ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ে নিষেধ ফরজ দায়িত্ব

২৯ জুলাই, ২০২৪

ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ে নিষেধ একটি মহান ইবাদত। কোরআনের ভাষায় ‘আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার’ তথা ভালো কাজের আদেশ ও অন্যায় কাজে নিষেধ। এটি ফরজ দায়িত্ব। একটি কল্যাণকামী সমাজ ও সভ্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য যা জরুরি। ‘আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার’ দুই মৌলিক উপাদানের কারণেই মুসলিম উম্মাহ শ্রেষ্ঠ ও কল্যাণকামী জাতি। 

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। মানুষের কল্যাণে তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎকাজের বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে।’ (সুরা আলে ইমরান: ১১০) 

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমাদের মধ্য থেকে এমন একটি জাতি হওয়া উচিত যারা সব ভালো কাজের দিকে আহ্বান করবে, সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অসৎকাজে নিষেধ করবে, প্রকৃতভাবে তারাই সফলকাম সম্প্রদায়।’ (সুরা আলে ইমরান: ১০৪)

অসৎকাজে নিষেধ করা মুমিনের অন্যতম গুণ। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তারা হচ্ছে আল্লাহর দিকে বারবার প্রত্যাগমনকারী, তার ইবাদাতকারী, তা প্রশংসাবাণী উচ্চারণকারী, তা জন্য জমিনে বিচরণকারী, তার সামনে রুকু ও সেজদাকারী, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের বাধা দানকারী এবং আল্লাহর সীমারেখা সংরক্ষণকারী। (সুরা তাওবা: ১১২)

এমন গুরুত্বপূর্ণ বিধান পালনে নারী-পুরুষ সবার ভূমিকা রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী, তারা সবাই পরস্পরের বন্ধু ও সহযোগী। তারা ভালো কাজের হুকুম দেয় এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। (সুরা তাওবা: ৭১)

যারা সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে বাধা দেওয়ার কাজে এগিয়ে আসে না, তাদের নিন্দাবাদ জ্ঞাপন করা হয়েছে পবিত্র কোরআনে। ইরশাদ হয়েছে, ‘বনী ইসরাঈল জাতির মধ্য থেকে যারা কুফরির পথ অবলম্বন করেছে তাদের ওপর দাউদ ও মরিয়ম পুত্র ঈসার (আ.) মুখ দিয়ে অভিসম্পাত করা হয়েছে। কারণ তারা বিদ্রোহী হয়ে গিয়েছিল এবং বাড়াবাড়ি করতে শুরু করেছিল। তারা পরস্পরকে খারাপ কাজ করা থেকে বিরত রাখা পরিহার করেছিল, তাদের গৃহীত সেই কর্মপদ্ধতি বড়ই জঘন্য ছিল।’ (সুরা মায়েদা: ৭৮-৭৯)

অন্যায় বা খারাপ কাজ দেখলে মুমিনদের তা বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন নবীজি (স.)। সামর্থ্য না থাকলে মুখে প্রতিবাদ করার ঘোষণা এসেছে হাদিসে। সামর্থ্য না থাকলে কমপক্ষে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করতে হবে। এ বিষয়ে হাদিসটি হলো— নবী (স.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যদি কোনো খারাপ কাজ বা বিষয় দেখে তাহলে সে যেন হাত দিয়ে তা পরিবর্তন করে দেয়, যদি তা করতে অপারগ হয় তাহলে যেন মুখ দিয়ে তার প্রতিবাদ করে, যদি তাও করতে সক্ষম না হয় তাহলে যেন অন্তর দিয়ে তা ঘৃণা করে, আর এটাই হচ্ছে ঈমানের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বলতম স্তর।’ (বুখারি: ১৯৪)

সমাজে এই ইবাদতের চর্চা বন্ধ হয়ে গেলে ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়ে। অবুঝ ও গাফেল ব্যক্তিরা আল্লাহর পথ চিনতে পারে না। ফলে অন্যায় কাজে ডুবে থাকে মানুষ। তখন মহান আল্লাহর ক্রোধ বেড়ে যায়। ওই সমাজে আজাব নেমে আসে এবং তাদের কোনো দোয়াও কবুল করা হয় না। 

তাছাড়া মুসলিম সমাজের মানুষ যখন এই ইবাদত (ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ) পরিত্যাগ করবে, তখন আল্লাহ তাআলা খারাপ মানুষকে সেই সমাজের কর্ণধার বানিয়ে দেবেন। একইসঙ্গে ভালো ও নেককার মানুষের দোয়াও কবুল করবেন না।

হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ করে বলছি—তোমরা অবশ্যই ভালো কাজে মানুষকে আদেশ দেবে এবং অবশ্যই অন্যায় থেকে নিষেধ করবে। যদি তা না করো তাহলে আল্লাহ তোমাদের উপর তাঁর পক্ষ থেকে শাস্তি প্রেরণ করবেন। এরপর তোমরা তাঁর নিকট প্রার্থনা করলেও তিনি কবুল করবেন না।’ (তিরমিজি: ৪/৪০৬, নম্বর: ২১৬৯, ভা-২/৪০) 

উল্লেখিত হাদিসের মান ‘হাসান’। তবে একই অর্থে আবু হুরায়রা (রা.), আয়েশা (রা.) ও অন্যান্য সাহাবি থেকে হাদিস বর্ণিত হয়েছে। (দেখুন- ইবনে মাজাহ: ২/১৩২৭; তাবারানি, আল মুজামুল আওসাত: ২/৯৯; মুসনাদে আহমদ: ৫/৩৯০; মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ৭/২৬৬; রিয়াদুস সালেহিন পৃ-৯২-৯৭)

দ্বীনের অত্যাবশ্যকীয় এই দাওয়াতের গুরুত্ব ও ছেড়ে দেওয়ার ভয়াবহতা বোঝানোর জন্য মহানবী (স.) একটি অনন্য উদাহরণ দিয়েছেন। নোমান ইবনে বশির (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুল (স.) বলেছেন, যে মহান আল্লাহর নির্ধারিত সীমার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং যে সীমা লঙ্ঘন করে, তাদের দৃষ্টান্ত সেই যাত্রীদলের মতো, যারা লটারির মাধ্যমে এক নৌযানে নিজেদের স্থান নির্ধারণ করে নিল। তাদের কেউ স্থান পেল ওপর তলায় আর কেউ নিচ তলায় (পানির ব্যবস্থা ছিল ওপর তলায়) কাজেই নিচের তলার লোকেরা পানি সংগ্রহকালে ওপর তলার লোকদের ডিঙ্গিয়ে যেত। তখন নিচ তলার লোকেরা বলল, ওপর তলার লোকদের কষ্ট না দিয়ে আমরা যদি নিজেদের অংশে একটি ছিদ্র করে নিই (তবে ভালো হয়) এ অবস্থায় তারা যদি এদের আপন মর্জির ওপর ছেড়ে দেয় তাহলে সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে। আর যদি তারা এদের হাত ধরে রাখে (বিরত রাখে), তারা এবং সবাই রক্ষা পাবে। (বুখারি: ২৪৯৩)

অতএব, মুমিন মুসলমানের জন্য বাঞ্ছনীয় সৎকাজের আদেশ দেওয়া এবং অসৎ কাজে নিষেধ করা। তবে, রাষ্ট্রীয় আইন লঙ্ঘন করে এ দায়িত্ব সবাই নেবেন না। ইসলামে অন্যায়ের দমন ও সামাজিক পরিবর্তনের ক্রমবিন্যাস রয়েছে। ইমাম গাজালি (রহ.)-এর মতে তা হলো—১. অন্যায়ের পরিচয় তুলে ধরা এবং সচেতন করা, ২. আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি ও পুরস্কারের বর্ণনা দেওয়া, ৩. ধমক ও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা, ৪. সশরীরে বাধা দেওয়া, ৫. আঘাত করা, ৬. অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত অভিযান পরিচালনা করা। (ইহইয়াউ উলুমুদ্দিন: ২/৩২৯-৩৩৩)

এখানে ৪ থেকে ৬ পর্যন্ত ধাপগুলো সবার ক্ষমতার মধ্যে থাকে না। তাই নিজের সামর্থ্যের ব্যাপারে সচেতন থাকুন। নবীজি (স.) এর হাদিসের অনুসরণ করুন। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ইসলামের সকল নির্দেশনা মেনে চলার তাওফিক দান করুন। সৎকাজের আদেশ ও অন্যায় কাজে বাধা দেওয়ার শক্তি, সাহস ও সামর্থ্য মুসলিম উম্মাহকে দান করুন। আমিন।