ভাতিজা চ্যাম্পিয়ন, চাচা রানার্স-আপ

২৪ জুন, ২০২৪

সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত জুনিয়র এএইচএফ কাপে বাংলাদেশ পুরুষ অনূর্ধ্ব-২১ হকি দল অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। পুরুষ দল ট্রফি পেলেও নারী দল রানার্স আপ হয়ে শুধু মেডেলই পেয়েছে। নারী দলের রানার্স আপ ছাপিয়ে আলোচনায় প্রথমবারের মতো জুনিয়র এশিয়া কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন। সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ হকির এই সাফল্যের নেপথ্যে অন্যতম দুই জন পুরুষ দলের হেড কোচ মোঃ আশিকুজ্জামান ও নারী দলের ম্যানেজার তারিকউজ্জামান নান্নু। তারা সম্পর্কে আপন চাচা-ভাতিজা। 

বাংলাদেশ হকির ইতিহাসে নারী ও পুরুষ এক সঙ্গে কোনো টুর্নামেন্টে খেলেনি (গত বছর ফাইভ-এ-সাইড বাদে)। সেই টুর্নামেন্টে সফলতার পেছনে অবদান রাখতে পেরে দারুণ উচ্ছ্বসিত পুরুষ দলের প্রধান কোচ আশিকুজ্জামান। 'জাতীয় দলে অনেক দিন থেকে কাজ করলেও কখনো ছিলাম সহকারী আবার কখনো ফিটনেস কোচের ভূমিকায়। এবারই প্রথম কোনো জাতীয় দলের হেড কোচের দায়িত্ব পেয়েছি। বাংলাদেশ গত আসরে চ্যাম্পিয়ন ছিল। তাই একটা চ্যালেঞ্জও ছিল। প্রথম হেড কোচের দায়িত্বে বাংলাদেশ অপরাজিত শিরোপা অক্ষুন্ন রেখেছে আমার জন্মদিনেই। তাই আমার জীবনের অন্যতম সেরা মুহূর্ত’, সিঙ্গাপুর থেকে বলেন আশিকুজ্জামান।

জীবনের অন্যতম সেরা মূহুর্তে চাচা তারিকউজ্জামানও ছিলেন পাশে। তাই আরো বেশি আবেগাপ্লুত আশিক, 'বাবা-মায়ের পর আমার জীবনে কারো সবচেয়ে বেশি অবদান থাকলে তিনি আমার ছোট চাচা তারিকউজ্জামান। চাচা হলেও তিনি আমার বন্ধু, অভিভাবক সব কিছুই। চাচার পাশাপাশি বাংলাদেশের অন্যতম কিংবদন্তী ক্রীড়াবিদ প্রতাপ দা’র (স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সহ-অধিনায়ক, ফুটবল এবং হকি দু’টোতেই বাংলাদেশ দলে খেলেছেন) অবদানও বিশেষ দিনে স্মরণ করছি।’ 

নারী দলের সফল ম্যানেজার তারিকউজ্জামানও ভাতিজার সাথে থাকতে পেরে নিজেকেও গর্বিত বোধ করছেন, 'আমরা এক সঙ্গে খেলেছি কখনো দুই জন দুই দায়িত্বে দেশের বাইরে আসা হয়নি। আমি ম্যানেজার হিসেবে রানার্স আপ, ও (ভাতিজা) চ্যাম্পিয়ন দলের কোচ। এটা আমাদের পরিবারের জন্য দারুণ গর্বের।’

যশোরের এই জামান পরিবার বাংলাদেশের ক্রীড়া, শিক্ষা ও সংস্কৃতি অঙ্গনে বিশেষ স্থানে। তারিকউজ্জামান নয় ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট। নয় ভাইয়ের মধ্যে কেউ খেলায়, কেউ শিক্ষায় আবার কেউ সংষ্কৃতিতে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। ভাইদের মধ্যে সবার বড় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট গীতিকার মনিরুজ্জামান। আরেক ভাই কিংবদন্তী গীতিকার রফিকউজ্জামান। যিনি এবার স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন। আরেক ভাই ইমামউজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আসাদের স্মরণে ভাইয়েরা পারিবারিকভাবে গড়ে তুলেছেন আসাদ স্মৃতি সংঘ ক্লাব। যশোর জেলা ক্রীড়া সংস্থার অধীনে ক্রিকেট, হকি সহ অনেক খেলায় অংশগ্রহণ করে। এই ক্লাবের হয়ে দেশ-বিদেশের অনেক তারকা ক্রিকেটার, ফুটবলার খেলেছেন।

১৯৭৯ সালে আবাহনী-মোহামেডানকে টপকে বিজেএমসি প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। সেই দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন শফিকুজ্জামান। তিনি দীর্ঘদিন যশোর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদকের পাশাপাশি বাফুফের সদস্যও ছিলেন। শফিকুজ্জামানের একমাত্র ছেলে আশিকুজ্জামান জাতীয় হকি দলে খেলেছেন অনেক দিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আশিক পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন বুয়েটের সহকারী পরিচালক হিসেবে। ক্রীড়া, শিক্ষা ও সংস্কৃতির এত বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব দেশের অন্য কোনো পরিবারে পাওয়া বড়ই বিরল।

বাংলাদেশের হকির সঙ্গে চার দশকের বেশি সময় যুক্ত তারিকউজ্জামান। খেলোয়াড় ও সংগঠক হিসেবে মোহামেডানের ঘরের ছেলে হিসেবেই তার ক্রীড়াঙ্গনে পরিচিতি। চাচার সঙ্গে মোহামেডান ক্লাব থেকেই খেলোয়াড় আশিকের বেড়ে উঠা। হকি অঙ্গনে মাঠে ও মাঠের বাইরে প্রায়ই নানা বিতর্কিত ঘটনা ঘটে। তারিকউজ্জামান-আশিকুজ্জামান এসব থেকে আলাদা করে স্বাতন্ত্র্য পরিচয় সৃষ্টি করেছেন। তাই তাদের নিয়ে ক্রীড়াঙ্গনে তেমন কোনো সমালোচনা নেই।

সাবেক হকি খেলোয়াড় নান্নু ক্রীড়া পরিদপ্তরে পরিচালক হিসেবে অবসরে গেছেন কয়েক বছর। অবসরের আগে থেকেই নারী হকি নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। অবসরের পর তো নারী হকিই তার ধ্যানজ্ঞান। তাই তাকে বাংলাদেশের নারী হকির অন্যতম পথিকৃৎ বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। নারী দল জুনিয়র এশিয়া কাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করায় বেশ তৃপ্ত তারিকউজ্জামান, '২০১৯ সালে আমরা ছয় দলের মধ্যে পঞ্চম হয়েছিলাম পাঁচ বছর পর এখন সাত দলের মধ্যে দ্বিতীয়। এই টুর্নামেন্টের মাধ্যমে নারী হকি দল অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত হলো। আশা করি এখন তাদের পথচলা আরো মসৃণ হবে। নারী হকির সম্ভাবনা যেমন আছে তেমনি সামর্থ্যও রয়েছে। নারীদের সামর্থ্যরে প্রতি ফেডারেশনের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আস্থা রেখেছে।'

বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের আর্থিক সীমাবদ্ধতা অনেক। শত সংকটের মধ্যেও নারী ও পুরুষ দুই দলকে সিঙ্গাপুরের মতো ব্যয় বহুল শহরে টুর্নামেন্ট খেলতে পাঠিয়েছে। আবাসন খানিকটা নিম্নমান, খাবারের পরিমান ও গুণগত মানেও সমস্যা ছিল পাশাপাশি স্টেডিয়াম-হোটেল যাতায়াতেও প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়তে হয়েছে মাঝে মধ্যে। খরচ বাচাতে অনুশীলন/ম্যাচ খেলে পাচ-ছয় ঘন্টা অপেক্ষাও করতে হয়েছে আরেক (পুরুষ/নারী) দলকে। কোচ-ম্যানেজার খেলোয়াড়দের মনোযোগ মাঠেই রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। নারী দলের ম্যানেজার তারিকউজ্জামান বলেন, 'বিদেশি খাবারে একটু তো সমস্যা থাকেই। সেটা সময়ের সঙ্গে সবাই মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে। আমাদের আর্থিক সংকট থাকায় সেভাবেই ব্যবস্থাপনা করতে হয়েছে। খেলোয়াড়-কোচ সবাই সবার স্থান থেকে ত্যাগের মানসিকতা প্রদর্শন করেছে। এজন্যই দুই দল সফল হয়েছে।’ কোচরা এক মাসের বেশি সময় অনুশীলন করালেও এখনো কোনো সম্মানীই পাননি।

পুরুষ দল জুনিয়র এএইচএফ কাপে একাধিকবারের চ্যাম্পিয়ন হলেও জুনিয়র এশিয়া কাপ ব্যর্থতার গল্প। সেই বৃত্ত ভাঙতে কোচ আশিকের পরামর্শ, 'হকিতে মেধা রয়েছে, প্রয়োজন পরিচর্যা। নিয়মিত অনুশীলন ও ম্যাচ খেলার সুযোগ পেলে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সঙ্গে আমাদের ব্যবধান কমে আসবে।'

গ্রুপ পর্ব ও সেমিফাইনালের ম্যাচ বাংলাদেশ সহজে জিতলেও ফাইনাল বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। ফাইনাল ম্যাচ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন কোচ বলেন, 'আমাদের একাধিক খেলোয়াড় হলুদ কার্ড পাওয়ায় চাপে ছিলাম। আবার চীন দ্রুত দুই গোল পরিশোধ করেছিল। এরপরও আমার খেলোয়াড়রা তার সেরাটা দিয়েই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। আমরা যোগ্যতম দল সেটা প্রমাণ করেছি।'