পরকালে যাদের দোষত্রুটি আড়াল করে দেওয়া হবে

৩০ জুন, ২০২৪

ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী, হাশরের মাঠে মানুষ নিজের ছোট-বড়, ভালো-মন্দ, প্রকাশ্য-গোপন—সব ধরনের গুনাহ ও নেকি দেখতে পাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমলনামা সামনে রাখা হবে। তাতে যা আছে তার কারণে আপনি অপরাধীদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত দেখবেন। তারা বলবে- হায় আফসোস, এ কেমন আমলনামা! এ যে ছোট-বড় কোনো কিছুই বাদ দেয়নি। সবই এতে রয়েছে। তারা তাদের কৃতকর্মকে সামনে উপস্থিত পাবে। আপনার পালনকর্তা কারো প্রতি জুলুম করবেন না।’ (সুরা কাহাফ: ৪৯)

সে দিন মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত ও উদ্বিগ্ন থাকবে। দুনিয়াবি জীবনের ভুলের জন্য আফসোস করবে। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কিছু মানুষের দোষত্রুটি আড়াল করে দেওয়া হবে। তারা কারা?

তারা হলেন ওইসব লোক, যারা অন্যের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোনো বান্দার দোষ গোপন রাখে, আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন তার দোষ গোপন রাখবেন।’ (মুসলিম: ২৫১০, আহমদ: ২৭৪৮৪, ৮৯৯৫)

অন্যের দোষ গোপন রাখা একটি মহৎ গুণ। এতে দুনিয়াতেই ফল পাওয়া যায়। সবার কাছে সে বিশ্বস্ত প্রমাণিত হয়। যে ব্যক্তি অন্যের দোষ বলে বেড়ায়, সে সবার বিশ্বস্ততা হারায়। সম্পর্কও নষ্ট হয়। উত্তম চরিত্রের দাবি হলো—অন্যের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখা এবং কথাচ্ছলেও প্রকাশ না করা। 

অথচ আমাদের সমাজে অধিকাংশ মানুষের চারিত্রিক প্রবণতা হলো কারো গোপনীয় কথা ফাঁস করে দেওয়া। অনেকে তো যাচাই-বাছাই না করেই প্রচার করে বেড়ায়। এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন— ‘তোমরা মুসলমানদের দোষ-ত্রুটি, ভুলভ্রান্তি খুঁজে বের করো না। যে ব্যক্তি অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ায় ও প্রকাশ করে দেয়, স্বয়ং আল্লাহ তার দোষ প্রকাশ করে দেন। আর আল্লাহ যার দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করেন তাকে নিজের বাড়িতেই লাঞ্ছিত করেন।’ (আবু দাউদ: ৪৮৮০)
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে বলতে শুনেছি, ‘আমার সকল উম্মত মাফ পাবে, তবে পাপ-প্রকাশকারী ব্যতীত। আর এক প্রকার প্রকাশ এই যে, কোনো ব্যক্তি রাতে কোনো পাপকাজ করে, যা আল্লাহ গোপন রাখেন। কিন্তু সকাল হলে সে বলে বেড়ায়, হে অমুক! আমি আজ রাতে এই এই কাজ করেছি।’ অথচ সে এমন অবস্থায় রাত্রি অতিবাহিত করেছিল যে, আল্লাহ তার পাপ গোপন রেখেছিলেন। কিন্তু সে সকালে উঠে তার উপর আল্লাহর আবৃত পর্দা খুলে ফেলে।’ (বুখারি: ৬০৬৯, মুসলিম: ২৯৯০)

সুতরাং শুধু অন্যের নয়, নিজের গোপনীয় বিষয়ও ফাঁস করা যাবে না। কারণ আল্লাহর কাছে তাওবা করে ক্ষমা চাইলে তিনি তা ক্ষমা করবেন। কিন্তু প্রকাশ করে দিলে আল্লাহর আবৃত পর্দা খুলে ফেলা হয়। ফলে গোপন রাখার সুযোগ তাঁর থাকে না। তাই নিজের হোক বা অন্যের—কারো ব্যক্তিগত ত্রুটি প্রকাশ করা মুমিনের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।

কোরআনুল কারিমে অন্যের গোপন বিষয় অনুসন্ধান করতে নিষেধ করে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন— يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيراً مِّنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَن يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَّحِيمٌ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয়ই কিছু ধারণা গুনাহ। আর গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। তোমাদের কেউ যেন কারও পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তারা মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়া পছন্দ করবে? বস্তুতঃ তোমরা তো একে ঘৃণাই কর। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।’ (সুরা হুজরাত: ১২)

মেরাজের রাতে রাসুলুল্লাহ (স.)-কে কিছু পাপের শাস্তি দেখানো হয়েছে। ‘তিনি জাহান্নামে একদল লোককে দেখলেন, যারা তামার তৈরি নখ দিয়ে অনবরত নিজেদের মুখমণ্ডল ও বুকে আঁচড় মারছে। জিব্রাইল (আ.) বললেন, এরা মানুষের গোশত খেতো (গিবত ও পরনিন্দা করত)। (আবু দাউদ: ৪৮৭৮, মুসনাদে আহমদ: ৩/২২৪, তাফসিরে ইবনে কাসির: ৫/৯)

হজরত আলি (রা.) বর্ণনা করেন, ব্যতিব্যস্ত হয়ো না এবং কারো গোপন তথ্য ফাঁস করো না। কেননা তোমাদের পেছনে রয়েছে কেয়ামতের) ভীষণ কষ্টদায়ক এবং দীর্ঘস্থায়ী বিপদসমূহ।’ (আদাবুল মুফরাদ) হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, যখন তোমার সঙ্গীর দোষ চর্চা করতে ইচ্ছা করে, তখন তোমার নিজের দোষ স্মরণ করো।’ (আদাবুল মুফরাদ)

তাই আমরা আজ থেকে প্রতিজ্ঞা করি, কারও দোষ-ত্রুটি অন্যদের কাছে প্রকাশ করব না, পরচর্চা ও পরনিন্দা করব না। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে জিহ্বার হেফাজত করার তাওফিক দিন। আমিন।