ভুল বোঝাবুঝি দ্রুত নিরসনের উপায় ও ফজিলত

৩০ জুন, ২০২৪

মানুষ সামাজিক জীব। একসঙ্গে বসবাসের কারণে বিভিন্ন বিষয়ে ভুল বোঝাবুঝি বা ঝগড়া-বিবাদ হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে এ বিবাদ নিরসন না হলে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় থাকে না; এমনকি বিদ্বেষ বাড়তে থাকলে অনেকসময় বড় ধরণের ক্ষতি হয়ে যায়। তাই ইসলাম পারস্পরিক বিরোধ দ্রুত নিরসন করার নির্দেশ দেয়। বান্দার আপস-নিষ্পত্তিকে আল্লাহ বড়ই পছন্দ করেন। বান্দার উত্তম এই গুণ নিয়ে তিনি গর্ব করেন। তার জন্য পুরস্কারের ঘোষণা করেন। পক্ষান্তরে তা মীমাংসাহীনভাবে চলতে থাকাটা আল্লাহ অপছন্দ করেন। 

যেমন রাসুল (স.) বর্ণনা করেন, ‘সোমবার ও বৃহস্পতিবার জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করে না এমন সবাইকে মাফ করে দেওয়া হয়। তবে ওই দুই ব্যক্তি ছাড়া যারা পরস্পর বিদ্বেষ পোষণ করে। তাদের সম্পর্কে বলা হয়, ‘পরস্পর মিলে যাওয়া পর্যন্ত এদেরকে অবকাশ দাও।’ (মুসলিম: ২৫৬৫)

পারস্পরিক বিবাদ নিরসনের সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ হলো নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করা। নিজের দাবি থেকে একটু সরে আসা। রাসুল (স.) বর্ণনা করেন, ‘সে ব্যক্তি শক্তিশালী নয়, যে কুস্তিতে লড়াই করে অপরকে ধরাশায়ী করে, বরং প্রকৃতপক্ষে সে ব্যক্তিই শক্তিশালী, যে রাগের সময় নিজেকে সংবরণ করতে পারে।’ (বুখারি: ৬৮০৯)

নিজেকে নিয়ন্ত্রণ কারা বা সংযত করা ইসলামে প্রশংসিত বিষয়। এর জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি ন্যায়ের ওপর থাকা সত্ত্বেও বিবাদ পরিহার করে, তার জন্য জান্নাতের মাঝে একটি ঘর তৈরি করা হয়।’ (তিরমিজি: ১৯৯৩) 

কোনো মাধ্যম ছাড়া নিজে উদ্যোগ নিয়ে বিবাদ নিরসনের চেষ্টা করা উত্তম পন্থা। এক্ষেত্রে নিজে ভুল করলে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া এবং আগের মতো সহাবস্থানে ফিরে যাওয়া উত্তম। এরপর দেখা-সাক্ষাতে সালামের আদান-প্রদান করা এবং সম্ভব হলে হাদিয়া তোহফা দেওয়া হাদিস অনুযায়ী অনেক বড় একটি আমল। এতে খারাপ সম্পর্কের পরিবর্তে সুসম্পর্ক স্থায়ী হয়।

দুই ভাই বা দুই বন্ধুর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হলে নিজেদের তাগিদে দ্রুততার সঙ্গে তা নিরসন করা কর্তব্য। এক্ষেত্রে অন্তত তিনদিনের বেশি যেন সম্পর্কহীন অবস্থায় না থাকে সেই চেষ্টা থাকতে হবে। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা পরস্পর সম্পর্কছেদ করো না, একে অন্যের বিরুদ্ধে শত্রুভাবাপন্ন হয়ো না, পরস্পরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করো না, পরস্পর হিংসা করো না। তোমরা আল্লাহর বান্দা, ভাই ভাই হয়ে যাও। কোনো মুসলিমের জন্য তার ভাইয়ের সঙ্গে তিন দিনের বেশি কথাবার্তা বলা বন্ধ রাখা বৈধ নয়।’ (বুখারি: ৬০৫৬; মুসলিম: ২৫৫৯)

তবে, যদি পুরোপুরি উল্টোটাই হয় এবং বিবাদ-বিদ্বেষ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তাহলে মীমাংসার জন্য নেতৃস্থানীয় লোকদের এগিয়ে আসা উচিত। তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন নিষ্পত্তি করার এবং উভয়ের সম্পর্ককে নবায়ন করে দেওয়ার। যারা এই মহৎ কাজটি করবে আল্লাহ তাদেরকে সুসংবাদ প্রদান করেন। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘মুমিনদের দুটি দল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। অতঃপর তাদের একটি দল যদি অন্য দলের ওপর বাড়াবাড়ি করে, তবে যে দল বাড়াবাড়ি করছে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো, যতক্ষণ না সে আল্লাহর হুকুমের দিকে ফিরে আসে। সুতরাং যদি ফিরে আসে তবে তোমরা তাদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে মীমাংসা করে দাও এবং ইনসাফ করো। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদের ভালোবাসেন। মুমিনগণ পরস্পর ভাই-ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও, আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হও।’ (সুরা হুজরাত: ৯-১০)

প্রিয়নবী (স.) ইনসাফের সঙ্গে বিরোধ মীমাংসা করতেন। ফলে সন্তুষ্ট হয়ে যেত বাদী-বিবাদী উভয়পক্ষ। মীমাংসার সময় তিনি ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের অধিকার লঙ্ঘন ও মিথ্যা দাবির ওপর অটল থাকার ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করতেন। শিক্ষা দিতেন পারস্পরিক সহানুভূতি প্রদর্শনের। অনৈতিক দাবি-দাওয়া ও নোংরা স্বজনপ্রীতির প্রতি ঘৃণাবোধ জাগ্রত করতেন। ফলে মুসলিম সমাজ ক্রমান্বয়ে একটি কল্যাণমূলক সমাজে পরিণত হয়। 

ভাই ভাই হয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আল্লাহ তাআলার পছন্দের বিষয়। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, ‘আমি কি তোমাদের নামাজ, রোজা ও সদকার চেয়ে উত্তম কাজ সম্পর্কে অবহিত করব না?’ সাহাবায়ে কেরাম (রা.) বললেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই।’ তিনি বললেন, ‘পরস্পর সুসম্পর্ক স্থাপন। কারণ, পরস্পর সুসম্পর্ক নষ্ট হওয়া মানে দ্বীন বিনাশ হওয়া।’ (তিরমিজি: ২৫০৯)

মনে রাখা উচিত, হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি এসব জান্নাতে প্রবেশের অন্তরায়। তাই মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জান্নাত দেওয়ার আগে হিংসা-বিদ্বেষ থেকে তাদের অন্তরকে পবিত্র করবেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আমি তাদের অন্তর থেকে হিংসা-বিদ্বেষ বের করে ফেলব, তারা সেখানে ভাই ভাই হয়ে আসনে মুখোমুখি বসবে।’ (সুরা হিজর: ৪৭)

অতএব জান্নাতে যেতে চাইলে আগে থেকেই অন্তরকে পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করতে হবে। বিবাদ-বিরোধ, হানাহানি, মারামারি থেকে বেঁচে থাকতে হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন।