ইসলামের দৃষ্টিতে যারা ভালো মানুষ

২০ জুন, ২০২৪

মানুষের দৃষ্টিতে ভালো মানুষের সংজ্ঞায় ভিন্নতা আছে। একেক জনের কাছে একেক রকমের মানুষ ভালো। আমরা এখানে দেখে নেব কোরআন-হাদিস কাদেরকে ভালো মানুষ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। নিচে তাদের পরিচয় তুলে ধরা হলো।

১. যারা নামাজে বিনয়ী হয়ে দাঁড়ায়
যারা নামাজে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে দাঁড়ায়, হাদিসের দৃষ্টিতে তারা নিতান্তই ভালো মানুষ। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যকার উত্কৃষ্ট হচ্ছে ওই সব লোক, যারা নামাজের মধ্যে নিজেদের কাঁধ বেশি নরম করে দেয়। (আবু দাউদ: ৬৭২)

বিনয়ী মানুষগুলো এমনিতেই আল্লাহর প্রিয়। আর নামাজে বিনয়ী হওয়া মানে তো বিনয়ের সর্বোচ্চ প্রকাশ। এ ধরণের মানুষগুলো একদিকে ভলো, অন্যদিকে সফল। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘অবশ্যই সফলকাম হয়েছে মুমিনরা, যারা নিজেদের নামাজে বিনয়-নম্র। ’ (সুরা মুমিনুন: ১-২)

২. যার অনিষ্ট থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদে থাকে
আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) বলেছেন, ‘মুসলিম (প্রকৃত) সেই, যার মুখ ও হাত থেকে মুসলমানরা নিরাপদ থাকে। আর (প্রকৃত) মুহাজির সেই, আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তা যে পরিত্যাগ করে।’ (বুখারি: ৬৪৮৪)
অপর বর্ণনায় আছে- নবী (স.)-কে প্রশ্ন করা হল যে, কোন ব্যক্তি মুসলিমদের মধ্যে সবচাইতে উত্তম? তিনি বললেন, যার জিহবা ও হাত থেকে মুসলিমগণ নিরাপদ থাকে। (তিরমিজি: ২৬২৮)

৩. দানশীল ব্যক্তি
যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বেশি বেশি দান-সদকা করে, তাদের হাদিসের ভাষায় ভালো মানুষ বলা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) সদকা এবং (কারো কাছে কিছু না) চাওয়া থেকে আত্মরক্ষার বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, ওপরের হাত নিচের হাত থেকে উত্তম। ওপরের হাত হলো (দাতার) ব্যয়কারীর হাত, আর নিচের হাত হলো প্রার্থীর (গ্রহীতার) হাত। (নাসায়ি: ২৫৩৩)

হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত ওমর (রা.) এর মতো সাহাবিরা আল্লাহর রাস্তায় অনেক বেশি খরচ করতেন। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নবী-রাসুলদের পরে তাঁদের চেয়ে ভালো মানুষ হয় না। তাঁদের দান নিয়ে অনেক হাদিস রয়েছে। (দেখুন: বুখারি: ২৭৩৭; তিরমিজি: ৩৬৭৫)

৪. যারা কোরআন শেখে ও শেখায়
উসমান (রা.) সূত্রে নবী (স.) বলেন, তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি সবচেয়ে উত্তম যে  কোরআন শেখে এবং অন্যকে শেখায়। (বুখারি: ৫০২৭)

৫. যে আগে সালাম করে
যারা পরিচিত অপরিচিত সবাইকে সালাম করে হাদিসের ভাষায় তাদের ভালো মানুষ বলা হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে জিজ্ঞাসা করল, কোন ইসলাম (অর্থাৎ ইসলামের কোন কর্ম) ভালো? তিনি বলেন, খাদ্য দান করা, পরিচিত অপরিচিত সবাইকে সালাম করা। (নাসায়ি: ৫০০০)

৬. যারা প্রথম কাতারে নামাজ পড়ে
ইখলাসের সঙ্গে যারা প্রথম কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করে, হাদিসের ভাষায় তাদের উত্তম মানুষ বলা হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, পুরুষদের সর্বোত্তম কাতার হচ্ছে প্রথমটি আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট হচ্ছে শেষেরটি। (আবু দাউদ: ৬৭৮) ইরবাজ ইবনে সারিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) থেকে বর্ণনা করেন যে তিনি প্রথম কাতারের জন্য তিনবার (রহমত ও মাগফিরাতের) দোয়া করতেন, তারপর দ্বিতীয় কাতারের জন্য একবার। (নাসায়ি:: ৮১৭)

৭. যে তার পরিবারের চোখে উত্তম
অনেক মানুষ দুনিয়ার সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে; কিন্তু নিজের পরিবারের খোঁজ রাখে না বা পরিবারের মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে না, সে ইসলামের দৃষ্টিতে ভালো মানুষ নয়; বরং ইসলামের দৃষ্টিতে ভালো মানুষ হতে হলে পরিবারের সঙ্গেও ভালো ব্যবহার করতে হবে। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) বলেন, তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম যে নিজের পরিবারের কাছে উত্তম। আর আমি তোমাদের চেয়ে আমার পরিবারের কাছে অধিক উত্তম। (ইবনে মাজাহ: ১৯৭৭)

অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে ঈমানে পরিপূর্ণ মুসলমান হচ্ছে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি। যেসব লোক নিজেদের স্ত্রীদের কাছে উত্তম, তারাই তোমাদের মধ্যে অতি উত্তম। (তিরমিজি: ১১৬২)

৮. যার লেনদেন স্বচ্ছ
ইসলাম লেনদেনে স্বচ্ছতাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছে। একটা মানুষ সারা জীবন ইবাদত করল; কিন্তু তার লেনদেন ভালো না, সে মানুষের ঋণ পরিশোধ করে না, তাহলে সে ইসলামের দৃষ্টিতে ভালো মানুষ নয়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, একজন লোক নবী করিম (সা.)-এর কাছে তার (প্রাপ্য) উটের তাগাদা দিতে আসে। আল্লাহর রাসুল (স.) সাহাবিদের বলেন, তাকে একটি উট দিয়ে দাও। তাঁরা বলেন, তার চেয়ে উত্তম বয়সের উটই পাচ্ছি। লোকটি বলল, আপনি আমাকে পূর্ণ হক দিয়েছেন, আল্লাহ আপনাকে যেন পূর্ণ হক দেন। আল্লাহর রাসুল (স.) বলেন, তাকে সেটি দিয়ে দাও। কেননা, মানুষের মধ্যে সেই উত্তম, যে উত্তমরূপে ঋণ পরিশোধ করে। (বুখারি: ২৩৯২)

৯. যারা মানুষের উপকার করে
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘মুমিন মিলেমিশে থাকে। তার মধ্যে ভালো কিছু নেই, যে মিলেমিশে থাকতে পারে না। যে ব্যক্তি মানুষের বেশি উপকার করে, সে-ই শ্রেষ্ঠ মানুষ।’ (আল-মুজামুল আওসাত: ৫৭৮৭)

১০. চরিত্রবান ব্যক্তি
আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (স.) অশ্লীল ভাষী ও অসদাচরণের অধিকারী ছিলেন না। তিনি বলতেন, তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম, যে নৈতিকতায় সর্বোত্তম। (বুখারি: ৩৫৫৯)

১১. যে আমলওয়ালা ব্যক্তি দীর্ঘ হায়াত পেল
আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, কোনো এক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসুল (স.), উত্তম ব্যক্তি কে? তিনি বলেন, যে দীর্ঘ জীবন পেয়েছে এবং তার আমল সুন্দর হয়েছে। সে আবার প্রশ্ন করল, মানুষের মধ্যে কে নিকৃষ্ট? তিনি বলেন, যে দীর্ঘ জীবন পেয়েছে এবং তার আমল খারাপ হয়েছে। (তিরমিজি: ২৩৩০)

১২. আলেম
আলেমদেরও শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন নবীজি (স.)। হজরত আবু উমামাহ আল-বাহিলী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, দুজন লোকের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে আলোচনা করা হলো। তাঁদের একজন আবেদ (সাধক, অধিক ইবাদতকারী) এবং অন্যজন আলেম। মহানবী (স.) বলেছেন, তোমাদের সাধারণ ব্যক্তির ওপর আমার যতখানি মর্যাদা, ঠিক তেমনি একজন আলেমের মর্যাদা একজন আবেদের ওপর। তারপর রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতারা এবং আসমান-জমিনের অধিবাসীরা, এমনকি গর্তের পিঁপড়া ও পানির মাছ পর্যন্ত সেই ব্যক্তির জন্য দোয়া করে, যে মানুষকে কল্যাণকর জ্ঞান শিক্ষা দেয়। (তিরমিজি: ২৬৮৫)

১৩. সত্যবাদী
হজরত আবদুল্লাহ বিন আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.)-কে বলা হলো, কোন ব্যক্তি সর্বোত্তম? তিনি বলেন, প্রত্যেক বিশুদ্ধ অন্তরের অধিকারী সত্যভাষী ব্যক্তি। (ইবনে মাজাহ: ৪২১৬)

১৪. হিংসা-বিদ্বেষহীন মানুষ
একই হাদিসের শেষাংশে রাসুল (স.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, সত্যভাষীকে তো আমরা চিনি, কিন্তু বিশুদ্ধ অন্তরের ব্যক্তি কে? তিনি বলেন, সে হলো পূতপবিত্র নিষ্কলুষ চরিত্রের মানুষ, যার কোনো গুনাহ নেই, নেই কোনো দুশমনি, হিংসা-বিদ্বেষ, আত্ম-অহমিকা ও কপটতা। (ইবনে মাজাহ: ৪২১৬)