কো এখনো এ ঘটনায় কোন মন্তব্য করেনি।

এর আগে ইউক্রেনে মঙ্গলবার সকালেও বিমান হামলার সতর্ক সংকেত হিসেবে বাজানো সাইরেন বাজানোর শব্দ শোনা গেছে। বাসিন্দারা নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান নিয়েছেন বলেও খবর পাওয়া যাচ্ছে।

রাশিয়া ইউক্রেনের রাজধানীসহ আরো বেশ কিছু এলাকা লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর পরের দিনই বোমা হামলার এই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।এদিকে সোমবার রাশিয়ার ওই হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৯ জনে দাঁড়িয়েছে। ইউক্রেনের জরুরি সেবা বিভাগ এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। এছাড়া ইউক্রেনজুড়ে আরো ১০৫ জন আহত হয়েছে বলেও জানানো হয়।

বিবিসির প্রতিনিধি হুগো বাচেগা যিনি গতকাল রাশিয়ার হামলার সময়ে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি জানান, মঙ্গলবারও হামলার আশঙ্কায় কিয়েভের একটি ভূগর্ভস্থ গাড়ি পার্কিং এলাকা থেকে খবর প্রচার করছেন।

ইউক্রেনের সকাল

অ্যাপোস্ট্রফ টিভি নিউজ সার্ভিস নামে একটি গণমাধ্যম জানিয়েছে যে, বোমারু বিমান থেকে সোমবার ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে। হুঁশিয়ার করে বলা হচ্ছে যে,এ ধরণের আরো হামলা আসতে পারে।

ইউক্রেনের জাপোরিশা শহরের কর্তৃপক্ষ বলছে, শহরটির বেশ কিছু অবকাঠামোতে রাতভর রাশিয়া গুলি চালিয়েছে। এতে একটি স্কুল, একটি হাসপাতাল এবং আবাসিক এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা থেকে গুলি শুরু করে রাশিয়া। তবে এতে ক্ষয়ক্ষতি বা হতাহতের বিষয়ে এখনো কিছু জানা যায়নি।এ বিষয়ে এখনো কোন মন্তব্য করেনি মস্কো।

কিয়েভ থেকে বিবিসির লাইভ খবর চলার সময় বিস্ফোরণের শব্দমঙ্গলবার সকালে টেলিগ্রামে সেন্ট্রাল ভিনিৎসিয়া এলাকা গভর্নর সেরহি বরজভ দাবি করেন, সেখানকার লেডিজিন পাওয়ার স্টেশনে ইরানে তৈরি শাহিদ-১৩৬ কামিকেজ ড্রোনের মাধ্যমে হামলা চালিয়েছে রাশিয়া।

ভোরে, ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পাঁচটি শাহিদ-১৩৬ কামিকেজ ড্রোনকে ভূপাতিত করেছে। ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলের অপারেশনাল কমান্ড বলেন, ওডেসা এলাকাতে আরো তিনটি ড্রোনকে ভূপাতিত করা হয়েছে।ভলোদিমির জেলেনস্কি এরইমধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে টেলিফোনে আলাপ করেছেন। সেখানে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্ব এবং ইউক্রেনের সক্ষমতা বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন।

বিদ্যুৎ বিভ্রাট

রাশিয়ার হামলার কারণে ব্যাপক বিদ্যুৎ বিভ্রাটের পর, জেলেনস্কি স্থানীয় সময় বিকেল পাঁচটা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বাসিন্দাদের জন্য "কাপড় ধোয়া ও ইস্ত্রি করা" থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। যাতে ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উপর চাপ কমানো যায় এবং এই বিদ্যুৎ অন্যরা ব্যবহারের সুযোগ পান।

হামলার পর ইউক্রেনের সেতুগুলো অন্ধকারে ডুবে যায় এবং কিয়েভে রাস্তার আলো কমিয়ে আনা হয়। এই সময়ে ওডেসা এবং অন্যান্য শহরগুলি তাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল।

ইউক্রেনীয় শক্তি সংস্থা কিয়েভ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের তাদের "দৃঢ় সমর্থন"-এর জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছে যে, তারা নিয়মিত শরতের দিনের তুলনায় ২৬.৫% কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করেছে।সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং জনপ্রিয় ফেসবুক ব্লগার সার্জ মার্কো, বেসামরিক অবকাঠামোতে হামলাকে "কৌশলগত ক্ষেপণাস্ত্রের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এবং অপরিকল্পিত ব্যবহার" বলে বর্ণনা করেছেন।

তিনি বলেন, রাশিয়ানদের উজ্জীবিত করার যে প্রাথমিক উদ্দেশ্য এটি করা হয়েছে তাতে এটি কোন পরিবর্তন আনবে না।টেলিগ্রামে সামরিক বিশেষজ্ঞ ওলেক্সান্ডার কোভালেঙ্কো বলেছেন যে, এটি পুতিনের শাসনামলের "রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনির মতো মনে হলেও এটা আসলে মৃত্যুযন্ত্রণার মতো।"

ইউক্রেনে মাসের পর মাস ধরে রাশিয়ার হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কিয়েভকে উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেয়ার অঙ্গীকারের কথা জানিয়েছে।সোমবার ইউক্রেনের বিভিন্ন স্থানে ৮০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার পর এমন অঙ্গীকারের কথা জানালেন বাইডেন।

প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেছেন, রাশিয়ার সর্বশেষ হামলায় ভীত হবে না ইউক্রেন। গতরাতে দেয়া এক ভাষণে তিনি জোর দিয়ে বলেন, ইউক্রেন এখন আগের চেয়েও বেশি ঐক্যবদ্ধ এবং রাশিয়ার আক্রমণ প্রতিহত করা হবে।

রাশিয়ার ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইউক্রেনের জ্বালানী অবকাঠামোগুলোতে আঘাত হেনেছে। এর ফলে অনেক এলাকা বিদ্যুৎ ও পানি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।কিন্তু মি. জেলেনস্কি জানিয়েছেন, এগুলো পুননির্মাণের কাজ চলছে।

বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল যিনি রাশিয়ায় মার্কিন দূতাবাসের প্রতিরক্ষা বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন তিনি বলেন, তিনি মনে করেন যে এটি যুদ্ধের নতুন ধাপের সূচনা।

রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত হানা একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেছেন, ইচ্ছা করেই সকালের ব্যস্ততম সময়ে হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। তিনি একে চিরাচরিত সন্ত্রাসী হামলা বলেই উল্লেখ করেছেন। যার উদ্দেশ্যই হচ্ছে বেশি মানুষকে আক্রান্ত করা এবং ভীতি ছড়ানো।বেশ কয়েকটি শহর আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রাস্তার ব্যস্ততম পারাপার, পর্যটক এলাকা এবং পার্ক।দক্ষিণাঞ্চলের জাপোরিশা শহরের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে, শহরটিতে রাতভর রাশিয়া গোলাগুলি চালিয়েছে।

রাশিয়া যা বলছে

এদিকে সংবাদ মাধ্যম আরআইএ-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে যে, রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকভ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং নেটোর সাথে সরাসরি সংঘাতে জড়ানোতে মস্কোর কোন আগ্রহ নেই। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমাদের ক্রমবর্ধমান সংশ্লিষ্টতার জবাব দেবে তারা।

"আমরা সতর্ক করছি এবং আশা করছি যে, ওয়াশিংটন এবং অন্য পশ্চিমা রাজধানীতে অনিয়ন্ত্রিত উত্তেজনার পরিণাম সম্পর্কে তারা ধারণা রয়েছে," বলেন মি. রিয়াবকভ।রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যেকোন ধরণের হামলার জবাবে আরো পাল্টা হামলা চালানোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

সোমবারের হামলাকে তিনি শনিবারে ক্রাইমিয়ার সাথে রুশ সংযোগ সেতুতে চালানো বোমা হামলার জবাব বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।ইউক্রেনের পার্লামেন্ট সদস্য কেয়ারা রুডিক বলেছেন, রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জন্য যথাযথ প্রস্তুতি নিতে পারেনি কিয়েভ।ইউক্রেন অ্যানালিটিকার নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. হ্যানা শেলেস্ট বলেন, রুশ হামলার মূল লক্ষ্য ছিল বিদ্যুৎ ও পানির সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করা।

বিশ্ব নেতাদের প্রতিক্রিয়া কী?

এপিপি'র খবরে বলা হয়েছে যে, ইউক্রেনজুড়ে রাশিয়ার বোমা হামলার পর জরুরি বৈঠকে বসতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও জি-সেভেন ভুক্ত দেশগুলোর নেতারা।এই বৈঠকে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস বিশ্বনেতাদের ইউক্রেনের পাশে থাকার আহ্বান জানাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

রাশিয়ার হামলার পর জার্মানি জানিয়েছে যে, তারা এর আগে ইউক্রেনকে যে অস্ত্র দেয়ার অঙ্গীকার করেছিল সেগুলো সরবরাহের প্রক্রিয়া দ্রুততম করবে।হামলার পর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের জরুরি অধিবেশনে ইউক্রেনের দূত সের্গেই কিসলিৎসিয়া দেশটির চারটি এলাকাকে মস্কোর অন্তর্ভূক্তিকরণের ঘোষণা নিয়ে বিতর্কের আহ্বান জানান।

 

তিনি বলেন, "দুঃখজনকভাবে, যতক্ষণ পর্যন্ত আশেপাশে একটি অস্থিতিশীল এবং অযৌক্তিক একনায়কতন্ত্র থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত স্থিতিশীলতা এবং শান্তির আহ্বান জানানোটা কঠিন।"জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সোমবারের অধিবেশনের আগে সাম্প্রতিক হামলাকে "যুদ্ধের অগ্রহণযোগ্য অগ্রগতি" হিসেবে উল্লেখ করেছেন বলে জানিয়েছেন তার মুখপাত্র।

তবে রাশিয়ার প্রতিনিধি ভাসিলি নেবেনজিয়া অধিবেশনে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কথা সরাসরি উল্লেখ করেননি। তিনি ইউক্রেনের অঞ্চলগুলোকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, "ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে আমাদের ভাই-বোনদের রক্ষার উদ্দেশ্যে" এটি করা হয়েছিল।

ইউক্রেনীয়রা কী বলছেন?

সোমবারের হামলার পর ইউক্রেনের বাসিন্দারা শোক ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।কিয়েভের একটি হামলার কথা উল্লেখ করে ২২ বছরের ইভান পলিয়াকভ এমন ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন যে তিনি তা বর্ণনা করার শব্দ খুঁজে পাচ্ছিলেন না।বার্তা সংস্থা এএফপি-কে তিনি বলেন, "আমি নারী আর শিশুদের কাঁদতে দেখেছি।"

"আমি কিয়েভকে ভালবাসি। মানুষগুলো অনেক ভাল। তারা সাহসী। কিন্তু ওই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল...এটাই মৃত্যু।"দনিপ্রো শহরে, ছয় মাস ধরে যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা সেনা ম্যাক্সিম প্রথমবারের মতো ছুটিতে বাড়ি ফিড়ে যান তার স্ত্রীর জন্মদিন উদযাপন করতে। কিন্তু সেখানেও রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তাদের বাড়ি-ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তিনি বলেন, "আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে লড়ে যাচ্ছি এই জায়গাগুলোকে রক্ষার জন্য" যেগুলো শত্রুশিবির থেকে বেশ দূরে অবস্থিত। "কিন্তু এখানেও তারা হামলা চালাতে সক্ষম হয়েছে।"তিনি বলেন এই হামলার কারণে তিনি আরো অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছেন যে রাশিয়ানদের আরো উত্তর-পূর্ব ইউক্রেনের দিকে ঠেলে দিতে হবে।

গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া আক্রমণ চালানোর পর থেকে ৭৬ লাখের বেশি ইউক্রেনের শরণার্থী ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছে। আর ইউক্রেনের মধ্যেই বাস্তুচ্যুত হয়েছে আরো ৭০ লাখ মানুষ।জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক নেতারা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, এই হামলার পর আরো মানুষ ইউক্রেন ছাড়তে পারে।

জেনেভায় জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর শরণার্থী বিষয়ক কমিশনার ফিলিপো গ্র্যান্ডি সাংবাদিকদের বলেন, "বেসামরিক নাগরিক, বসতবাড়িতে বোমা হামলা...ইউক্রেনের অনেক শহরের বেসামরিক অবকাঠামোতে নির্বিচারে হামলার মানে হচ্ছে, বেসামরিক নাগরিকদের জন্য যুদ্ধ আরো কঠিন হয়ে পড়ছে।""আমি আশঙ্কা করছি যে, এ ধরণের হামলা আরো বাস্তুচ্যুতির ঘটনা বাড়াবে।"

সূত্র : বিবিসি